আলবদর ১৯৭১ by মুনতাসীর মামুন

(পূর্ব প্রকাশের পর) এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য। আমাদের অনেকের ধারণা ডিসেম্বরেই বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ ও হত্যা করা হয়েছিল। আসলে তা নয়। ২৫ মার্চ থেকেই তা শুরু হয়েছিল। এর প্রমাণ, ২৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হত্যা করা। সারা বছর ধরেই এ অপহরণ হত্যাকা- চলেছে।


আলবদর, আলশাসস গঠিত হবার পর এ হত্যাকা- জোরদার হয়ে ওঠে মাত্র। অনেকে ডিসেম্বরের আগেই অপহৃত হয়েছেন, কিন্তু তাঁদের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
পাকিস্তানী ও তাদের সহযোগী আলবদর ও আলশামসরা কতজন বুদ্ধিজীবী হত্যা করেছে? এর সঠিক হিসাব কিন্তু এখনও পাওয়া যায়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রণয়নে আমরা ব্যস্ত থেকেছি। কিন্তু কারা শহীদ হলেন, খুনী কারা তাদের তালিকা প্রণয়ন করা হয়নি। এখনও সে চেষ্টা নেয়া হয়নি। এসব যখন মনে হয় তখন আমাদের পুরো শ্রেণীটির প্রতি ধিক্কার জানানো ছাড়া করার কিছুই থাকে না। একবার ভেবে দেখেছেন কি প্রত্যেক জাতির জাতীয় বীর থাকে, আমাদের নেই। থাকলেও স্বীকার করি না। আমরা স্বীকার করি তাদের, যাদের সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই এবং তারা বিজাতীয়। পৃথিবীর সব দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের পর প্রথম যে-কাজটি করা হয় তাহলো জাতীয় বীরদের প্রতি স্মৃতিতর্পণ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ একমাত্র ব্যতিক্রম। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে দৈনিক বাংলায় আবেগময়ী এক সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয়েছিলÑ “পরাজয়ের প্রাক-মুহূর্তে বর্বর সামরিক জান্তার আলবদর ঘাতকচক্র নারকীয় বীভৎসতার যে স্বাক্ষর রেখে গেছে, ফ্যাসিস্ট হিংস্রতার ইতিহাসেও তার কোন তুলনা খুঁজে পাওয়া যাবে না। পঁচিশে মার্চের বিভীষিকাময় রাতে দেশের বুদ্ধিজীবীদের যে অবশিষ্ট অংশটি এদের নৃশংসতা থেকে কোনমতে পরিত্রাণ পেয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত তারাও এই হায়েনাদের মত্ততার নিষ্ঠুর শিকারে পরিণত হলেন। সভ্যতার অনুশাসনে যারা বিশ্বাসী, বিশ্বাসী যারা নৈতিক মূল্যবোধে, এই বর্বরতাকে কিছুতেই তারা ক্ষমা করতে পারবে না। কিন্তু ক্ষমা করা হয়েছে শুধু নয়, তাদেরকে এই দেশেরই রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রী, এমপি করা হয়েছে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত স্বাধীনতা জাদুঘর হয়নি, কিন্তু সামরিক জাদুঘর হয়েছে এবং বিএনপি সরকারের আমলে শহরের কেন্দ্রস্থলে তা স্থানান্তরিত করা হয়েছে।
বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্ত দাবি করে ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারবর্গ শহীদ মিনারে গণজমায়েত করেন। এরপর মিছিল করে বঙ্গভবনে যান। মিছিলকারীরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম দেখা করতে অস্বীকার করেন। পরে মিছিলকারীরা বঙ্গভবনের ফটকে অবরোধ করে বসে পড়লে অনেকক্ষণ পর প্রধানমন্ত্রী এসে তাদের সঙ্গে দেখা করেন এবং মিছিলকারীদের সঙ্গে তাঁর উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। পরে তিনি জানান যে, তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং যথাসময়ে তা প্রকাশ করা হবে। ইতোপূর্বে ৮ ফেব্রুয়ারি জহির রায়হানের পরিবারের সদস্যদেরও তিনি অশ্রুভারাক্রান্ত কণ্ঠে জানিয়েছিলেন, জহির রায়হানের অন্তর্ধানসহ বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্তের জন্য তিনি নির্দেশ দিয়েছেন এবং তিন সপ্তাহের ভেতর তাঁকে রিপোর্ট করা হবে। সেই তদন্তের ফলাফল দেশবাসীক কখনও জানতে পারেননি।
পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানতে পারি, ১৯৭২ সালে ড. আজাদকে হত্যার দায়ে দু’জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়েছিল। কিন্তু, তারপর এ মামলার কী হলো তা জানি না। ড. আলীম চৌধুরীর হত্যাকারী হিসেবে আলবদর আবদুল মান্নানকে (মাওলানা ও ‘ইনকিলাবের পরলোকগত মালিক) ধরা হয়েছিল তিনিও ছাড়া পেয়ে যান। শহীদুল্লা কায়সারের হত্যাকারী হিসেবে পরিচিত খালেক মজুমদারকে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল জজ সাত বছরের কারাদ- দেয়। সে রায় বাতিল হয়ে যায় হাইকোর্টে।
বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী ও সিদ্দিক আহম্মদ চৌধুরী তাঁদের রায়ের উপসংহারে বলেন, “ওহ ঃযব পরৎপঁসংঃধহপবং. ঃযবৎবভড়ৎব, ঃযব ড়ঢ়রহরড়হ রং ঃযব ফড়ঁনঃ যধং পৎবঢ়ঃ রহঃড় ঃযব ঢ়ৎড়ংবপঁঃরড়হ পধংব ধহফ ঃযরং ফড়ঁনঃ মড়বং রহ ভধাড়ঁৎ ড়ভ ঃযব ধপপঁংবফ ধহফ বি ধপপড়ৎফরহমষু মরাব নবহবভরঃ ড়ভ ফড়ঁনঃ.”
বিচারপতি বদরুল চৌধুরীর একটি আর্গুমেন্ট লক্ষ করুনÑ
“ঈরৎপঁসংঃধহপবং ংযড়রিহম ঃযধঃ ধনফঁষ কযধষবয়ঁব ধিং ধ সবসনবৎ ড়ভ ঔধসধঃ-ব-ওংষধসর ফড়সরহধঃবফ ঃযব সরহফ ধহফ লঁফমবসবহঃ ড়ভ ঃযব ঢ়ৎড়ংবপঁঃরড়হ রিহঃবংংবং নবপধঁংব রসঢ়ৎবংংরড়হ ধিং পৎবধঃবফ ঃযধঃ লধসধঃ-ব-ওংষধসর ধিং ধমধরহধঃ রহ সড়াবসবহঃ ড়ভ ঃযব খরাবৎধঃরড়হ. ইব ঃযধঃ ধং রঃ সধু. ঞযরং রসঢ়ৎবংংরড়হ ধিং ৎবংঢ়ড়হংরনষব ভড়ৎ রহভঁষবহপরহম ঃযব রহফঁপঃরাব ৎবধংড়হরহমং ড়ভ ঃযব রিঃহবংং.”
মনে হয় বিচারকরা সব স্বর্গে ছিলেন। যেখানে জামায়াতে ইসলামী চোখের সামনে এত বড় হত্যাকা- ঘটালে সেখানে কি ইমপ্রেশন হবে আওয়ামী লীগ দায়ী ছিল? বিচারকরা অবসর নেয়ার পর আজকাল অনেক উপদেশ দেন। বদরুল হায়দারও দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, এই বিচারক প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার জন্য যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের কাছে দোয়া মাংতে গিয়েছিলেন। আরও লক্ষণীয় সবচেয়ে বড় আলবদর গোলাম আযমের নাগরিকত্ব মামলায় দু’জন বিচারক গোলাম আযমের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। খুব সম্ভব ১৯৭১ সাল তারা দেখেননি, বা দেখলেও এর মর্ম বোঝেননি। আইন মানুষ তৈরি করে এটা বোধ হয় তাদের জানা ছিল না। সেজন্য একই ধরনের আর্গুমেন্টে গোলাম আযমকে নাগরিকত্বও দেয়া হয়েছে। এতে যে ন্যাচারাল জাস্টিস লঙ্ঘিত হয়েছে তা কারও মনে হয়নি। আমরা এগুলো মেনে নিয়েছি কারণ আমরা সেই আইনের ফ্রেমে বাস করি। কিন্তু এ পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিষয় শুধু উল্লেখ করতে চাইÑবাংলাদেশে যত বিতর্কমূলক নির্র্বাচন হয়েছে তার প্রায় প্রত্যেকটির প্রধান (নির্বাচন কমিশন) ছিলেন একজন বিচারপতি। বাংলাদেশে যতগুলো অগণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার প্রতিটির প্রধান ছিলেন একজন বিচারপতি। ১৯৭৮ সালে এক রায়ে বিচারপতিরা রায় দিয়েছিলেন সামরিক আইন সংবিধানের ওপর। অথচ, পৃথিবীতে সামরিক আইন জংলি আইন হিসেবে পরিচিত। ১৯৭২ সালে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পরিগণিত হয় এবং সমস্ত কাজকর্ম ওই ভাষায় সম্পাদনের নির্দেশ দেয়া হয়। অধিকাংশ বিচারপতি সেই আইন না-মেনে ইংরেজীতে রায় লিখেছেন। পরবর্তীকালে বিচারপতি খায়রুল হক একমাত্র এসব যুক্তির বিপক্ষে ন্যাচারাল জাস্টিসের সূত্র ধরে রায় দিয়েছিলেন।


আলবদরদের বিচারের প্রচেষ্টা

মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার, আলবদর, আলশামস এবং অন্যান্য স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠন যে শুধু পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল তা নয়, তারা গণহত্যা, ধর্ষণ, লুট এবং অন্যান্য সমাজবিরোধী কাজেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। এবং এটা খুবই স্বাভাবিক যে, সফল যুদ্ধ শেষে তাদের ওপর প্রতিশোধ নেয়া হবে। কিন্তু দেখা গেল, যুদ্ধ শেষে অনেকে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য অনেকের বিরুদ্ধে ভুয়া অভিযোগ এনেছে; অনেকে শাস্তির ব্যাপারটা নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। এসব অভিঘাত সৃষ্টি করল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর। সরকার অবশ্য চেয়েছে পাকিস্তানী দালালদের বিরুদ্ধে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে। ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি, সরকার ঘোষণা করে ‘বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) অধ্যাদেশ, ১৯৭২।’ এ আইনে শাস্তির মেয়াদ ছিল দু’বছর থেকে মৃত্যুদ- পর্যন্ত। এ ধরনের আইনের প্রয়োজন ছিল। শুধু তাই নয়, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্যও প্রয়োজন ছিল এর যথাযথ প্রয়োগ। ২৮ মার্চ সারাদেশে দালাল বিচারের জন্য গঠন করা হলো ৭৩টি ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু, এ আইনে একটি ফাঁক ছিল। ৭ম ধারায় বলা হয়েছিল, “থানার ভারপ্রাপ্ত ওসি যদি কোনো অপরাধকে অপরাধ না বলেন তবে অন্য কারও কথা বিশ্বাস করা হবে না। অন্য কারও অভিযোগের ভিত্তিতে বিচার হবে না ট্রাইব্যুনালে। অন্য কোনো আদালতেও মামলা দায়ের করা হবে না।”
১৯৭৩ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত এই অধ্যাদেশ বলে অভিযুক্ত করা হয়েছিল ৩৭,৪৭১ জনকে। মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল ২,৮৪৮ জনের। দ-প্রাপ্ত হয়েছিল মাত্র ৭৫২ জন। ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর শেখ মুজিব সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। (চলবে)

No comments

Powered by Blogger.