আসমানীদের দেখতে যদি... by আবদুল আউয়াল

পল্লীকবি জসীমউদ্দীন ১৯৪৬ সালে রসুলপুরে বসে লিখেছিলেন, 'আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও, রহিমুদ্দির ছোট্ট বাড়ী রসুলপুরে যাও'। কবির সে কাব্যময় আবেদনে সাড়া দিলে আর পাওয়া যাবে না কবির অমর সৃষ্টি 'আসমানী' কবিতার বাস্তব চরিত্র আসমানীকে।


গত ১৮ আগস্ট রাত ৩টায় দীর্ঘদিন রোগ ও দারিদ্র্যের মাঝে দিন কাটানোর পর অবশেষে তিনি চলে যান না-ফেরার দেশে। বাংলা সাহিত্যের যে কবির কলমে ফুটে ওঠে সবুজে ঘেরা গাঁ, শণের পাতায় ছাওয়া ছোট্ট কুটির আর শিশির ঝরা ঘাসের মন হরণকারী চিত্র_ তিনি পল্লীকবি জসীমউদ্দীন। ফরিদপুর জেলার তাম্মুলখানা গ্রামে জন্ম নেওয়া এই প্রবাদপুরুষের লেখা 'আসমানী' কবিতাটি ১৯৪৯ সালে তার 'এক পয়সার বাঁশি' কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত হয়, যা পাঠকমহলে বেশ সাড়া ফেলে এবং পরবর্তী সময়ে পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়।
দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে জসীমউদ্দীনের বিদ্রোহের নায়িকা হলো আসমানী। কবি ক্ষুধার্ত, অসুস্থ আর হতদরিদ্র আসমানীকে তুলনা করেন তারই গ্রামের আরেক ধনীর দুলালী খোসমানীর সঙ্গে। পাখির বাসার মতো এক বাড়িতে আসমানীর বাস, যে কি-না খেতে পারে না পেট ভরে দু'মুঠো ভাত। কবির ভাষায়, 'পেটটি ভরে পায় না খেতে, বুকের কখান হাড়, সাক্ষী দিছে অনাহারে কদিন গেছে তার'। আসমানীদের নেই বিশুদ্ধ খাবার পানি, পাশের বাড়ির পদ্ম-পুকুর থেকে পানি খেতে হয় তাদের, যাতে শ্যাওলা আর ম্যালেরিয়ার বিষ কিলবিল করে। জসীমউদ্দীন এই আসমানীকে দেখে বিদ্রোহ করেছিলেন খোসমানীদের সঙ্গে। ব্যথিত হয়েছিলেন তীব্রভাবে। কবির এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে তার আরেক কবিতা 'বস্তির মেয়ে'তেও; যেখানে তিনি দেখিয়েছিলেন আসমানীদের মুক্তির পথ।
কবির আসমানীর সংখ্যা আজ প্রচুর। গ্রাম পেরিয়ে নগরের এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে কবির আসমানীরা আজ ছড়িয়ে আছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, সারাদেশে ছিন্নমূল পথশিশুর সংখ্যাই প্রায় ৬ লাখ ৬৯ হাজার ৭৮২। বাস্তবে তার সূচক হয়তো আরও বেশি। ছিন্নমূল এসব শিশু বঞ্চিত খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসাসহ যাবতীয় মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে। নগরের এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে এসব ছিন্নমূল শিশু, যাদের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার জন্য এসব শিশু বেছে নেয় নানা রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। বেঁচে থাকার জন্য তারা কখনও গ্রহণ করছে ভিক্ষাবৃত্তি, কখনও ডাস্টবিনের ময়লা কুড়ানো, কখনও ছিঁচকে চুরি, কখনও মাদক বিক্রির মতো ভয়াবহ কাজ, কখনও বা দেখা যায় হকার হয়ে ছুটে বেড়াতে নগরের এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের ২৮ নম্বর সনদ অনুযায়ী যে বয়সে একটি শিশুর থাকা উচিত বিদ্যালয়ে, খেলার মাঠে; সে বয়সে তারা একমুঠো ভাতের জন্য সংগ্রামে টিকে থাকতে পারছে না। কবির আসমানীরা এখন জ্যামিতিক হারে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে।
কাজী নজরুল ইসলাম দারিদ্র্যের কণ্টক চিত্র আঁকতে গিয়ে বলেন এক পিতার কথা, যে কি-না তার সন্তানের জন্য দুধ জোগাতে না পেরে ধুতুরা ফুলের নির্যাস খেয়ে আত্মহত্যা করে। এই তো দারিদ্র্য, যা শুধু অভাবের যাতনাই নয় বরং তার চেয়েও বেশি কিছু। গত ১৮ আগস্ট জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার আবদুল মালেক নামে এক দরিদ্র বাবা দারিদ্র্যের কশাঘাত সইতে না পেরে ফুটফুটে দুই সন্তান মুনি্ন (১০) ও মনসুরকে (৫) চুল কাটানোর কথা বলে বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়ে পদ্মার লালন সেতু থেকে নদীতে ফেলে দেয়। মজিদ পুলিশের কাছে সাক্ষ্য দেয়, 'অভাবের সংসার, পেটে ভাত নাই, সন্তান রাখি কী করব, তাই ব্রিজের ওপর নি ফেলি দিছি।' সম্প্রতি একটি টিভি চ্যানেলের চোখে ধরা পড়েছে প্রকাশ্যে বাসস্টেশনে ডেকে ডেকে নিজ সন্তান বিক্রির দৃশ্য। এ দেশের সামাজিক অপরাধের সূচক ঊর্ধ্বমুখী থাকার অন্যতম কারণ এই দারিদ্র্য। একমুঠো ভাতের জন্য অঙ্গহানি করে ভিক্ষাবৃত্তির দৃশ্য এখন সাধারণ।
দারিদ্র্য দূর করার জন্য সামাজিক আন্দোলন আবশ্যক। সচেতনতা, কর্মসৃষ্টি ও উন্নয়নের স্রোতে হতদরিদ্র মানুষকে আনাই হতে হবে লক্ষ্য। সমাজের বিত্তবানদের একটু সদিচ্ছায় আসমানীরা পেতে পারে বই, একটু থাকার জায়গা, একটু বিশুদ্ধ পানি আর জীবনের স্বাদ। প্রতিটি ব্যক্তিকে তার আপন অবস্থান থেকে বাড়িয়ে দিতে হবে আসমানীদের জন্য সাহায্যের হাত। জীবন তাদের কাছেই মূল্যবান যারা জীবনকে মানুষের উন্নয়নে নিঃস্বার্থভাবে বিলিয়ে দিতে পারে।
awalhasan2012@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.