অল্পে তুষ্ট অনন্য এক জাতি by এম আবদুল হাফিজ

ঈদের বিশাল যজ্ঞ নির্বিঘ্নে সামাল দেওয়া অর্থাৎ এ উপলক্ষে ঘরমুখো মানুষের দুর্ভোগমুক্ত যাতায়াতের ব্যবস্থাপনা, তাদের নিরাপত্তা, পথিমধ্যের প্রতারণা, ছিনতাই বা চাঁদাবাজি থেকে তাদের সুরক্ষা প্রদান, পরিবহনের পর্যাপ্ত সরবরাহ, সেগুলোর সিডিউল মোটামুটিভাবে রক্ষা করা; সর্বোপরি মহাসড়ক এবং রেল ও নদীপথের কার্যকারিতা একটি মহাযজ্ঞ বৈকি।


এখন যখন এসব মানুষ আবার জীবিকার তাগিদে রাজধানীতে তাদের কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করেছে, কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্টদের জন্য তা একইভাবে এক গভীর স্বস্তি। প্রার্থনা করি, সুস্থ ও নিরাপদে সবাই ফিরে আসতে পারুন।
তবে এই মহাযজ্ঞের নির্বিঘ্ন সমাপনে যদি কোনো কৃতিত্ব থেকে থাকে, তার সিংহভাগই জনগণের; যারা অশেষ ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে এই ভ্রমণের সব দুর্ভোগকে হাসিমুখে বরণ করে শৃঙ্খলার সঙ্গে ঘরমুখো যাত্রায় অংশ নিয়েছেন। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত লাইন দিয়ে যারা অবশেষে তাদের কাঙ্ক্ষিত টিকিটটি হস্তগত করতে পেরেছেন, নিমিষে তারা সব যন্ত্রণা ভুলে সোনার মেডেলের মতো টিকিটটি উঁচিয়ে যে পরিতৃপ্তির নির্মল হাসিটি দিয়েছেন, তা এককথায় অনবদ্য।
এমন তো নয় যে, তারা ওই টিকিটের জোরে কোনো ঐশ্বর্যের গন্তব্যে যাচ্ছেন। তারা যাচ্ছেন শুধু একটি শিকড়ে, যেখানে আছেন তাদের মাতা-পিতা বা তাদের কোনো একজন; কারও আছে ভাইবোন বা তাদের কোনো একজন; আছে শৈশবের সহচর বা বাল্যবন্ধু এবং তাদের ঘিরে নানা স্মৃতি। শুধু তাদের সংক্ষিপ্ত সাহচর্য পাওয়ার জন্যই এই দুর্ভোগ সত্ত্বেও ঘরমুখো মানুষের এ প্রচণ্ড আকুতি। সেখানে কোনো কিছুর প্রাচুর্য তাদের জন্য অপেক্ষা করে নেই। আসলে তো গ্রামবাংলার কষ্ট, হাহাকার, অভাব-অনটন তাদের কর্মস্থল থেকে অনেক অধিক! এ সবকিছু সত্ত্বেও যারা শিকড়কে ভোলে না এবং তার টান জীবনভর অনুভব করে_ তারাই তো এ দেশের সত্যিকারের মানবসম্পদ।
বরাবরের মতো ঈদ-পার্বণের উৎসবে শত বাধা উপেক্ষা করে এবারও তারা ছুটেছে শিকড়ের টানে। সে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা! গতানুগতিকের মতো এবারও সরকারের কর্তাব্যক্তিদের তৎপরতা তো কিছুটা ছিলই। ওটা থাকতে হয়। না হলে সরকারের অস্তিত্ব প্রকাশ পাবে কীভাবে! কিন্তু ঘরমুখো মানুষের দৃঢ়তা এবং যাত্রাপথের যে কোনো চড়াই-উৎরাই পেরোবার মনোবল তারা পোষণ করেই রেখেছিল। আমার বিশ্বাস, সরকারের কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ ছাড়াই তারা গন্তব্যে পেঁৗছে যেত।
আফটার অল, সরকারি কিছু তর্জন-গর্জন সত্ত্বেও ছিনতাই, চাঁদাবাজি এবং প্রতারণা সমানে চলেছে। যেখানে পেরেছে, ঘরমুখোরাই সেগুলোর মোকাবেলা করেছে। যেখানে পারা সম্ভব ছিল না, সেখানেও তারা মোকাবেলার ঝুঁকি নিয়েছে। তবে ঘরমুখো মানুষের জন্য যোগাযোগমন্ত্রীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সাধুবাদের দাবিদার। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পেছনে ফেলে যাওয়া বাড়িঘরের নিরাপত্তা বিষয়ক পরামর্শ বালখিল্যতার শামিল। ঈদ আসে, ঈদ যায়। কিন্তু মানুষ আল্লাহর এক মহিমান্বিত সম্পদ। এই সম্পদ এবং তাদের অভ্যন্তরটা অক্ষত থাকলেই তা আনন্দের কথা। সংকট-সমস্যা মোকাবেলায় এমনকি ধনী দেশেও কৃচ্ছ্রের একটি ভূমিকা আছে। এ দেশে সক্ষমদের কাছে তার কোনো মূল্য নেই। তারা মনে করে, ওটা দরিদ্রদের করণীয়। তবু আমার মনে হয়, ঐচ্ছিক বা বাধ্যতামূলক কৃচ্ছ্রের ভেতর দিয়েই দরিদ্ররা ঈদের পরিপূর্ণ আনন্দের ভাগীদার হতে সক্ষম হয়, যেটা দেশের এলিটদের ভাগ্যে জোটে না। কেননা, তা তাদের ভোগবাদের পরিপন্থী। ভোগে কখনোই পরিতৃপ্তির স্থান নেই।
বৃহৎ পরিসরেও এই এলিটরাই সমাজ ও দেশের জন্য বোঝা। পক্ষান্তরে আমাদের অগ্রগতি যদি তা কিছুটা হয়ে থাকে, তার নেপথ্য শক্তি আমাদের বৃহত্তর জনগণ; যারা ঘাম ঝরায়, দুর্ভোগকে মোকাবেলা করে তাদের সামান্য সামর্থ্যেই ঈদ করে, উৎসবে লিপ্ত হয়, আবার নাড়ির টানে গ্রামবাংলার স্বজনদের কাছেও ছুটে যায়। এ এক অনন্য জাতি, যার কোনো লয় নেই।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.