জরুরি ভাবনা- ঢাকার গরিবের স্কুলের প্রতি নজর দিন

সব ক্ষেত্রে পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকারের অন্যতম ছিল ২০১২ সালের মধ্যে সব শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা। এই সরকার তার শাসনামলে যেসব সেক্টরে সাফল্য দেখিয়েছে, তার প্রধান ক্ষেত্র হলো শিক্ষাব্যবস্থা।


ম্যাক্রো লেভেলে শিক্ষার সামগ্রিক পরিবর্তনের চিত্র আমাদের যতটা চোখে পড়ে, মাইক্রো লেভেলে ততটা স্পষ্ট নয়। দেশে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের হার বাড়লেও ২০১২ সালের এই সময়ে এসেও সব শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। প্রয়োজনের তুলনায় বিদ্যালয়ের সংখ্যা কম, শিক্ষকদের সমস্যা, অবকাঠামো, বিদ্যালয় পরিচালনায় সুষ্ঠু নীতির অভাব রয়েছে। এই চিত্রটি ঢাকা শহরেও বিরাজমান।
ঢাকা মহানগরে ২৯৬টি সরকারি প্রাইমারি স্কুল রয়েছে। অনগ্রসর, বঞ্চিত ও দরিদ্র পরিবারের সন্তানেরা পড়াশোনা করে বলে এগুলো ‘গরিবের বিদ্যালয়’ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। শহরের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে যতটা আলোচনা ও পরিকল্পনার কথা আমরা শুনি, সরকারি প্রাথমিক স্কুল নিয়ে সে ধরনের আলোচনা বা পরিকল্পনা আমাদের চোখে পড়ে না। এমনকি এসব প্রতিষ্ঠানের সমস্যা গণমাধ্যমেও সেভাবে আসে না। নানা কারণে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পিছিয়ে পড়ছে। একসময় সরকারি ল্যাবরেটরি স্কুলের মতো কয়েকটি সরকারি স্কুলের বার্ষিক ফলাফল সবার নজর কাড়লেও এখন তারা পিছিয়ে পড়েছে। দৃশ্যমান সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি এসব সরকারি স্কুলের প্রতি রাজধানীর সচ্ছল অভিভাবকদের দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অনেক অভিভাবক তাঁদের সন্তানদের এসব প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করতে চান না। তাঁদের ধারণা, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের সন্তানদের সঙ্গে পড়াশোনা করলে তাঁর সন্তানটি উচ্ছন্নে যেতে পারে অথবা তাঁর সামাজিক অবস্থান নাজুক হয়ে পড়তে পারে। আবার এসব প্রতিষ্ঠানে পাঠদানের ক্ষেত্রে কিছু মৌলিক সমস্যা রয়েছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিশ্বের সঙ্গে চলতে গিয়ে ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ক্রমশই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে সে বিষয়ে যথাযথভাবে নজর দেওয়া হয় না। যেমন: কিন্ডারগার্টেনসহ অন্যান্য বেসরকারি বিদ্যালয়ে ইংরেজির ওপর জোর দেওয়া হয়। বেশ কিছু সহপাঠ বইও পড়ানো হয় সেখানে। আর সরকারি প্রাথমিক স্কুলে কেবল বোর্ডের বই পড়ানো হয়। এ জন্য সচ্ছল অভিভাবকেরা সন্তানদের এগিয়ে রাখার জন্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করান।
দেখা গেছে, সন্তানদের নতুন করে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করার ঝক্কি এড়াতেও অনেকের কাছে মাধ্যমিক বা কলেজ স্তর পর্যন্ত রয়েছে এমন প্রতিষ্ঠান প্রথম পছন্দ। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতি এ ‘উপেক্ষা ও বৈষম্য’কে শিক্ষিত ও সচ্ছল জনগোষ্ঠীর ‘মনের দেউলিয়াপনা’ বলা যায়। পত্রিকা মারফত জেনেছি, ঢাকার অনেক স্কুলের শিক্ষক ডেপুটেশনে থাকেন বা শিক্ষক কম থাকায় প্রায় সময় একসঙ্গে দুই শ্রেণীতে ক্লাস নেন একজন শিক্ষক। আবার একই স্কুলে দুই স্কুলের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণ চলছে। প্রতিটি থানায় প্রতিটি স্কুলে রয়েছে শিক্ষকের সংকট। সরকারি প্রাথমিক স্কুলের অধিকাংশ শিক্ষক নারী হওয়ায় মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং তাঁদের এক বছর পিটিআই ট্রেনিং হওয়াও এর প্রভাব পড়ে সবার ওপর। শিক্ষকের স্বল্পতার কারণে শিক্ষকেরা সঠিকভাবে শ্রেণীকক্ষে পাঠদান করতে পারেন না। কারণ, একজন শিক্ষককে সকাল সাতটা থেকে বেলা সোয়া দুইটা পর্যন্ত নয়টি ক্লাস নিতে হয়। এতে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার যেমন ক্ষতি হয়, তেমনি বঞ্চিত হয় মানসম্মত শিক্ষা থেকে। ঢাকার অনেক স্কুলে প্রধান শিক্ষকসহ সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য আছে।
স্কুলে শিক্ষক-সংকটের পাশাপাশি শ্রেণীকক্ষের সংকটেও ভুগতে হয়। যার কারণে অধিকাংশ শিক্ষার্থী সম্পূর্ণ ক্লাস না করেই বাড়িতে চলে যায়। যেমন: ১৯৮৯ সালে রমনা রেলওয়ে হাইস্কুলকে অস্থায়ীভাবে সুরিটোলা প্রাথমিক স্কুলে স্থানান্তরিত করা হয়। সেই থেকে একই স্থানে চলছে দুটি স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম। এভাবে আরও অনেক স্কুলে চলছে একই সঙ্গে দুই স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম। যার কারণে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকেরাও পোহাচ্ছেন নানা ভোগান্তি।
আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর উল্টো চিত্র দেখা যায়। এমনও প্রাথমিক স্কুল আছে, যেখানে শিক্ষার্থীর অনুপাতে শিক্ষকের সংখ্যা বেশি। যেখানে শিক্ষকের প্রয়োজন তিন-চারজন, সেখানে আছেন পাঁচ-ছয়জন। তাঁরা আবার ঠিকমতো স্কুলে উপস্থিত থাকেন না। তাঁদের অন্য স্কুলে বদলি করা যায় না, কারণ তাঁরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাদের মাধ্যমে বা সংশ্লিষ্ট অফিসকে ম্যানেজ করে পোস্টিং নিয়ে থাকেন। এ কারণে কর্তৃপক্ষ চাইলেও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না বা নেয় না।
ঢাকার অনেক স্থানের স্কুলের অবকাঠামো বহু বছরের পুরোনো, বিশেষ করে পুরান ঢাকায়। যেকোনো সময় ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা। জীর্ণশীর্ণ এসব স্কুল জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার করা প্রয়োজন। এ ছাড়া প্রাথমিক স্কুলগুলোতে সরকারিভাবে কোনো আয়া, পিয়ন, দারোয়ান ও নাইটগার্ডের ব্যবস্থা নেই। কিছু কিছু স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির পক্ষ থেকে বিদ্যালয়ে দারোয়ান ও আয়ার ব্যবস্থা করলেও নাইটগার্ড নেই। তাই প্রায় প্রতিদিনই খোয়া যায় টয়লেটের বেসিন, ছুটির ঘণ্টা, আসবাবসহ স্কুলের মূল্যবান অনেক জিনিস।
আমরা ঢাকা শহরের প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সরকারের কাছে কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরছি:
 প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক স্কুলে চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে।
 প্রতিটি স্কুলে পর্যাপ্তসংখ্যক আসবাব, শ্রেণীকক্ষ ও অবকাঠমো নির্মাণ করতে হবে।
 সব শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় আনতে হবে।
 প্রতিটি স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিকে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।
 শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার পাশাপাশি তাদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
 একই স্কুলে একাধিক বিদ্যালয়ের ক্লাস নেওয়া বন্ধ করতে হবে।
 দুর্নীতিগ্রস্ত প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
 প্রাথমিক স্কুলের পরিচালনা পর্ষদকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে।
 লেখকবৃন্দ: মানবাধিকার কর্মী, প্রকৌশলী, আইনজীবী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

No comments

Powered by Blogger.