উন্নয়ন-উড়ালপথের কার্যকারিতা by ফ র আল-সিদ্দিক

যানজট এখন এতটাই অসহনীয় পর্যায়ে উপস্থিত হয়েছে যে, আমরা এর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ঢাকায় একটা উড়ালপথ নির্মাণের কথা চিন্তা করছি। কিন্তু সে সঙ্গে আমরা একবারও ভাবছি না যে, এ উড়ালপথ আমাদের যানবাহনের চলাচল অনেক দ্রুত করে দেবে ভেবে, এই পথটি তৈরি করতে যে কয় বছর সময় লাগবে, সে বছরগুলোতে আমরা আরও অনেক প্রাইভেট গাড়ি
কিনে ফেলব আমাদের দেশে যানজটের প্রধান কারণ হলো এ দেশে গণপরিবহনের চেয়ে ব্যক্তিগত পরিবহনের আধিক্য_ রিকশা ও অটোরিকশা, প্রাইভেট মোটর গাড়ি। রিকশার বাহুল্যের কারণ ছিল, এটি একটি সস্তায় যাতায়াত ব্যবস্থা বলে। এখন মানুষের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় রিকশার সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যাবে। রিকশার ভাড়া বেড়ে যাওয়ার জন্য আগে যারা রিকশায় যাতায়াত করত, তাদের কেউ কেউ এখন বাসে করে যাতায়াত করার কথা ভাবছে। বাস ও মিনিবাসের সংখ্যা বাড়াতে পারলে রিকশার সংখ্যা আরও কমে যাবে। এ দেশে অটোরিকশা ও প্রাইভেট কারের সংখ্যার এ আধিক্যের কারণ হলো_ এক সময় পেট্রোল ও ডিজেলের মূল্য খুব কম ছিল। তাই এসব পরিবহনে যাতায়াত করতে খুব একটা খরচ পড়ত না। তাই এসব পরিবহনের সংখ্যা এত বেড়ে যায় যে, তাতে ভীষণ যানজটের সৃষ্টি হয়। তারপর পেট্রোল ও ডিজেলের দাম যখন বেশ ঘন ঘন বাড়তে শুরু করল, তখন বোঝাই যাচ্ছিল যে, ব্যক্তিগত পরিবহনের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যাবে। তার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে যানজটও ধীরে ধীরে কমতে থাকবে; কিন্তু আমরা যারা জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করে ফুর্তর্ি করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, তারা আমাদের দেশ ও জনগণের একটা মূল্যবান সম্পদকে সিএনজি নাম দিয়ে, সেটিকে পানির দামে, মানে অত্যন্ত স্বল্প মূল্যে বিক্রি করার নিয়ম চালু করে, প্রাইভেট যানবাহনের চলাচলকে অনেক সস্তা করে ফেলি। ফলে প্রাইভেট যানবাহনের সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক অধিক গতিতে বাড়তে থাকে এবং স্বভাবতই যানজটের পরিমাণও সেই একই গতিতে বাড়তে থাকে। এ যানজট এখন এতটাই অসহনীয় পর্যায়ে উপস্থিত হয়েছে যে, আমরা এর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ঢাকায় একটা উড়ালপথ নির্মাণের কথা চিন্তা করছি। কিন্তু সে সঙ্গে আমরা একবারও ভাবছি না যে, এ উড়ালপথ আমাদের যানবাহনের চলাচল অনেক দ্রুত করে দেবে ভেবে, এই পথটি তৈরি করতে যে কয় বছর সময় লাগবে, সে বছরগুলোতে আমরা আরও অনেক প্রাইভেট গাড়ি কিনে ফেলব। ফলে উড়ালপথটি তৈরি হয়ে চালু হতে হতে ঢাকায় প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা হয়তো দ্বিগুণ কিংবা তার চেয়েও বেশি হয়ে যাবে।
তারপর ধরুন আমরা সেদিন উড়ালপথ ব্যবহার করে সাঁ করে মিরপুর থেকে কয়েক মিনিটের মধ্যে গুলিস্তানে চলে গেলাম। তারপর সেখান থেকে নেমে আমি সচিবালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অথবা আমলিগোলায় আমার বাড়িতে যাব। তখন যদি দেখতে পাই, উড়ালপথটির নির্মাণ শুরু হওয়ার আগে রাস্তায় যতগুলো প্রাইভেট গাড়ি ছিল, এখন তার সংখ্যা দু'গুণ কিংবা তার চেয়েও বেশি, কিন্তু ঢাকার বাকি রাস্তাগুলোর প্রশস্ততা একটুও না বেড়ে সেই আগের মতোই আছে, তাহলে কী হবে? এখন আপনিই আমাকে বুঝিয়ে বলুন তো, সেদিন সে অবস্থায় ঢাকার যানজটের অবস্থা আজকের তুলনায় কতগুণ বেশি দুর্বিষহ হবে? তখন, যখন এ দেশের গরিব জনগণ জানবে যে, উড়ালপথটি তৈরি হওয়ার আগে ঢাকা শহরের ভেতরে চলাচল করতে হলে, কাউকে কোনো টোল দিতে হতো না আর এখন উড়ালপথটি তৈরি হওয়ার পর প্রাইভেটকার যাত্রীদের তো উড়ালপথে প্রবেশ করার মুহূর্তে টোল দিতে হচ্ছেই, এমনকি বাস যাত্রীদেরও টোলের জন্য বেশি ভাড়া দিতে হচ্ছে এবং সে সঙ্গে আগের চেয়ে তিনগুণ বেশি যানজট পোহাতে হচ্ছে। এখন আপনি আমাকে বুঝিয়ে বলুন, এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে ঢাকার হাজার হাজার জনগণ একত্র হয়ে তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে হাতুড়ি-বাটাল দিয়ে আমাদের এ সাধের উড়ালপথগুলোকে টুকরো টুকরো করে ফেলতে চাইবে কিনা? অদূর ভবিষ্যতে এ ধরনের একটা কাণ্ড যে হবেই তা বোঝানোর জন্য আমাদের নেহাতই কোটি কোটি টাকা খরচ করে নয়, খর্ব-নিখর্ব কিংবা শঙ্খ-পদ্ম সংখ্যক টাকা খরচ করে এই সাধের উড়ালপথটি তৈরি করার দরকার হবে না। এটি তৈরি করার অনেক আগেই আমাদের গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী মিনি উড়ালপথটি তৈরি করে আমরা এটিকে যখন ব্যবহার করতে শুরু করব, তখনই আমরা বুঝে ফেলব যে, ঢাকার অন্য রাস্তাগুলোকে প্রশস্ত না করে তার ওপর দিয়ে উড়ালপথ নির্মাণ করলে সে উড়ালপথ এ শহরটির যানজট সমস্যার ওপর কী নিদারুণ রকমের বিষময় ফল বয়ে আনে!
ঢাকার মতো, প্রয়োজনের তুলনায় সংকীর্ণ রাস্তাঘাটে পরিপূর্ণ একটা শহরে উড়ালপথ তৈরি করলে সেখানে যানজট কমে না গিয়ে যদি এটা বেড়ে যাওয়ারই আশঙ্কা থাকে তাহলে আমরা গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ীর এই মিনি উড়ালপথটি তৈরি করার পর, ঢাকার যানজটের ওপর তার প্রভাব কী হয়, তা নিরীক্ষণ না করেই যত তাড়াতাড়ি আমরা আমাদের ঢাকার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত এই মেগা উড়ালপথটি তৈরি করার জন্য উঠেপড়ে লাগলাম কেন?
যদি আমরা ওই বিশাল উড়ালপথটা বানিয়ে ফেলতে পারতাম তাহলে সেটাকে তৈরি করার খরচা থেকে, হাত সাফাই করে কিংবা যে বিদেশি কোম্পানি এটা তৈরি করবে, তাদের কাছ থেকে আমাদের গালে মিষ্টি জুতার বাড়ি (ঘুষ) হিসেবে যে টুপাইস আমাদের পকেটে ঢোকাতে পারতাম তা নিয়ে ঢাকার যানজটের ওপর এই উড়ালপথের বিষময় ফলাফল ধরা পড়ার আগেই আমাদের কেউ লন্ডন অথবা ওয়াশিংটনে, আবার কেউ নিউইয়র্ক কিংবা ম্যাসাচুসেটে সটকে পড়তাম। আর সটকে না পড়লেই-বা কী? দোষ যা হওয়ার তা তো সরকারের অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের। কারণ সব সিদ্ধান্ত তো নিয়েছে সরকার। আমরা তো শুধু তাদের কানে কানে কুবুদ্ধি দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করিনি। তাই আমাদের কী দোষ?
বর্তমান রাজনৈতিক সরকারটি খুবই সৌভাগ্যবান। কারণ মেগা উড়ালপথটার তৈরির কাজ শুরু করার আগেই কিংবা তার শতকরা ১০ থেকে ২০ ভাগ কাজ শেষ হওয়ার আগেই বর্তমানে নির্মাণাধীন তিনটি ফ্লাইওভার, একটি ওভার পাস এবং হাতিরঝিল প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে যাবে। আর তার ফলে সে অঞ্চলের যানজট যে পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে, তাতে এ দেশের জনগণ খুব ভালো করেই বুঝে ফেলবে যে, মেগা উড়ালপথটি নির্মাণ করলে ঢাকায় যানজটের পরিমাণ এতই বৃদ্ধি পাবে যে, সেই যানজটের ঠেলায় পুরো ঢাকা শহর একেবারে স্থবির হয়ে যাবে।

ফ র আল-সিদ্দিক :বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা

No comments

Powered by Blogger.