মজেনা বললেন ॥ বিশ্বব্যাংকের ঋণ চুক্তি বাতিল হতাশাব্যঞ্জক-‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত

পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের ঋণ চুক্তি বাতিল হওয়াকে হতাশাজনক বলে মন্তব্য করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজেনা। তবে এ ঘটনার সঙ্গে নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও যুক্তরাষ্ট্রকে জড়িয়ে যা বলা হচ্ছে তা মোটেও সত্য নয় বলে জানিয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।


বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ্মা সেতু বিষয়ে সমস্যা সমাধানে একটি উপায় বেরিয়ে আসবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি। তবে বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যকার এ সমস্যা সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র কোন মধ্যস্থতা করবে না বলে তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন। মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে এমন মন্তব্য করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজেনা। কয়েক সপ্তাহ যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান শেষে বাংলাদেশে ফিরে আসার পর এই প্রথম পদ্মা সেতুর ঋণ চুক্তি বাতিল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন, রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে কথা বলেন মজেনা। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে বিনিয়োগ ও পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উল্লেখ করে তিনি গার্মেন্টস শিল্পে কাজের নিরাপত্তা দেয়া ও শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যার ঘটনা তদন্তের ওপর গুরুত্ব দেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ‘নাক গলায়’ না, বরং বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে ভাল পরামর্শ দেয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। ওয়াশিংটনভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ে প্রকাশিত তথ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অনেকেই উদ্বিগ্ন বলে উল্লেখ করেন তিনি। মাকির্ন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের মানুষের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলোকে শীঘ্রই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে সমঝোতার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমি বাজি ধরে বলতে চাই দলগুলোর মধ্যে সংলাপ হবেই।
মঙ্গলবার বেলা ১১টায় মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ, সিনিয়র সাংবাদিক জহিরুল আলম, এ্যামেরিকান সেন্টারের প্রেস এ্যান্ড ইনফরমেশন প্রধান মেরিনা ইয়াসমিন ও প্রেস এ্যান্ড ইনফরমেশন অফিসার কেলি এস ম্যাকার্থি।
যুক্তরাষ্ট্র বা ইউনূস জড়িত নয়, এইচআরডব্লিউ গুরুত্বপূর্ণ ॥ অনুষ্ঠানে পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্¦ব্যাংকের চুক্তি বাতিল, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে সরকারের ঘোষণা এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন নিয়েই বেশি প্রশ্ন রাখা হয় মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজেনার কাছে। খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক এ চুক্তি বাতিলকে ষড়যন্ত্র এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন প্রসঙ্গে ‘যুক্তরাষ্ট্রের নিজেদের অবস্থান কি’, ‘১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতিবাচক ভূমিকা’ এবং ‘বঙ্গবন্ধু হত্যায় সিআইএ’র যোগাযোগ ছিল’Ñ দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এসব মন্তব্য নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে তাঁদেরই জিজ্ঞেস করা ভালÑ তারা কি ভাবছেন। স্বাধীন দেশে যে যার মতামত দিতেই পারেন। এ নিয়ে কোন মন্তব্য করতে চাই না। তবে হিউম্যান রাইটসের মতো এনজিওগুলোকে মার্কিন সরকার গুরুত্ব দেয়। কারণ তারা সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তাদের প্রতিবেদন প্রকাশের পর বাংলাদেশ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের অনেকেই ভীষণ হতাশা প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, র‌্যাবের অভ্যন্তরীণ তদন্ত পদ্ধতি এবং বিচারব্যবস্থার উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য করতে চায়।
পদ্মা সেতু নিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জন্য পদ্মা সেতু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে পদ্মা সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত। চুক্তি বাতিল হওয়ায় আমি হতাশ। বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ দুই পক্ষকেই নিজেদের প্রয়োজনে এ বিষয়ে সমঝোতার মাধ্যমে সমাধানের পথ বের করে আনতে হবে। বিশ্বব্যাংক না বাংলাদেশ কার অবস্থান সঠিক- এ বিষয়ে ড্যান মজেনার মূল্যায়ন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি সাক্ষ্য প্রমাণ কিছু দেখিনি। তাই এর পেছনের ঘটনা সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই। কানাডা বিষয়টি তদন্ত করছে। আমি মনে করি, যে কেউ গুগলে সার্চ দিয়ে এ বিষয়ে তথ্য পেতে পারেন। এ বিষয়ে আরও কিভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হতে পারে তা নিয়ে আমি দ্বিধাগ্রস্ত। তবে আমি আশাবাদী কোন একটি উপায় বেরিয়ে আসবে।
সমস্যা সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র কোন ভূমিকা রাখবে কি না প্রশ্ন করা হলে ড্যান মজেনা বলেন, বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের এ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র কোন অংশীদার নয়। তাই যুক্তরাষ্ট্র এ ঘটনায় কোন ভূমিকা রাখবে না।
গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকারের সঙ্গে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরূপ সম্পর্ক, এ বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুরোধ সত্ত্বেও সরকার কোন সমঝোতায় না আসায় যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাংকের চুক্তি বাতিলে ভূমিকা রেখেছে এমন সমালোচনার জবাবে ড্যান মজেনা বলেন, একটি স্বাধীন দেশে যে কেউ যা কিছু বলতে পারে। তবে এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউনূস জড়িত এ তথ্যটি খুবই ভুল। একদমই ভুল।
আমিনুল হত্যার ঘটনায় বিনিয়োগকারীরা উদ্বিগ্ন ॥ মাকিন রাষ্ট্রদূত জানান, যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে তিনি সিভিল সোসাইটি, বিনিয়োগকারী, স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তা, মন্ত্রীদের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। প্রতিক্ষেত্রেই বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বড় বাজার। বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্পের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী। তিনি বলেন, ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে আরও বেশি পণ্য কিনতে চান। এমনকি সেখানে বাংলাদেশী মার্কিন নাগরিকরা মাতৃভূমিতে বিনিয়োগে আগ্রহী। তবে তাঁদের মতে, বাংলাদেশে বিনিয়োগ সহজ নয়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ। এছাড়া ক্রেতারা বাংলাদেশের কাজের পরিবেশ ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। গত এপ্রিলে শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম নিহত হওয়ার ঘটনায় তারা বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ক্রেতারা বাংলাদেশী পণ্য কিনতে চান। কিন্তু তারা তাদের সুনাম ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে চান না। অনেকে গ্রামীণ ব্যাংক পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আমার কাছে। বাংলাদেশ সফরে এসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন তাদের উদ্বেগ সম্পর্কে জানিয়ে গেছেন। আমি বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, এফবিসিসিআই প্রত্যেক সংস্থাকেই যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের এ বার্তা পৌঁছে দিয়েছি। সরকারকে আলোচনার মাধ্যমে এ ইস্যুটি সমাধানে উপায় খুঁজে বের করতে বলেছি।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার এ্যান্ড কংগ্রেস অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্গানাইজেশনস (এফএলসিআইও) শ্রমিক পরিস্থিতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্য প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করতে চায়। তারা এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে আবেদনও করেছে। চলতি বছরই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গেলে তা বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সংলাপ হবেই ॥ মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, খুব সহজ না হলেও আগামী নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করতে রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনার মাধ্যমে একটি পদ্ধতি বের করতেই হবে। আমি প্রধান প্রধান সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরাও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চান। এ দেশ গণতন্ত্রমুখী। গণতন্ত্রই এ দেশের সংস্কৃতি। এ দেশের প্রতিটি লোকই চায় অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হোক। দেশের স্বার্থেই প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে সমাধানে আসতে হবে। কারণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থাকলে এ দেশে বিদেশী বিনিয়োগ আসবে না। অনেকেই প্রশ্ন রাখেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কখন সমঝোতা হবে? আমি মনে করি আজ-কাল-পরশু যেকোন দিন যেকোন মুহূর্তে এই সমঝোতা হতে পারে। আমি এ বিষয়ে বাজি ধরতেও রাজি যে, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ হবেই।
এদিকে বাংলাদেশকে তার মানবিক সংস্কৃতি অনুযায়ী এবং ১৯৭১ সালের অভিজ্ঞতাকে স্মরণে রেখে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন ড্যান মজেনা।

No comments

Powered by Blogger.