অভ্যন্তরীণ বিষয় by ইকবাল আজিজ

প্রত্যেকটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের এমন কিছু অভ্যন্তরীণ বিষয় আছে- যা নিয়ে অন্য রাষ্ট্রের নাক গলানো মোটেই প্রত্যাশিত নয় এবং বৈধ নয়। এসব হলো সেই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ যাবতীয় বিষয়ে ঘরোয়া সিদ্ধান্ত। প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচিত সরকার এসব ঘরোয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অধিকার সম্পন্ন; জনগণ ভোটের মাধ্যমে সেই দেশের


নির্বাচিত সরকারকে এই অধিকার দিয়েছে। কিন্তু কিছু গরিব অভাবী পরিবারের ক্ষেত্রে মাঝে সাঝে যা হয়; অনেক সময় আশপাশে বিত্তবান ক্ষমতাশালী পরিবার তাদের পারিবারিক বিষয়ে যা খুশি তাই মন্তব্য করে- যার ফলে সেই পরিবারের মানসম্মান অনেক সময় ক্ষুন্ন হয়; আত্মমর্যাদাবোধ ধুলায় লুটিয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের যেন অনেকটা সেই অবস্থা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে গভীর আত্মত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশটি অনেক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যখন স্বনির্ভরতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে- ঠিক তখনই কারও কারও গায়ে বাংলাদেশের এ সাফল্য যেন কাঁটার মতো বিঁধছে। কেউ কেউ চায়, বাংলাদেশ যেন চিরকালই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নতজানু হয়ে থাকে। শকুনের দোয়ায় অনেক সময়ই গরু মরে না। কেউ খুশি হোক বা না হোক, স্বাধীনতার চার দশক পরে অদম্য বাংলাদেশ বিশ্বসভায় মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। সমস্যার অন্ত নেই, দেশের বাইরে ও ভেতরে অনেক প্রতিকূল শক্তি; তবু সুকান্তের ভাষায়- ‘এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে মরে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ এই হলো একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শুরুতে বাংলাদেশ। মনে হয়, একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে নিউইয়র্কে আয়োজিত কনসার্টে জর্জ হ্যারিসন ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ বলে যে গানটা গেয়েছিলেন, তা একেবারে বৃথা যায়নি। এত প্রতিকূলতা ও সমস্যার মধ্যেও বাংলাদেশ বুক উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। ঠিক এমনই মুহূর্তে কোন কোন দেশ কিংবা আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণকে অপমান করতে চাইছে; দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নানা ধরনের আপত্তিকর উক্তি করছে।
তবে সময় পাল্টে গেছে, দেশের জনগণ এখন আর আগের মতো অচেতন নয়। তারা আন্তর্জাতিক সংস্থার এ ধরনের আচরণের জন্যে ক্ষুব্ধ ও অপমানিত। অনেকেই মনে করে যুক্তিহীনভাবে বাংলাদেশকে অপমান করার পেছনে নিশ্চয়ই কোন রহস্য আছে। গোটা বিষয়টি আসলে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। ইতোমধ্যে দুর্নীতির মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঋণচুক্তি বাতিল করেছে। তারপর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ বাংলাদেশ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ সম্পর্কে নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশন করেছে। ইতোমধ্যে অনেকেই এ প্রতিবেদনকে গভীর ষড়যন্ত্রমূলক ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ’ বলে অভিহিত করেছেন।
উল্লেখ্য, মাত্র ক’দিন আগে নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ ঢাকায় ব্র্যাক সম্মেলনে যে প্রতিবেদন উপস্থাপিত করেছে, তাতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কিছু মন্তব্য করা হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাটি বিডিআর বিদ্রোহের বিচার প্রক্রিয়াকে ‘গণবিচার’ আখ্যা দিয়ে অবিলম্বে তা স্থগিতের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। তারা এসব অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য একটি স্বাধীন টাস্কফোর্স গঠনের দাবি করেছে। একই প্রতিবেদনে এ মানবাধিকার সংস্থাটি বাংলাদেশে অপরাধ দমনের দায়িত্বে নিয়োজিত ‘র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র‌্যাব)’ ভেঙ্গে দিয়ে পুলিশের মধ্যে একটি অসামরিক ইউনিট গঠনের প্রস্তাব করেছে। নিউইয়কভিত্তিক এই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাটিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এভাবে নাক গলানোর অধিকার কে দিয়েছে? তারা বাংলাদেশের রাজধানীতে একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এভাবে ‘প্রতিবেদন’ প্রকাশের অধিকার কিভাবে পেল? এ কাজে তারা বাংলাদেশে কাদের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা পেয়েছে? এসব প্রশ্ন দেশের অনেক সচেতন মানুষের মনে জেগেছে। ইতোপূর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার যেভাবে বিডিআর বিদ্রোহের মোকাবিলা করেছে তা দেশ-বিদেশে সর্বত্র প্রশংসিত হয়েছে। বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় অভিযুক্ত জওয়ানদের বিচার প্রক্রিয়া বিষয়ে ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ যেভাবে প্রশ্ন উত্থাপন করেছে তা শুধুমাত্র আপত্তিজনক নয়, বরং নিন্দনীয় অপরাধ। তাদের মন্তব্য দেশের প্রচলিত আইন সম্পর্কে জনগণের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে। একইসঙ্গে এর ফলে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে সারাবিশ্বেই একটি ভুল ধারণার সৃষ্টি হবে। কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা কি এভাবে আমেরিকা, ব্রিটেন কিংবা ভারতের বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে মন্তব্য করতে সাহস পাবে? বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ বলেই কি তারা বিডিআর বিদ্রোহের বিচার নিয়ে এভাবে মন্তব্য করতে সাহসী হয়েছে? বিডিআর বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন জওয়ানদের বিচার খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। এর সঙ্গে বাংলাদেশের সামরিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও জাতীয় স্বার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশের একান্ত অভ্যন্তরীণ বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার এ ধরনের বক্তব্য অবশ্যই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ’ এই বক্তব্যকে ভিত্তিহীন, অযৌক্তিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিহিত করেছে। এছাড়া বিচার প্রক্রিয়া ‘স্থগিতের দাবি’ নিঃসন্দেহে গভীর রহস্যজনক ও ষড়যন্ত্রমূলক। এ ধরনের দাবির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাটি মূলত মানুষের বিচারের অধিকার ও মানবতাকেই অপমান করেছে। এছাড়া একটি বিষয় ভুললে চলবে না, বর্তমানে দেশব্যাপী একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে; ঠিক সে মুহূর্তে দেশের বিচারব্যবস্থাকে বিতর্কিত করার উদ্দেশ্য কী? ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’-এর এই প্রতিবেদন তৈরির মূল উদ্দেশ্য এবং এসবের সঙ্গে কারা জড়িত তা অবশ্যই খুঁজে বের করা দরকার।
এছাড়া বাংলাদেশে অপরাধী দমন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বিশেষ বাহিনী ‘র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন’ বা র‌্যাব থাকবে কি-না তা দেখার অধিকার কে এই আন্তর্জাতিক সংস্থাকে দিয়েছে? র‌্যাব বিষয়ে হিউম্যান রাইটসের রিপোর্ট নিঃসন্দেহে বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। বিডিআর বিদ্রোহের সঙ্গে র‌্যাবের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
এছাড়া র‌্যাব বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার তদন্তের দায়িত্বেও নিয়োজিত নয়। বাংলাদেশ যেন বিদেশী কূটনীতিকদের ইচ্ছেমতো বক্তব্য উপস্থাপন ও বিচরণের মুক্তাঙ্গন। যে কোন জাতীয় সঙ্কটে দেশের দু’টি রাজনৈতিক দলের চেয়ে ঢাকায় অবস্থিত ‘বিদেশী কূটনৈতিকদের’ তৎপরতা ও ছুটে বেড়ানো যেন প্রায়শই মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। ‘সাদা চামড়ার মানুষ’ দেখলে এখনও যেন ভয়ে সঙ্কুচিত হয় বাঙালী বিদ্বজ্জনরা। এসব হীনম্মন্যতা ও অসচেতনতার কারণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বিদেশীদের নির্লজ্জ নাক গলানো এতটা বেড়েছে। তবে এবার হয়ত হিউম্যান রাইটসের আচরণ মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। তারা হয়ত বুঝতে পারেনি বাংলাদেশের এখন আগের তুলনায় সচেতনতা ও মর্যাদাবোধ অনেক বেড়েছে। তাই হয়ত ব্যাপারটি সামাল দিতেই মাঠে নেমেছে বাংলাদেশের অন্য এক মানবাধিকার কর্মকর্তা। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, ‘র‌্যাব কিংবা অন্য কোন বাহিনী থাকবে কি-না সেটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। দেশের কোন সংস্থা নিয়ে কোন আন্তর্জাতিক সংস্থা হয়ত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু কোন বাহিনী বিলুপ্ত করা বা ভেঙ্গে দেয়ার কথা বলতে পারে না।’ যাই হোক বাঙালীর একান্ত নিজস্ব আত্মমর্যাদাবোধ আরও জাগ্রত হোক এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
বাংলা ভাষা বিশ্বের পঞ্চম সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষা; বাঙালী বিশ্বের অন্যতম সেরা সৃজনশীল, মেধাবী, সুশিক্ষিত ও সভ্য জাতি। কেবল দেশপ্রেম ও সেক্যুলার জাতীয়তাবাদ সব আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে বাঙালীকে শক্তি জোগাবে, সাহস জোগাবে। পদ্মা সেতু প্রসঙ্গ থেকে বিশ্বব্যাংকের বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ‘পিঠটানের পর’ বঙ্গবন্ধুর যোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের যে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন- তার সঙ্গে সবাইকে এক হতে হবে। পরনির্ভরতা কাটিয়ে বাঙালীকে প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বনির্ভর হতে হবে বিশ্বায়নের এ ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতার যুগে এই পথই বাঁচার একমাত্র পথ। বাঙালীকে আবার দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হতে হবে।
iqbalaziz.poet.@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.