ক্লাসের বাইরে ক্লাসের পড়া by মাতলুবা খান

আসুন, একটা পড়ার ঘর চিন্তা করি, যার ছাদ হলো নীল আকাশ, পায়ের নিচে শীতল মাটি, যে ঘরে কোনো দেয়াল নেই, নেই কোনো পড়ার বেঞ্চি! যেখানে খুদে বিজ্ঞানী গভীর মনোযোগ দিয়ে পিপীলিকার বাসার তত্ত্ব তালাশ করে, গণিতবিদ হাসি হাসি মুখে বৃষ্টি মাপে, উঠতি লেখক হঠাৎ করেই লেখার উপকরণ খুঁজে পায় আর অভিনেতা প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চে আপন মনে অভিনয় করে!


যেখানে ফুল, পাখি আর গাছ প্রতিদিন সবার বন্ধু হয়ে যায়! এই ঘরে, অভিভাবকেরা পরস্পরের কাছ থেকে টিপস নেয়, পড়শি হয় তো একটু থামে, কুশলাদি জানে আর শিক্ষকেরা প্রথাগত বাক্সের বাইরে চিন্তা করে সৃষ্টিশীল...
এই আশ্চর্য সুন্দর ঘটনাগুলো তখনই সম্ভব হয়ে ওঠে, যখন স্কুলের সামনের খোলা জায়গাটায় একটা শ্রেণীকক্ষ, ইংরেজিতে বললে আউটডোর ক্লাসরুম বানানো যায়!
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, স্কুলবয়সী (৬ থেকে ১১ যাদের বয়স) ছেলেমেয়েরা সবচেয়ে ভালো শিখতে পারে, যখন তাদের সত্যিকারের উপকরণের পরীক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে শেখানো যায়।
আমাদের দেশে শিক্ষার কথা বলতে গেলে সিলেবাস, শিক্ষকের পাঠদান, বই বিতরণ নিয়ে অনেক কথা হয়, কিন্তু যে পরিবেশে শিশুরা শিক্ষা লাভ করে, সেই স্কুল ভবন ও তার চারপাশের পরিবেশ আলোচনা থেকে সবসময় অনুপস্থিত থাকে। অথচ যেকোনো কিছুর ক্ষেত্রে পরিবেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ; কারণ, মানুষ যে পরিবেশে বাস করে সেই পরিবেশ মানুষের আচার-আচরণ ও শিক্ষার ওপর বিরাট প্রভাব ফেলে। আমাদের দেশে শিক্ষার পরিবেশ বলতে শুধু ক্লাসরুমকেই বোঝানো হয়! অথচ বিদ্যালয়ের বাইরে প্রকৃতি যে বিপুল ঐশ্বর্য নিয়ে পাঠদানের সুনিপুণ পরিবেশ তৈরি করে আছে, এই ব্যাপারটা অনেক সময়ই গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয় না! শহরের স্কুলগুলোতে জায়গার স্বল্পতার জন্য অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের বাইরের পরিবেশে পড়ানো সম্ভবপর হয়ে ওঠে না; কিন্তু গ্রামের বেশির ভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে অনেকটা খোলা জায়গা থাকে! অনেক স্কুলে দেখা যায় ছোট ক্লাসরুমে অনেক বেশি ছাত্র নিয়ে ক্লাস চলছে, সবাই বসার পর্যাপ্ত জায়গা পাচ্ছে না! স্কুলের খোলা জায়গাকে শুধু টিফিনের সময় খেলার জায়গা হিসেবে না ভেবে খুব সহজেই স্বল্প খরচে বাইরের শ্রেণীকক্ষ হিসেবে কাজে লাগানো যায়! গবেষণা থেকে জানা যায়, যে বয়সী শিশুরা প্রাথমিক স্কুলে যায়, তারা ঘরের চেয়ে বাইরে সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করে। ঢাকা শহরের বেশ কয়েকটি স্কুলের ওপর করা এক সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে, স্কুল ভবনের বাইরের পরিবেশই বাচ্চাদের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। তাছাড়া, বাইরের শ্রেণীকক্ষে বাচ্চারা যেসব বিষয় বইয়ে পড়ে, তা-ই সরাসরি প্রকৃতিতে দেখে হাতে-কলমে আরও ভালোভাবে শিখতে পারে। কোন মাটি বেলে বা দোআঁশ অথবা কোনটা একবীজপত্রী বা দ্বিবীজপত্রী গাছ, তা শেখার জন্য বাইরের শ্রেণীকক্ষই হতে পারে সবচেয়ে উপযোগী জায়গা।
বুয়েটে স্থাপত্য বিভাগের মাস্টার্স থিসিসের অংশ হিসেবে সম্প্রতি নরসিংদীর রায়পুরায় কান্দাপাড়া শহীদ বশিরুল ইসলাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি বাইরের শ্রেণীকক্ষ বানানো হয়! পরবর্তী সময়ে প্রকৃতির কাছাকাছি এই বাইরের শ্রেণীকক্ষে পাঠরত শিশুদের ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, বাইরের ক্লাসে পড়ানোর পর তারা তাদের বিজ্ঞান বিষয়ের পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাচ্ছে! শিশুরা বাইরের ক্লাসে থাকতে বেশি পছন্দ করে, সেখানে তারা অনেক বেশি মনোযোগী হতে পারে, পড়ার প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায় বহু গুণ। স্কুলের শিক্ষকদের মতে, ক্লাসরুমের চেয়ে বাইরের ক্লাসে শিক্ষকেরা পড়াতে বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করেন, নানান রকম পদ্ধতি প্রয়োগ করে খেলাচ্ছলে শিক্ষা দেওয়া যায়, শিশুরা ক্লাসে অনেক বেশি অংশগ্রহণ করে। ক্লাসরুমের ভিড়ে, গ্রীষ্মের গরমে অতিষ্ঠ হওয়া অপর্যাপ্ত আলোতে ঠিকমতো বই বা ব্ল্যাকবোর্ড দেখতে না পাওয়া শিশুরা তাদের বাইরের ক্লাসে খোলা হাওয়ায় স্পষ্ট দিবালোকে পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে ক্লাসের পড়ায় অংশগ্রহণ করে বেশি শিখছে ও পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাচ্ছে! এ শ্রেণীকক্ষ নির্মাণের নানা কাজে শিশুদের সক্রিয় অংশগ্রহণ তাদের মধ্যে একটা মালিকানাবোধ তৈরি করে, যার ফলে এই জায়গার পড়ার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ বেশি, রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও ওরা নিজেরাই নেয়!

No comments

Powered by Blogger.