বায়োগ্যাসে প্রাইভেটকার সেচ পাম্প চলছে, সিএনজির বিকল্প!-নীলফামারীর আবু সুফিয়ানের সাফল্য by তাহমিন হক ববি

জীবনের প্রাত্যহিক প্রয়োজনগুলো আরও সহজে মেটানোর জন্য তৃণমূলে চলছে বহু রকম গবেষণা। বিদ্যুত, জ্বালানি আর জৈব সারের চিন্তা থেকেই বায়োগ্যাস, সেখান থেকেই সিএনজি। আবু সুফিয়ান এই প্রকল্পটি একটি মডেল। এই প্লান্টটিই হতে পারে অনুসরণীয়।


আমাদের দেশে দিন দিন বাড়ছে জৈব সারের চাহিদা; সে সঙ্গে জ্বালানি হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রয়োজনীয়তার কথা তো বলাই বাহুল্য। আর দেশের লাখ লাখ যানবাহনের সবচেয়ে লাভজনক জ্বালানি সিএনজি দিয়ে।
প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা পূরণ করতে পারে পরিবেশবান্ধব বায়োগ্যাস। বিশেষ করে সর্বোত্তরের নীলফামারীর গ্রামে বায়োগ্যাস রূপান্তরিত হয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাসে। যাকে আমরা সিএনজি বলি। সিএনজিতে বায়োগ্যাস বড় ধরনের সাফল্য এনে দিতে শুরু করেছে। যা প্রাকৃতিক গ্যাসের বিকল্প হতে পারে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন ও কৃষকের লাভবান হওয়ার কথা আমরা জানি। গ্রামে বায়োগ্যাসের প্রচলন অনেক আগেই শুরু হয়ে যায়। রান্নার কাজে এই বায়োগ্যাসের সঙ্গে সকলে পরিচিত। এমনকি সিএনজিচালিত সেচ পাম্প চালানো ও বিদ্যুত সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু এখন এটি আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছে। এই বায়োগ্যাস দিয়ে এখন নীলফামারীর ডিমলা উপজেলায় চালানো হচ্ছে সিএনজিতে রূপান্তর করে। ফোর স্ট্রোক প্রাইভেটকার। বাড়ির ব্যবহৃত বায়োগ্যাসে টেস্ট প্যানেল থেকে ৩ মাসের মধ্যে ৪ লাখ টাকা ব্যয় করে ডিমলার পশ্চিম খড়িবাড়ী গ্রামের আবু সুফিয়ান (৩৫) এ সাফল্য দেখিয়েছেন। তার উদ্ভাবন ও প্রয়াস সাড়া জাগিয়েছে গোটা এলাকায়। এলাকাবাসী এখন বিশ্বাস করেছে এখান থেকে একদিন ঠিকই তাদের নানা ধরনের চাহিদা পূরণ হবে। এটি মডেল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু মানুষের আশা বাড়িয়ে দেয়া এই প্রকল্পকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন অনেক অনেক অর্থের। সুযোগ-সুবিধা পেলে বায়োগ্যাস প্লান্টের গ্যাস সিএনজি-সিলিন্ডারে বিক্রি করাও সম্ভব হবে। এতে প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রতিদিনের চাহিদা পূরণে যেমন কিছু অংশের যোগানদার হতে পারে, অন্যদিকে জৈব সার উৎপাদনেও আমরা এগিয়ে যেতে পারি বেশ খানিকটা পথ।
যুগ-যুগ ধরে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে রান্নাবান্নার কাজে কাঠ, খড়-কুটা, নাড়া, শুকনো গোবর এগুলোই জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। বর্তমানে প্রতিবছর দেশে ৩ কোটি ৯০ লাখ মেট্রিক টন এ জাতীয় জ্বালানির প্রয়োজন। জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহারের ফলে গাছপালা উজাড় হয়ে যাচ্ছে, যার ফলে আমরা শুধু বনজ সম্পদই হারাচ্ছি না, আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশকে ঠেলে দিচ্ছি এক ভয়াবহ অবস্থার দিকে। অন্যদিকে গোবর, নাড়া এবং অন্যান্য পচনশীল পদার্থগুলো পুড়িয়ে ফেলার ফলে আবাদি জমি জৈব সার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জ্বালানি সঙ্কট তীব্রতর হচ্ছে। এই জ্বালানি সঙ্কট মোকাবেলায় বিকল্প জ্বালানি হিসেবে বায়োগ্যাসই একমাত্র এই সমস্যার সমাধান দিতে পারে এবং নিশ্চিত করতে পারে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ উন্নতমানের জৈব সার, পরিচ্ছন্ন জ্বালানি ও উন্নত জীবনযাত্রা।
২০০৪ সালের ভারতের আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাব বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পাস করা আবু সুফিয়ান জানান, উত্তরাঞ্চলের বিশেষ করে রংপুর বিভাগের আট জেলায় প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা পূরণ করতে পারে পরিবেশবান্ধব বায়োগ্যাস। বর্তমানে তার ব্যবহৃত বায়োগ্যাসের প্লান্টে প্রতিদিন ১৮টি গরুর বর্জ্য থেকে ১০ কিউবিক মিটার গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে। এছাড়া বাড়িতে বিদ্যুত ও গ্যাসে রান্নার কাজ চলছে। বর্তমানে যে পরিমাণ গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে তাতে ৩ হুইলার ৬টি সিএনজি কার চালানো সম্ভব। সুফিয়ান জানান, তিনি ২০১১ সালের ভারতে গিয়ে সেখানকার ছোট ছোট বায়োগ্যাস প্লান্ট পরিদর্শন করেন। সেখান থেকে অনেক কিছু জেনে ও শিখে আসার পর নিজ গ্রামের বাড়িতে এই ধরনের প্লান্ট স্থাপন করে সফল হোন।
তিনি জানান, ১০০টি গরুর বর্জ্য দিয়ে বায়োগ্যাস প্লান্ট করলে সিএনজির গ্যাস, ১শ’ বাড়িতে বিদ্যুত ও ১শ’ পরিবারের রান্না করা সম্ভব। বায়োগ্যাসের এ প্লান্টটি ব্যবহারের জন্য দরকার প্রচুর অর্থ। গরুর বর্জ্য বায়োগ্যাসের পরিশিষ্ট উন্নতমানের জৈব সার হিসেবে ব্যবহার হয়। যে কারণে সরকারের রাসায়নিক সারের ওপর চাপ কমবে। তিনি বলেন, ব্যাংকের ঋণ দিয়ে ডেইরি ফার্ম স্থাপন করে সেখানে বায়োগ্যাসের প্লান্ট ও সিএনজি গ্যাসের সিলিন্ডার স্থাপন করলে সম্ভব হবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা। বুয়েট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন জানান, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বায়োগ্যাসের প্লান্ট করতে পারলে দেশের জ্বালানির ওপর চাপ কমবে। তিনি বলেন, দেশে গরু পালনের সরকারীভাবে ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাচ্ছে। রংপুর অঞ্চলে কবে প্রাকৃতিক গ্যাস লাইন যাবে তাও অনিশ্চিত। তাই বায়োগ্যাসের প্লান্ট বড় আকারের করতে পারলে রংপুর অঞ্চলের জেলাগুলো বায়োগ্যাসের মাধ্যমে সিএনজিতে রূপান্তর প্রাইভেটকারসহ বিভিন্ন যানবাহন চলতে পারবে। দেশের ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব। তিনি আরও বলেন, সরকারের খাস জমিতে স্থানীয় উদ্যোক্তার মাধ্যমে এ খাতে সহযোগিতা ও ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে বেকার যুবকরা স্বাবলম্বী হতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেন।
বায়োগ্যাস হলো পচনশীল জৈববস্তুসমূহ হতে তৈরি গ্যাস। সব প্রাণীরই মল হতে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে এ গ্যাস তৈরি করা যায়। পশুর গোবর ও অন্যান্য পচনশীল পদার্থ বাতাসের অনুপস্থিতিতে পচানোর ফলে যে গ্যাস তৈরি হয় তাই হচ্ছে বায়োগ্যাস। তবে গৃহপালিত বা বাণিজ্যিকভাবে পালিত পশুপাখি এবং মানব মল সহজলভ্য বলে এগুলোই বেশি ব্যবহার করা হয়। এ জাতীয় গ্যাসে অধিকাংশ পরিমাণই থাকে মিথেন গ্যাস। বায়োগ্যাস উৎপাদনের পর অবশিষ্ট আবর্জনাটুকু উত্তম জৈব সার হিসেবে বেশ কার্যকরী।

No comments

Powered by Blogger.