কার কান্না কে কাঁদে by আসিফ আহমেদ

কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক অ্যাঙ্গেলস কমিউনিস্ট ইশতেহার শুরু করেছিলেন এ লাইনটি দিয়ে_ ইউরোপ ভূত দেখেছে, কমিউনিজমের ভূত দেখেছে। সে সময়ে পুঁজিবাদের কেন্দ্র ছিল ইউরোপ। যুক্তরাষ্ট্র তখনও বিশ্বশক্তি হয়ে ওঠেনি। সেখানকার পুঁজিপতিরা কেবলই নিজেদের গুছিয়ে নিতে শুরু করেছে। ক্রমে দৃশ্যপট বদলে যেতে থাকে।


শ্রমিকরা দিনে ৮ ঘণ্টা কাজের অধিকার দাবি করলে তাদের ওপর গুলি চলে যুক্তরাষ্ট্রে। এখন গোটা বিশ্বে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি আদায়ের ঐতিহাসিক আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে পহেলা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস পালিত হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এ দিবসটিকে বড় ভয়। তাই তারা পহেলা মে নয়, বছরের আরেকটি দিন শ্রম দিবস হিসেবে পালন করে। শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নকে কমিউনিস্ট তৈরির কারখানা বলেই তারা মনে করেছে।
এখন রাশিয়ায় কমিউনিজম নেই। ইউরোপের দেশগুলো থেকেও তারা বিতাড়িত। এশিয়ার চীনেও তারা কেবল নামেই কমিউনিস্ট। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিপিএমকে ক্ষমতা থেকে সরালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন তাকে ব্যক্তিগতভাবে অভিনন্দন জানানোর জন্য কলকাতায় হাজির হয়েছিলেন।
বাংলাদেশে শ্রমিকদের সমিতি করার অধিকার ইস্যুতে সুর বদলও কি নতুন প্রেক্ষাপট নির্দেশ করে? গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক উপ-সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলিশা অ্যারেশা বাংলাদেশ সচিবালয়ে প্রবাসী কল্যাণ, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও শ্রমমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে যথাযথ অধিকার প্রদান না করার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এ সময় ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্রদ্বদূত সাংবাদিকদের বলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্র্র ঘুরে বাংলাদেশে ফিরেছেন। সেখানে বাংলাদেশি পণ্যের ক্রেতাদের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে শ্রমিকদের সমিতি করার অধিকার নিয়ে উদ্বেগ বেশি। এ কথাই তারা বৈঠকে শ্রমমন্ত্রীকে জানিয়েছেন। বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যপুষ্ট শ্রমিক সংগঠন ওয়ার্কার্স সলিডারিটির কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের ইস্যুটিও আলোচিত হয় বলে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জানান। শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যার বিচারের ব্যাপারে জোরালো দাবি জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন।
রাষ্ট্রদূত মজিনা বলেন, শ্রম অধিকারের ইস্যুর আঙ্গিকে বাংলাদেশকে দেওয়া বিশেষ বাণিজ্য সুবিধা জিএসপি এবং প্রস্তাবিত বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত চুক্তি টিকফার ইস্যুও বৈঠকে আলোচিত হয়।
তিনি বলেন, শ্রম অধিকারের ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রে ক্রেতারা খুবই চিন্তিত। শ্রমিকরা যাতে অবাধে সমিতি করতে পারে সে ইস্যুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমিতি করার অধিকারের সঙ্গে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা প্রাপ্তির বিষয় জড়িত। এসব ইস্যুর নিষ্পত্তি চায় যুক্তরাষ্ট্র।
বাংলাদেশের ট্রেড ইউনিয়নের অনেক নেতা বহু বছর রাশিয়া ও অন্যান্য কমিউনিস্ট দেশের শ্রমিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। যুক্তরাষ্ট্র তাতে নাখোশ ছিল। এখন তাদের সুর বদলে গেছে। তারা বাংলাদেশের অনেক শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে এবং তারা আর বিপ্লবের পথে যাবে না বলে মনে করছে। আর দীর্ঘদিন এ দেশের যে ধনবান শ্রেণীকে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের 'নো ট্রেড ইউনিয়ন' নীতির সমর্থক হিসেবে দেখেছি তারা এখন অন্য সুরে কথা বলছে। তারা ট্রেড ইউনিয়নকে ভয় পায়। কথায় কথায় শ্রমিকদের নৈরাজ্যবাদী বলে অপবাদ দেয়। কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেয়। পুলিশ দিয়ে শ্রমিকদের ঠেঙায়। সরকার শ্রমিকদের দমনে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ তোলে। যুক্তরাষ্ট্র এখন ইউনিয়ন গঠনের অধিকারের জন্য কান্না জুড়ে দিয়েছে, কিন্তু এ দেশের যে ধনবানরা মার্কিন প্রেমে গদগদ তারা বিষয়টিকে মেনে নিতে চাইছে না। কী যে জমানা পড়েছে! যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনদের শ্রম অধিকার নিয়ে কান্নাকাটির পরিণতি কী দাঁড়ায় সেটাই দেখার বিষয়। এর পরিণতিতে আমাদের ধনিক শ্রেণী সাম্রাজ্যবাদবিরোধী হয়ে পড়বে না তো?

No comments

Powered by Blogger.