আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও অমর একুশে গ্রন্থমেলা by মুস্তাফা মাসুদ

স্বাধীন পাকিস্তানের পূর্বাংশের অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বপ্নভঙ্গে প্রথম আগ্নেয় বহিঃপ্রকাশ মাতৃভাষা বাংলার জন্য লড়াকু আন্দোলন এবং এর চরম পরিণতিতে ১৯৫২ সালে ঢাকার রাজপথে ভাষাশহীদদের আত্মদান। ভাষা আন্দোলন এবং এর জন্য অকাতরে জীবন বিসর্জন আবহমান বাংলার ইতিহাসের এক অনন্য ঘটনা।


পাকিস্তানি মাথামোটা শাসকগোষ্ঠী তখন হয় তো বুঝতেই পারেনি যে বাঙালিরা এতটা অকুতোভয় হয়ে ভাষার জন্য জীবন বাজি রেখে দলে দলে রাস্তায় নেমে পড়বে। ঔপনিবেশিক স্বৈরশাসকরা সাধারণত শক্তি প্রয়োগের নীতিতে বিশ্বাসী থাকে এবং জনগণের অন্তস্থ বাঁধভাঙা আবেগ ও গভীরতম দেশপ্রেমকে মূল্যায়ন করতে প্রায়ই সমর্থ হয় না। তারা মনে করে, দমন-পীড়ন আর ডাণ্ডাবেড়িই সব সমস্যার সমাধান এনে দিতে পারে। পাকিস্তানি শাসকরাও তাই করেছে। ইসলামী সংহতি আর মুসলিম ভ্রাতৃত্ব চেতনার জিগির তুলে হাজার মাইল ব্যবধানের দুটি ভূখণ্ডের সমন্বয়ে যে এক কিম্ভূতকিমাকার দেশ পাকিস্তানের সৃষ্টি, তার একটি অংশের সংখ্যাগুরু মানুষের মাতৃভাষার দাবিকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য তারা ঔপনিবেশিক দখলদার প্রভুদের মতোই শক্তি প্রয়োগ আর দমন-পীড়নের নীতি গ্রহণ করে। তাদের এই হঠকারী নীতির কারণে 'স্বপ্নের পাকিস্তানের' ভঙ্গুর দেয়ালে সূচনাতেই যে বিরাট ফাটল সৃষ্টি হলো, তা তারা বোঝেওনি, বোঝার চেষ্টাও করেনি। বৈষম্যের জ্বলন্ত আগুনে দগ্ধ বাঙালির মনে সেদিন যে ঘৃণা আর দ্রোহের জন্ম হয়েছিল, তাই তো ধাপে ধাপে তাদের একদিন পেঁৗছে দিল স্বাধীনতার স্বর্ণ-দুয়ার পর্যন্ত!
তাই তো বলা যায়, ভাষা আন্দোলন স্বাধীন বাংলাদেশের হিমাদ্রি-উচ্চতায় ওঠার সাহসী অনুপ্রেরণার স্মারক। এর মধ্য দিয়েই পাকিস্তান সৃষ্টির ডামাডোলে সাময়িকভাবে মোহাচ্ছন্ন বাঙালি অচিরেই সংবিৎ ফিরে পায়; তারা পাকিস্তানের গোলকধাঁধার ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসে নিজস্ব পরিচয়ের আত্ম-প্রত্যয়দীপ্ত পথে দৃঢ় পদবিক্ষেপে এগিয়ে যাওয়ার অনন্ত প্রেরণা খুঁজে পায়। বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশ_এই তিনটি অনুষঙ্গ একত্রিত হয়ে বাঙালিকে এমন এক শক্তিতে শক্তিমান করে; এমন এক চেতনায় উজ্জীবিত করে, যা অখণ্ড পাকিস্তানের কৃত্রিম ও বায়বীয় দর্শনকে স্রেফ তাত্তি্বকতার হিমাগারে পাঠিয়ে দেয়। জাগ্রত বাঙালির মনে পাকিস্তানের অখণ্ডত্বের চেতনা তখন এক মৃত অতীত। সুতরাং বাঙালির সার্বিক পালাবদল আর আত্ম-উজ্জীবনের ক্ষেত্রে মাতৃভাষার সংগ্রাম ছিল এক ঐতিহাসিক প্রেরণা-উৎস; লাখো-কোটি বারুদের মহাবিস্ফোরণ।
মাতৃভাষার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালির এই যে জাগরণ, তা সাহিত্য-সংস্কৃতি, রাজনীতি, মেধা-মনন আর সার্বিক জীবনাচরণে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। বাংলা একাডেমী আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাঙালির এই অভাবনীয় ঐতিহাসিক উজ্জীবনের জীবন্ত স্মারক। এর সঙ্গে গোটা জাতির ভালোবাসা, আবেগ আর সামনে এগিয়ে চলার প্রেরণা জড়িয়ে রয়েছে। তাই অমর একুশে গ্রন্থমেলা নিছক বইয়ের হাট নয়; এটি বাঙালির স্বাধীন অস্তিত্ব জানান দেওয়ার মেলা, আত্ম-আবিষ্কারের ও আত্মপ্রত্যয়ী হওয়ার মহামিলন ক্ষেত্র। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত একুশে ফেব্রুয়ারি এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন যে শুধু বাঙালিদের কাছে নয়; বিশ্ববাসীর কাছেই তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও আবেগময়। ১৯৯৯ সালে আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি যেদিন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পেল, সেদিন থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু আমাদের থাকল না_তা হয়ে গেল বিশ্বের সবার আবেগ ও ভালোবাসার অংশ। আর এ কারণে একুশে উপলক্ষে যে গ্রন্থমেলার আয়োজন করা হয়, তারও চারিত্র্য আন্তর্জাতিক হওয়া উচিত, একান্ত যৌক্তিকভাবেই। একুশে ফেব্রুয়ারির মর্যাদা এখন দৈশিক সীমাবদ্ধতায় বিবেচিত হতে পারে না কিছুতেই। এর আন্তর্জাতিক পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে আমরা এ ঘটনাটি নিয়ে একটু হৈচৈ করেছি; এর কৃতিত্বের দাবিদার হতে আগ্রহী হয়েছি। কিন্তু এ অনন্যসাধারণ বৈশ্বিক মর্যাদা প্রাপ্তির বিষয়কে আমরা ভিন্ন মাত্রায় আরো আকর্ষণীয় করার কথা ভাবিনি। আর সেই ভাবনা প্রথমেই প্রয়োগ করা যেত অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে ঘিরে। একুশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পরই এ মেলাকে 'অমর একুশে আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলা' হিসেবে আয়োজন করা ছিল অত্যন্ত সংগত এবং সময়ের দাবি। অথচ কী এক অজ্ঞাত কারণে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র কর্তৃক আয়োজিত পাঠক-দর্শকহীন, দীনহীন এক নিষ্প্রভ বইমেলাকে 'ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা' নাম দিয়ে প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে আয়োজন করা হচ্ছে, যাতে বহির্বিশ্বের হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। তথাকথিত এ 'আন্তর্জাতিক বইমেলা' শুধু নামসর্বস্ব; এর নেই কোনো আন্তর্জাতিক চরিত্র-বৈশিষ্ট্য কিংবা আয়োজনের ব্যাপকতা। এ মেলা তেমন জমেও না। অথচ একুশের বইমেলায় পা রাখার জায়গা পাওয়া যায় না। কারণ একুশের বইমেলা বাঙালির এক ঐতিহাসিক আবেগ, ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাসিক্ত চেতনার সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে তার দুর্বার আকর্ষণ সে এড়াতে পারে না। ভালোবাসা, আবেগ আর স্বতঃস্ফূর্ত আকর্ষণ ছাড়া বইমেলা কেন, কোনো মেলাই জমে না।
তাই সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের এবং সেই সঙ্গে বাংলা একাডেমী ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, একুশে ফেব্রুয়ারির বৈশ্বিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠাকল্পে আগামী বছর থেকেই একুশের গ্রন্থমেলাকে আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলা হিসেবে আয়োজনের ব্যবস্থা করুন_যেমন পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রতিবছর কলকাতা বইমেলার আয়োজন করে থাকে। বাংলা একাডেমী ভাষা আন্দোলনের ফসল এবং জাতির মননের প্রতীক। তাই বাংলা একাডেমী চত্বর এবং এর আশপাশ জুড়েই এ মেলার আয়োজন করা যেতে পারে। জায়গার অভাব হবে না_বাংলা একাডেমীর নির্ধারিত চত্বর ছাড়াও টিএসসি-দোয়েল চত্বর-শিক্ষা ভবন পর্যন্ত বিস্তৃত রাস্তা মেলার ভেন্যু হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। প্রয়োজনে টিএসসি থেকে চারুকলা পর্যন্ত বিস্তৃত রাস্তাও ব্যবহার করা যেতে পারে। আমাদের বিশ্বাস, ভেন্যু কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা যথার্থ আন্তরিকতা আর উদ্যোগের ক্ষেত্রে। আর এ উদ্যোগ গ্রহণের মতো সদিচ্ছাসম্পন্ন মানুষেরও অভাব আছে বলে মনে হয় না। একুশে থেকে উদ্ভূত বাঙালির চেতনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে ভাষার জন্য ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা পুঞ্জীভূত হয়ে আছে, তার বিস্তৃততর পরিস্ফুটন ঘটতে পারে 'অমর একুশে আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলা'র মধ্য দিয়ে_ভিন্নতর মাত্রায়, ভিন্নতর অবয়বে।
আর একটি কথা, কানাডা প্রবাসী যে দুজন মহান হৃদয় বাঙালি_রফিক ও সালাম, যাঁদের প্রাথমিক উদ্যোগ আর প্রচেষ্টার ফলে একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয়টি পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে চূড়ান্ত হয়, তাঁদের যেন আমরা না ভুলি। আগামী বছরের অমর একুশে আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তাঁদের আমন্ত্রণ জানানো এবং বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা যেতে পারে। এতে একুশের প্রথম আন্তর্জাতিক আয়োজনটি অধিকতর মাধুর্যমণ্ডিত ও ভিন্নমাত্রিক হবে।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.