আদমশুমারির চূড়ান্ত ফল-জনসংখ্যা ১৫ কোটি by আরিফুর রহমান

পঞ্চম আদমশুমারি ও গৃহগণনা ২০১১-এর ফলাফল চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। চূড়ান্ত ফল অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৫ কোটি। অর্থাৎ গত ১০ বছরে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে এক কোটি ৪৫ লাখ। আগামী ১৬ জুলাই সোমবার বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে এ ফল ওয়েবসাইটে উন্মোচন


করবেন। বিবিএসের নিজস্ব ওয়েবসাইটে এ ফল প্রকাশ করা হবে। এর পরেই ৬৪ জেলার ডিসিরা তাঁদের জেলার আদমশুমারি ও গৃহগণনার ফলাফল প্রকাশ করবেন।
বিবিএস সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
চূড়ান্ত ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, জেলাওয়ারি হিসাবে স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে বেশি মানুষ বাস করছে ঢাকায়- প্রায় দেড় কোটি মানুষ বাস করছে এ জেলায়। দ্বিতীয় সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ বাস করছে চট্টগ্রামে। ওই জেলায় বাস করছে প্রায় এক কোটি মানুষ। তৃতীয় কুমিল্লা, এরপর যথাক্রমে ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, সিলেট, গাজীপুর ও নোয়াখালী জেলা।
আদমশুমারি অনুযায়ী দেশে নারী ও পুরুষের আনুপাতিক হার প্রায় সমান। এখন এ অনুপাত ১০১ : ১০০। চতুর্থ আদমশুমারিতে এ অনুপাত ছিল ১০৬ : ১০০।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সচিব রীতি ইব্রাহিম কালের কণ্ঠকে জানান, দেশের ইতিহাসে দ্রুততম সময়ে ফলাফল চূড়ান্ত করা হয়েছে। আগামী ১৬ জুলাই রাষ্ট্রপতি আনুষ্ঠানিকভাবে ফলাফল ঘোষণা করবেন। তিনি বলেন, আদমশুমারির ফলাফল চূড়ান্ত করতে সময় লেগেছে মাত্র এক বছর তিন মাস। অথচ বিগত চারটি আদমশুমারির ফলাফল চূড়ান্ত করতে সময় লেগেছিল দুই থেকে তিন বছর। চূড়ান্ত ফলাফলে দেশের প্রকৃত জনসংখ্যা কত এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে তিনি বলেন, দেশের প্রকৃত জনসংখ্যা ১৫ কোটির মধ্যে রয়েছে।
আদমশুমারি ও গৃহগণনার তথ্য সংগ্রহ
গত বছর ১৫ মার্চ পঞ্চম আদমশুমারি ও গৃহগণনার তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করে বিবিএস। দেশব্যাপী এ গণনার তথ্য সংগ্রহের কাজ শেষ হয় ১৯ মার্চ। একই বছরের ১৬ জুলাই আদমশুমারি ও গৃহগণনা ২০১১-এর প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশ করে বিবিএস। প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, দেশের জনসংখ্যা ১৪ কোটি ২৩ লাখ ১৯ হাজার। জনসংখ্যা বৃদ্ধির বার্ষিক হার ১.৩৪ শতাংশ। দেশের প্রকৃত জনসংখ্যার সঙ্গে প্রকাশিত তথ্যের মিল নেই- সাংবাদিকদের এ কথার জবাবে পরিসংখ্যান বিভাগের সচিব রীতি ইব্রাহিম বলেছিলেন, প্রকৃত গণনা ও শুমারি-পরবর্তী যাচাইয়ের পর এ সংখ্যা আরো কিছু বাড়বে।
তথ্য যাচাইয়ে বিআইডিএসকে দায়িত্ব
পঞ্চম আদমশুমারির তথ্য যাচাইয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে (বিআইডিএস)। বিআইডিএস গত বছর ১০ থেকে ১৪ এপ্রিল ২৮০টি নমুনা এলাকায় যাচাই জরিপ শুরু করে। নমুনা হিসেবে ১৪০টি গ্রাম ও ১৪০টি শহর নির্ধারণ করা হয়। প্রায় এক বছর জরিপকাজ পরিচালনার পর গত ৯ এপ্রিল বিআইডিএস ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করে। তাতে দেখা গেছে, পঞ্চম আদমশুমারিতে দেশের ৩.৯৭ শতাংশ বা ৫৭ লাখ মানুষ গণনা থেকে বাদ পড়েছে। বাদ পড়া মানুষ সমন্বয় করলে প্রাথমিকভাবে (আদমশুমারি ও গৃহগণনা ২০১১ অনুযায়ী) বাংলাদেশের জনসংখ্যা দাঁড়ায় ১৪ কোটি ৮০ লাখ। ওই দিন আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সদ্য বিদায়ী বিবিএস মহাপরিচালক শাহজাহান আলী মোল্লা বলেছিলেন, দেশের প্রকৃত জনসংখ্যা জানার জন্য আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। বাদ পড়া ৩.৯৭ শতাংশ যোগ করার পরও জনসংখ্যা কিছু বাড়তে পারে। কারণ, বিবিএস পুনরায় জরিপ যাচাই-বাছাই করছে।
আদমশুমারির চূড়ান্ত ফলাফল
বিবিএস পরিচালিত পঞ্চম আদমশুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, দেশের মোট জনসংখ্যা ১৪ কোটি ২৩ লাখ ১৯ হাজার। এক বছর যাচাই-বাছাইয়ের পর দেশের জনসংখ্যা ১৪ কোটি ৩৯ লাখ ৫৭ হাজার ৫৫১ জন বলে চূড়ান্ত করেছে বিবিএস। বিআইডিএসের জরিপে বাদ পড়া ৩.৯৭ শতাংশ লোককে এর সঙ্গে যোগ করার পর দেশের মোট জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪ কোটি ৯৭ লাখে। প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশের ঠিক এক বছর পর আগামী ১৬ জুলাই পঞ্চম আদমশুমারির চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করতে যাচ্ছে বিবিএস।
বিবিএস সূত্র জানায়, ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ আদমশুমারির সমন্বয়কৃত (২০০৩ সালে) বা চূড়ান্ত ফলাফলে বলা হয়েছিল, দেশের মোট জনসংখ্যা ১৩ কোটি ৫২ লাখ। সে হিসাবে গত ১০ বছরে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে এক কোটি ৪৫ লাখ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম নূর-উন নবী চৌধুরী কালের কণ্ঠকে জানান, বিবিএসের জরিপে যদি ৫ শতাংশের বেশি লোক বাদ পড়ত, তাহলে পঞ্চম আদমশুমারি প্রশ্নবিদ্ধ হতো। কিন্তু বিআইডিএসের যাচাইয়ে দেখা গেছে, বিবিএসের জরিপে বাদ পড়েছে ৩.৯৭ শতাংশ। তাই বিবিএসের জরিপ মোটামুটি ভালো হয়েছে। তিনি বলেন, দেশের বাইরে প্রায় এক কোটি লোক বাস করছে। সব মিলিয়ে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি। তাই অন্য কোনো সংস্থার তথ্য না নিয়ে বিবিএসের তথ্যই গ্রহণ করতে হবে।
আদমশুমারি নিয়ে দুই মন্ত্রীর প্রশ্ন
পঞ্চম আদমশুমারির তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ও খাদ্যমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক। তাঁরা উভয়েই অভিযোগ করেন, সর্বশেষ পরিচালিত আদমশুমারির তথ্য সঠিক নয়। গত ১২ এপ্রিল বিবিএস আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তাঁরা বলেন, দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এত কম জনসংখ্যা হওয়ার কথা নয়। বিবিএসের জরিপের সংখ্যার চেয়ে দেশের জনসংখ্যা অনেক বেশি হবে।
আদমশুমারি নিয়ে অভিযোগ
পঞ্চম আদমশুমারিতে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বিবিএসের প্রাথমিক তথ্য সঠিক ছিল কি না, তা যাচাইয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বিআইডিএসকে। কিন্তু বিআইডিএসের পরিবর্তে বিবিএস নিজস্ব জনবল ও উপকরণের মাধ্যমে যাচাইয়ের কাজ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রশ্নপত্র, ম্যানুয়াল (নির্দেশিকা), কন্ট্রোল ফর্ম ও চেকলিস্টের ব্যয় প্রয়োজনের চেয়ে বেশি করা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এসব অভিযোগের জবাবে বিবিএস সচিব রীতি ইব্রাহিম কালের কণ্ঠকে বলেন, এত বড় জরিপ যাচাইয়ে বিআইডিএসের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তাই বিবিএস থেকে কারিগরি সহায়তা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বিবিএসের জনবল ব্যবহার করা হয়েছে। এতে দোষের কিছু হয়নি। কারণ, বিআইডিএসের বাইরে কাউকে দিয়ে এ যাচাই কাজ করালে অবশ্যই প্রশিক্ষণ দিতে হতো। এতে অনেক সময় ব্যয় হতো। সময় কমানোর জন্যই বিআইডিএসকে সহযোগিতা করেছে বিবিএস।
'পঞ্চম আদমশুমারি ও গৃহগণনা ২০১১'-এর প্রকল্প পরিচালক অসীম কুমার দে কালের কণ্ঠকে জানান, অনেক কম সময়েই পঞ্চম আদমশুমারির কাজ শেষ করা হয়েছে।
আগের চার আদমশুমারি
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৪ সালে। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ১৯৭৪ সালে আদমশুমারি ও গৃহগণনা পরিচালনা করে বিবিএস। এরপর ১৯৮১ সালে দ্বিতীয়, ১৯৯১ সালে তৃতীয় ও ২০০১ সালে চতুর্থ আদমশুমারি ও গৃহগণনা পরিচালনা করে বিবিএস।

No comments

Powered by Blogger.