খোলা হাওয়া-দুর্নীতি ও বিদেশি সাহায্যকে না বলতে শিখুন by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

অনেক দিন ধরে প্রথম আলো দেশে মাদকবিরোধী প্রচারাভিযান চালিয়ে যাচ্ছে—যেহেতু মাদকের ব্যবহার ক্রমাগতহারে বাড়ছে, ভয়াবহ হয়ে দাঁড়াচ্ছে এর বিস্তার, এবং তরুণদের একটি মন্ত্রে অনুপ্রাণিত করছে, মাদককে ‘না’ বলুন। অসংখ্য তরুণ এই মন্ত্রটি গ্রহণ করেছে, মাদক থেকে দূরে থেকেছে অথবা মাদকাসক্তি থেকে বেরিয়ে এসেছে


এবং একটি অর্থবহ জীবন কাটাচ্ছে। মাদকের মতোই, তবে মাদকের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি হারে বাড়ছে দুর্নীতি। সারা দেশে এখন দুর্নীতিই সবচেয়ে উচ্চফলনশীল উৎপাদনশীল খাত। কিন্তু দুর্নীতিতে যাঁরা যুক্ত, তাঁরা মাদককে ‘না’ বলা ওই সব তরুণের মতো কোনো মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে নিজেদের পরিশুদ্ধ করতে রাজি নন। তাঁরা বেশির ভাগ পরিণত বয়সের, অনেকেই জীবনের শেষভাগে উপনীত। কারও কারও এক পা কবরে। সারা জীবন তাঁরা দুর্নীতিকে ‘হ্যাঁ’ বলেছেন; দুর্নীতি করেছেন, অন্যদের করতে উৎসাহিত করেছেন, দুর্নীতির বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়েছেন, দুর্নীতিকে খাদ্য এবং পানীয়র মতো ব্যবহার করেছেন। তাঁদের পক্ষে দুর্নীতিকে না বলা আর নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা একই জিনিস। দুর্নীতি তাঁদের চরিত্র গঠনের অন্যতম উপাদান, দুর্নীতি তাঁদের জীবনের প্রধান চালিকাশক্তি। ফলে তাঁদের সামনে নীতি বা নৈতিকতা, ধর্ম, পরিবার, সমাজ অথবা দেশ কোনো বিবেচনা নয়: প্রধান বিবেচনা হচ্ছে তাঁরা নিজেরা। এসব লোককে আমরা দুর্নীতিবাজ বলি, তাঁরা ছড়িয়ে আছেন আমাদের চারপাশে—সমাজে, সরকারে, প্রশাসনে, নানা শ্রেণী ও পেশায়, সব প্রতিষ্ঠানে। এক সকালের একটি খবরের কাগজে চোখ বুলালে অন্তত এক ডজন দুর্নীতির ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যাবে, যেগুলোতে পুলিশ কনস্টেবল থেকে মন্ত্রী পর্যন্ত জড়িত। এই সংখ্যাটি অবশ্য হাস্যকর রকমভাবে নগণ্য।
বিদেশের এক শহরে দেখেছিলাম, ব্যস্ত চৌরাস্তার ওপর দাঁড়ানো এক উঁচু দালানের গায়ে লিকুইড ক্রিস্টাল ডিসপ্লেতে দেখানো হচ্ছে প্রতি মিনিটে বিশ্বের জনসংখ্যা কতটা বাড়ছে। সংখ্যাগুলো ক্রমাগত লাফিয়ে বাড়ছে। যদি ঢাকার কোনো দালানে আমাদের দুর্নীতির ঘটনার প্রতি মিনিটের হিসাবটা এ রকম এলসিডিতে দেখানো হতো, তাহলে সংখ্যাগুলো এত দ্রুত বাড়ত যে কেউ পড়তেও পারত না। অথবা পুরো ডিসপ্লেটাই দম হারিয়ে নষ্ট হয়ে পড়ত। আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলে, এক আর্থিক দুর্নীতিকেই যদি আমরা প্রধান সূচক হিসেবে ধরি, তাহলে আমাদের টেক্কা দেওয়ার মতো দেশ বিশ্বে কমই আছে। তবে দুর্নীতি তো শুধু আর্থিক নয়, দুর্নীতির আরও অনেক পরিচয় আছে, সংজ্ঞা আছে, সেগুলো যোগ করলে আমরা অবশ্যই দুর্নীতি-অলিম্পিকের মেডাল দৌড়ে অনেক এগিয়েই থাকব।
আমাদের দেশে দুর্নীতি নিত্যদিনের একটা বাস্তবতা এবং এ নিয়ে আমাদের মাথাব্যথার সুযোগ নেই, অবকাশও নেই; থাকলেও তা হবে বিলাসিতা। সে জন্য হঠাৎ হঠাৎ যখন দুর্নীতি নিয়ে একটা বড় খবর হয়, আমরা চমকে উঠি। এক-এগারোর পর প্রায় প্রতিদিনই আমাদের জন্য চমক থাকত। এক বনের রাজার বালিশভর্তি টাকার গল্প শুনে আমরা ভেবেছি, লোকটি বুদ্ধিমান নয়। দুর্নীতি করছে কিন্তু দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে—এ কেমন কথা? তিতাসের এক মিটার রিডার ধরা পড়ার পর মনে হলো, পাঁচটা ফ্ল্যাটের মালিক হয়েও কীভাবে ধরা পড়া থেকে দূরে থাকতে হয়, নির্বোধ লোকটা তা শিখল না। ট্রুথ কমিশনে গিয়ে যখন অনেক হোমরা-চোমরা নিজেদের দোষ স্বীকার করলেন, তখনো এ রকম মনে হয়েছিল। এরপর যখন হাওয়া ভবনের দুর্নীতির খবর বের হতে শুরু করল, আমরা ভাবলাম দেশটার হচ্ছেটা কী?
প্রতিদিনের ভাত খাওয়ার মতো যে বাস্তবতা, নিদ্রা যাওয়ার মতো নৈমিত্তিকতা সেই অপরিহার্য এবং অনস্বীকার্য দুর্নীতি, তা কেন এত বড় খবর হবে? আর খবর হলেই যে প্রতিকার হবে, খুব একটা বদলে যাবে দুর্নীতির চিত্র, তা-ও তো নয়। আমরা এ রকম খবরে বরং অস্বস্তিতে পড়ি; ভাবি, স্বাভাবিক একটা বিষয়ে কেন এত মিডিয়া-উৎসাহ। কুকুর মানুষকে কামড় দিয়েছে, মানুষটাও রাস্তার গেদু মিয়া—এ নিয়ে তো খবর হয় না, খবর হয় গেদু মিয়া কুকুরকে কামড় দিলে। তিতাসের মিটার রিডার ছেঁড়া শার্ট গায়ে রোদে পুড়ে সাইকেলে চড়ে মিটার দেখে বেরিয়ে বাড়ি ফিরে মরিচ পোড়া দিয়ে ভাত খেলে সেটি হওয়া উচিত খবর। হাওয়া ভবন টাকা দিয়ে এক হাজার প্রাইমারি স্কুলে লাইব্রেরি করে দিলে সেটি হওয়া উচিত খবর।
এ জন্যই দুর্নীতির কারণে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক—এই সংবাদ যখন সারা দেশের (এবং বিশ্বের কোনো কোনো) সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলের শিরোনাম হয়, তখন অবাক হতে হয়। এটি কোনো খবর হলো? শিয়ালের সামনে মুরগি রাখা হয়েছে অথবা বিড়ালের সামনে দুধ, আর তারা উপোস দেবে, নিরাসক্ত দৃষ্টি মেনে চলবে কী হবে এই আহার্য গ্রহণে, এই অনাবশ্যক পেটপূজায়—তা কি হয়? তার থেকে যদি খবরটা এ রকম হতো যে বিশ্বব্যাংক আগ বাড়িয়ে এক শ কুড়ি কোটি ডলারের জায়গায় দেড় শ কোটি ডলার দিচ্ছে, সুদের হার শূন্যে নামিয়ে এনেছে, যেহেতু মন্ত্রী থেকে নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণের টাকা যারা পৌঁছে দিচ্ছে, তারা সততার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে বিশ্বের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে, তাহলে সেটি-ই হতো প্রকৃত খবর। ‘পদ্মা সেতু প্রকল্পের আড়াই টাকার দুর্নীতির প্রতিবাদে মন্ত্রীর পদত্যাগ’, অথবা ‘ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সরকারি ক্ষতিপূরণের বাইরে মন্ত্রীর পঞ্চাশ হাজার টাকা দান’—এ রকম শিরোনাম হলেই না আমরা নড়েচড়ে বসে পত্রিকাটা পড়তাম।
না। পদ্মা সেতু শুধু একটা মাত্র মুরগি নয়—গৃহস্থবাড়িতে বড় হওয়া কয়েক লাখ দেশি মুরগি। পদ্মা সেতু শুধু এক বাটি দুধ নয়, ফ্রিজিয়ান গরুর গ্যালন গ্যালন দুধ। শিয়াল ও বিড়াল কেন সব শক্তি নিয়ে এর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে না, বলুন?
কিন্তু দেশটা তো আর শিয়াল এবং বিড়ালদের একা নয়, এবং আমরাও এত দিন মুরগি আর দুধের জোগান দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। এখন এই শিয়াল-বিড়ালদের না বলার সময় এসেছে। আমাদের এখন তাদের পরিষ্কার জানিয়ে দিতে হবে, অনেক হয়েছে, আর নয়।
এই লেখাটি মাদকের বিপদে থাকা অল্পবয়সীদের জন্য নয়, এই লেখাটি দুর্নীতিতে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে বসে থাকা অর্ধবয়সী, মাঝবয়সী এবং শেষবয়সীদের জন্য। আপনাদের দুর্নীতির জন্য শুধু যে পদ্মা সেতু তৈরির সম্ভাবনাটা দূর হয়ে গেল, তা-ই নয়, আপনাদের দুর্নীতির জন্য দেশের বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ থেকে নিয়ে বাচ্চাদের টিকাদান কর্মসূচি এখন বিকলাঙ্গ হতে চলেছে। আপনারা কদিন বাঁচবেন পৃথিবীতে, কদিন পোলাও-কালিয়া খাবেন—হূদ্যন্ত্র, পাকযন্ত্র আর রক্তচাপ ও রক্তশর্করায় ভয়াবহ সব গোলযোগ নিয়ে? আপনার সন্তান ও তাদের সন্তানদের জন্য কোন পৃথিবী রেখে যাবেন, কোন উত্তরাধিকারে অধিষ্ঠিত করে যাবেন তাদের?
একটু ভাবেন। এবং ভেবে একটু আড়মোড়া ভেঙে বলুন, না। দুর্নীতিকে না। সরকারকে বলি, বালুতে মুখ গুঁজে পড়ে না থেকে দুর্নীতিকে না বলুন। মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে কোথাও বালু নেই বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। সরকারের তো শক্তি অনেক, একটা নৈতিক শক্তিও তার আছে, যেহেতু কোটি কোটি তরুণের ভোটে এ সরকার নির্বাচিত। যদি তরুণেরা মাদককে ‘না’ বলতে পারে, তবে আপনারাও দুর্নীতিকে না বলতে পারেন।
একবার জোরেশোরে না বলুন। তারপর দেখুন সারা দেশে বজ্রনির্ঘোষে তরুণেরা বলছে, না দুর্নীতিকে না।

২.
এবং বিদেশি সাহায্যকেও না বলতে শিখুন। বিশ্বব্যাংককেও—যেহেতু বিদেশি সাহায্যের জন্য আমাদের লম্বা করে পাতা হাতটা ওয়াশিংটনেই প্রথম গিয়ে ঠেকে। বিশ্বব্যাংক এক আজব প্রতিষ্ঠান—কাগজে-কলমে এটি দারিদ্র্য নির্মূলকারী বিশ্ব প্রতিষ্ঠান, কিন্তু কাজেকর্মে এটি পুঁজিবাদকে সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করতে বদ্ধপরিকর একটি সংস্থা। এটি প্রতিষ্ঠার পর বিশ্বের কোন কোন দেশে এটি দারিদ্র্য দূর করতে পেরেছে, তা একটা গবেষণার বিষয় হতে পারে। বিশ্বের যেসব দেশে, যেমন বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া অথবা শ্রীলঙ্কায় দারিদ্র্য কমবেশি মাত্রায় কমেছে, তা সম্ভব হয়েছে সেসব দেশের মানুষের জন্য, তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য, পরিশ্রমী মানুষের জন্য। দারিদ্র্য কমেছে বিশ্বব্যাংকের কারণে নয়, বরং বিশ্বব্যাংক থাকা সত্ত্বেও। বলা হয়ে থাকে, বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ যখন কোনো ঋণ দেয়, তা দেয় কিছু কঠিন শর্তের অধীনে, যে শর্তগুলোকে ‘ওয়াশিংটন কন্ডিশনালিটিজ’ বলে বর্ণনা করা হয়, যেমন বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং অর্থ খাতের উদারীকরণ, জাতীয় শিল্পের বেসরকারীকরণ অথবা নিয়ন্ত্রণ কমানো (ডিরেগুলেশন)। যে শর্তগুলো শিল্পোন্নত এবং সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশগুলোকেও অনেক সময় মেনে চলতে সমস্যা হতে পারে, সেগুলো চাপিয়ে দিয়ে দরিদ্র দেশগুলোর নাভিশ্বাস তোলা হয়। বিশ্বব্যাংক ভর্তুকি পছন্দ করে না; অথচ যুক্তরাষ্ট্রের কৃষকদের যে ব্যাপক ভর্তুকি দেওয়া হয় সে ব্যাপারে সংস্থাটি নীরব। গরিব দেশের সরকার কোনো লালবাতি জ্বালাতে যাওয়া ব্যাংককে সহায়তা দিয়ে বাঁচিয়ে দিলে (‘বেইল আউট’ করলে) বিশ্বব্যাংক বিরক্ত হয় অথচ যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মহামন্দার সময় অনেক ব্যাংককে যখন সরকার বেইল আউট করেছে, বিশ্বব্যাংক তখন যথারীতি অন্যদিকে তাকিয়ে থেকেছে। বিশ্বব্যাংকের এককালীন প্রধান অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজ এর দ্বিমুখী নীতির সমালোচনা করেছেন। বিশ্বব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আইএমএফের প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিন লেগার্দ সম্প্রতি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্যোগে পড়া গ্রিসের সমস্যা নিয়ে কড়া কিছু মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, গ্রিসের মানুষকে কর দেওয়া শিখতে হবে। নিউইয়র্কার-এর এক সাম্প্রতিক সংখ্যায় এ নিয়ে একটা লেখায় অতঃপর মন্তব্য করা হয়েছে, ‘অথচ তিনি তাঁর আধা মিলিয়ন ডলার বেতনের ওপর এক পয়সাও ট্যাক্স দেন না।’
বিশ্বব্যাংকের শুরুর উদ্দেশ্য খারাপ ছিল না—বিশ্বের দারিদ্র্য দূর করা। এখন দেখা যাচ্ছে, এটি সে-ই উদ্দেশ্য থেকে সরে এসে পুঁজিবাদের পক্ষে একটি খবরদারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত যেমন বলেন, এটি একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। আমাদের তাই নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে এবং এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে না বলতে শিখতে হবে।
আমাদের কৃষক, আমাদের শ্রমজীবী এবং প্রবাসী শ্রমিকেরা যাঁদের অবদানে বাংলাদেশ দারিদ্র্যের পাকচক্র থেকে বেরোতে শুরু করেছে, তাঁরা বিদেশি দাতা ও বিশ্বব্যাংকের উপদেশ শুনে কাজ করেন না। আমাদের সরকারগুলো তাহলে কেন করবে?
প্রধানমন্ত্রী রোববার সংসদে ঘোষণা করেছেন, পদ্মা সেতু হবে নিজস্ব অর্থায়নে। হয়তো তাঁর এ ঘোষণা পদ্মা সেতু নিয়ে তৈরি সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, কিন্তু পদ্মা সেতু যে আমরা নিজেরা একেবারেই করতে পারব না, তা তো নয়। হয়তো এ জন্য আমাদের অনেক ভোগান্তি হবে, অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। কিন্তু এটি শুরু করা গেলে আমরা বলতে পারব, বিদেশি সাহায্যকে আমরা না বলতে শিখছি।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.