মুশফিকদের মর্যাদার ইউরোপ সফর by মোঃ মামুন রশীদ

বাংলাদেশ জাতীয় দলের সামনে আরেকটি টি২০ সিরিজ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের এ ক্ষুদ্রতম ফরমেটের সঙ্গে এখনও অভ্যস্ততা লাভের জন্য লড়াই করছে বাংলাদেশ জাতীয় দল। গত মাসে জিম্বাবুইয়ে সফরে ত্রিদেশীয় আসরেও সেই চর্চার অভাব পুষিয়ে উঠতে সংগ্রাম করতে হয়েছে বাংলাদেশ দলকে।


শুধু কি তাই, গত মার্চে ১১তম এশিয়া কাপ ক্রিকেটের আসরে রানার্সআপ হয়ে বিশ্বকে হতবাক করে দেয়া বাংলাদেশ দল টি২০ ক্রিকেটের র‌্যাঙ্কিংয়ে ১৫টি দলের ভেতর নেই। এর কারণ কম পরিমাণে টি২০ খেলা। অথচ বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, গত মাসে যে জিম্বাবুইয়ের কাছে হেরেছে বাংলাদেশ সেই জিম্বাবুইয়েকে পেছনে ফেলে আয়ারল্যান্ড আইসিসি টি২০ র‌্যাঙ্কিংয়ে ৯ নম্বরে আর হল্যান্ড আছে ১১ নম্বরে। এ দু’টি দলের বিরুদ্ধে আদেরই ঘরের মাঠে খেলতে হবে বাংলাদেশ দলকে। যেখান থেকে ২০১০ সালের ঠিক এ সময়টাতেই খুব একটা সুখকর স্মৃতি নিয়ে ফিরতে পারেনি বাংলাদেশ ওয়ানডে সিরিজ খেলে। মাশরাফি বিন মুর্তজার নেতৃত্বে আইরিশদের সঙ্গে ওয়ানডে সিরিজ ১-১ এবং হল্যান্ডের কাছে একমাত্র ওয়ানডে হেরেছিল বাংলাদেশ। আইরিশদের বিরুদ্ধে আতঙ্কের আরও ইতিহাস আছে বাংলাদেশ দলের। তাদের বিরুদ্ধে একটি টি২০ খেলে একটিতেই (২০০৯ সালের টি২০ বিশ্বকাপে ৬ উইকেটে হার) হেরেছে মুশফিক বাহিনী। তবে এরপরও এবার ইউরোপ সফরে শতভাগ সাফল্য নিয়ে র‌্যাঙ্কিংয়ে আসার চিন্তা করছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম। আর জিম্বাবুইয়ে সফরের আগে যে অনুশীলন ঘাটতি ছিল সেটা এবার নেই। এবার বাংলাদেশ দল টানা ৬ দিন অনুশীলন করেই ইউরোপ সফরে যাচ্ছে। আর ইউরোপ সফরে মূল ম্যাচ খেলতে নামার আগে বাংলাদেশ দল পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে ওঠার সুযোগ হিসেবে ৫ দিন সময় পাচ্ছে হাতে। এসব বিবেচনা করেই মাশরাফি, ওপেনার তামিম ইকবাল ও তরুণ পেসার আবুল হাসান রাজু মনে করছেন ইউরোপ সফর সফলভাবেই শেষ করে এ ফরমেটের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে বাংলাদেশ এবং সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য টি২০ বিশ্বকাপের আগেই একটা ব্যালেন্সড দলে পরিণত হবে তারা।
দেশের বাইরে বাংলাদেশ ৬টি টি২০ খেলে মাত্র ১টিতে জয় পেয়েছে। এ বিষয়টি ভালই ভাবাচ্ছে মুশফিককে। তিনি বলেন, ‘এ কথা সত্য যে, বিদেশে গিয়ে আমরা কখনই খুব একটা ভাল খেলি না। টি২০ কম ওভারের খেলা বলে এখানে ছোট বা বড় দল বলে কিছু নেই। তিন ম্যাচের সিরিজটি মোটেও সহজ হবে নয়।’ এবার অবশ্য মুশফিক অনেকটাই স্বস্তিতে আছেন। জিম্বাবুইয়ে সফরে যাওয়ার আগে বলেছিলেন, ‘ফাইনালে খেলার লক্ষ্য নিয়েই মাঠে নামব।’ তা সফল হয়নি। দল বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার শাকিব আল হাসানের অভাব অনুভব করেছে। সেই সঙ্গে পেসার শফিউল ইসলামও ছিলেন না। এবার দু’জনই চূড়ান্ত দলে যুক্ত হয়েছেন। আর তাই মুশফিকও বাড়তি ভরসা পাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘শাকিব আর শফিউল ফেরায় দলের শক্তি বেড়েছে। দলের সমন্বয়ও দারুণ।’ জিম্বাবুইয়ে সফরের দু’টি ম্যাচ খেলতে পারেননি তামিম উরুর ব্যথার কারণে। তামিমকে নিয়েও আর তেমন সমস্যা নেই। তামিম নিজেই জানালেন, ‘এখন শারীরিকভাবে পুরোপুরিই ফিট আছি। আর আমাদের যখন ফিটনেস টেস্ট হয়েছে সেখান থেকে দেখা গেছে যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক ভাল পর্যায়ে আছে সবার ফিটনেস। আশা করছি আয়ারল্যান্ডে গিয়ে প্রস্তুতি ম্যাচ থেকেই দলের হয়ে মাঠে নামতে পারব।’ বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশ দলের দারুণ সুযোগ হয়েছে বেশি বেশি টি২০ ম্যাচ খেলার। এটাকে বেশ ইতিবাচকভাবেই দেখছেন তামিম, ‘অন্য দেশগুলো কিন্তু ওয়ানডে, টেস্ট সিরিজও খেলছে। কিন্তু আমরা বিশ্বকাপের আগে শুধু টি২০ ম্যাচ খেলার মধ্যে থাকছি। এটা অবশ্যই আমাদের জন্য ভাল বিষয়। টি২০ ক্রিকেটে আমাদের যেটুকু ঘাটতি আছে আশা করি সেটা আমরা এর মাধ্যমে কাটিয়ে উঠতে পারব।’ বিশ্বকাপের আগে বেশি বেশি টি২০ ম্যাচ খেলার সুযোগ পেলেও বাংলাদেশ দল সেটা খেলছে সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণের পরিবেশ ও উইকেটে। আয়ারল্যান্ড-জিম্বাবুইয়ের কন্ডিশনের সঙ্গে খাপ খায় না, খাপ খায় শ্রীলঙ্কার সঙ্গে। এ বিষয়ে তামিম বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য বেশি ম্যাচ খেলা। সেটা যে কোন কন্ডিশনেই হোক না কেন। যত ম্যাচ খেলতে পারব তত আমাদের জন্য ভাল হবে। পরিবেশ কোন বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারবে না। এবার আমরা অনেক ভালভাবে প্রস্তুত হতে পেরেছি।’ এবার ১৮, ২০, ২১ জুলাই আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে একই স্থানে হবে তিনটি টি২০ ম্যাচ। এরপর ২৪ জুলাই স্কটল্যান্ড ও ২৫ জুলাই হল্যান্ডের বিরুদ্ধে একটি করে টি২০ ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ। স্কটল্যান্ড ও হল্যান্ডের চেয়েও বেশি ভাবনা আইরিশদের নিয়েই। মুশফিক অবশ্য সিরিজে ভাল কিছুর প্রত্যাশা নিয়েই ভাবছেন। তিনি বলেন, ‘জিম্বাবুইয়েতে প্রথম ম্যাচের পর থেকে পরের তিনটি ম্যাচে আমরা ধারাবাহিকভাবে ভাল খেলেছি। আয়ারল্যান্ডেও এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে চাই। সিরিজ জেতার আত্মবিশ্বাস অবশ্যই আছে।’ বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত টি২০ র‌্যাঙ্কিংয়ে নিজেদের নাম যুক্ত করতে পারেনি। র‌্যাঙ্কিংয়ে যুক্ত হতে বছরে ৮টি টি২০ খেলতে হয়। সেদিকেও নজর মুশফিকের, ‘র‌্যাঙ্কিংয়ে আফগানিস্তানও আছে অথচ আমরা নেই। এবার র‌্যাঙ্কিংয়ে যখন স্থান পাব তখন ভাল অবস্থানেই থাকতে চাই।’
অনুশীলন শুরুর আগেই প্রধান কোচ রিচার্ড পাইবাস দলের ক্রিকেটারদের নিয়ে দীর্ঘ সময় সভা করেন। এ নিয়ে মুশফিক জানালেন, ‘তিনি নতুন পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এবার আমরা আরো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করেছি। তিনি একটি বিশ্লেষণ দেখিয়েছেন। এতে কার কোথায় দুর্বলতা সে সব এসেছে। কারও হয়ত কোন শট বাছাইয়ে সমস্যা রয়েছে। মূলত এ বিষয়গুলো নিয়েই কথা হয়েছে।’ জাতীয় দলের পেস আক্রমণের অন্যতম ভরসা মাশরাফিও মনে করেন ক্রমেই বাংলাদেশ টি২০ ক্রিকেটের ঘাটতি পুষিয়ে উঠছে এবং গত ২/৩ মাসে টি২০ ফরমেটেও দলের অবস্থান অনেক ভাল হয়েছে। আর সে কারণেই আসন্ন আয়ারল্যান্ড-হল্যান্ড সফরে বাংলাদেশ দল ভাল করবে বলেই প্রত্যাশা মাশরাফির। তিনি বলেন, ‘আমাদের দলের স্পিনার যারা আছে তারা যে কোন ধরনের উইকেটেই স্বাচ্ছন্দ্যে বোলিং করতে পারে। টি২০ ক্রিকেটের স্বাভাবিক যে উইকেট আমরা দেখে থাকি সেটা ওখানে হলে বরং আমরাই সুবিধা পাব।’ তবে টি২০ ক্রিকেটে পুরোপুরি সুসংহত দলে পরিণত হতে আরও সময় প্রয়োজন বাংলাদেশেরÑ এমনটাই মনে করেন মাশরাফি। টি২০ ক্রিকেটে অনভ্যস্ততা বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের ব্যাটসম্যানরা তেমন একটা টি২০ ক্রিকেট খেলে না। যার কারণে একটা অনভ্যস্ততা থেকে গেছে। শুধুমাত্র শাকিব আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টি২০ ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছে। কারণ সে আইপিএল ও ইংলিশ কাউন্টিতে খেলার সুযোগ পেয়েছে।’ টি২০ ক্রিকেটের উইকেট কিছুটা সেøা এবং পুরোপুরি ফ্ল্যাট হয়ে থাকে। এ ধরনের উইকেটে দলের জন্য প্রয়োজনীয় কাজটি করতে হয় মূলত ব্যাটসম্যানদেরই। এ বিষয়ে মাশরাফি বলেন, ‘এখন আমাদের বেশ কয়েকজন ব্যাটসম্যান আছে যারা বিগ হিট নিতে সক্ষম। তামিম আছে, আবার আশরাফুলও বড় শট খেলতে পারে। তেমনি নিচের দিকে শাকিব যেমন আছে তেমনি মুশফিক-নাসির-রিয়াদও বড় শট খেলতে সক্ষম।’ অপরদিকে, পেসার আবুল হাসান রাজুর কিছুটা দুর্ভাগ্যই বলতে হবে। জাতীয় দলের হয়ে প্রথম কোন আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে নেমেছিলেন গত মাসে জিম্বাবুইয়ে সফর স্বাগতিকদের বিরুদ্ধে। কিন্তু ত্রিদেশীয় টি২০ ওই সিরিজটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) স্বীকৃত ছিল না। তবে আবুল হাসান এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘হয়ত আইসিসি স্বীকৃত ছিল না। কিন্তু প্রথমবার আমি বাংলাদেশের হয়ে খেলেছি এটাই দারুণ এক অভিজ্ঞতা।’ আসন্ন আয়ারল্যান্ড সফরে অন্য রকম স্বপ্নই দেখছেন তরুণ আবুল হাসান। কারণ এটি তাঁর প্রথম ইউরোপ সফর। তবে শফিউল-মাশরাফি-নাজমুলের মতো স্বীকৃত পেসাররা শেষ পর্যন্ত মূল একাদশে খেলার সুযোগ পাবেন কিনা সেটা নিয়েও সংশয় আছে। তবে এসব নিয়ে ভাবছেন না আবুল হাসান। তিনি বলেন, ‘সবকিছু পারফরমেন্সের ওপরে নির্ভর করছে। নিজের ওপরে আমার আত্মবিশ্বাস আছে। যাঁরা আছেন তাঁদের সঙ্গে আমার কোন তুলনা চলে না। এর মধ্যে আমি সুযোগ পেলে চেষ্টা থাকবে নিজেকে প্রমাণ করার।’

No comments

Powered by Blogger.