মোবাইল কোর্ট চালাতে গিয়ে পুলিশকে পাশে পাচ্ছেন না ডিসিরা-শিক্ষক নিয়োগেও দুর্নীতির অভিযোগ

অপরাধ আমলে নিয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার এখতিয়ার চেয়েছেন জেলা প্রশাসকরা। এ জন্য আইন সংশোধন করার দাবি জানান তাঁরা। একই সঙ্গে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সময় তাঁরা পুলিশের সহায়তা পান না বলেও অভিযোগ করেন।


এ ছাড়া বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশেই শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি হয় বলেও অভিযোগ করেন তাঁরা। গতকাল তিন দিনব্যাপী বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে প্রধানমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের কাছে এসব অভিযোগ তুলে ধরেন জেলা প্রশাসকরা।
সকালে উদ্বোধনী অধিবেশন শেষে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জেলা প্রশাসনসংক্রান্ত মুক্ত আলোচনায় জেলা প্রশাসকদের পক্ষ থেকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সময় পুলিশের সহায়তা না পাওয়ার ব্যাপারে অভিযোগ করা হয়। সে সময় প্রধানমন্ত্রীর কাছে দ্রুত আদালত অবমাননা আইন পাস করা, অনলাইনে জিডি ও মামলা করার পদ্ধতি চালুর দাবি জানান তাঁরা। একই সঙ্গে ডিসিরা ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্র কার্যকর করার জন্য দক্ষ জনবল চেয়েছেন।
সম্মেলন সূত্রে জানা গেছে, ডিসিরা বলেছেন, অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধ স্বীকার না করলে মোবাইল কোর্টের পক্ষে শাস্তি দেওয়া সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির অপরাধ আমলে নিয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার এখতিয়ার দরকার। এ জন্য মোবাইল কোর্ট আইন সংশোধন করতে হবে। ওই সময় একজন ডিসি বলেন, মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সময় পুলিশের সহায়তা পাওয়া যায় না। কোর্ট পরিচালনায় পুলিশের সহযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সূত্রমতে, ডিসিরা আদালত অবমাননা আইন দ্রুত পাস করা দরকার বলে মত দেন। আইনটি সংসদীয় কমিটিতে রয়েছে বলে জানা গেছে।
মন্ত্রিপরিষদের সচিব মোশাররফ হোসাইন ভূঁইয়া সাংবাদিকদের জানান, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ডিসিদের আন্তরিকতাপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য শুনেছেন। একই সঙ্গে তাঁদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, জেলা প্রশাসকরা বলেছেন, দেশের বেশির ভাগ মামলার উৎস ভূমি। অনিয়ম রোধে ভূমি ব্যবস্থাপনা ডিজিটাইজেশনের দাবি জানান তাঁরা। ডিসিরা দ্রুত যোগাযোগের দ্বার খোলার জন্য ফাইবার অপটিক সংযোগ সম্প্রসারণের দাবি জানান। অনলাইনে জিডি ও মামলা দায়েরের পদ্ধতি চালুর দাবিও তোলেন তাঁরা।
জানা যায়, এসব দাবির জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এগুলো ডিসিদের কোনো দাবি নয়। এগুলো জনমানুষের সেবা দেওয়ার আগ্রহের কথা। তিনি বিভিন্ন ইস্যুতে জনপ্রতিনিধিদের পাশে দাঁড়িয়ে জনগণের সেবা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
গতকাল এ আলোচনায় ১৫ ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনার অংশ নেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুক্ত আলোচনার পর ডিসিরা সচিবালয়ে যান। সেখানে পাঁচ কার্য অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। অধিবেশনগুলোতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, অর্থ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক, পরিকল্পনা, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ : সারা দেশে এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ১৬ হাজার। মাদ্রাসা সাত হাজার ৬০০, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের কলেজ এক হাজার ৪৪৪ এবং ডিগ্রি স্তরের কলেজ রয়েছে ৯২৭টি। বেসরকারি এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধিকাংশতেই শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি হয় বলে অভিযোগ করেছেন জেলা প্রশাসকরা। একই সঙ্গে তাঁরা বলেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা দুর্নীতি করেন। এমনকি এসব দুর্নীতির অভিযোগে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসকরা মন্ত্রণালয়কে বললেও কিছুই হয় না। তাঁদের পাঠানো ফাইল মন্ত্রণালয়ে ফেলে রাখা হয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষায় সব জেলায় উপবৃত্তি সমানভাবে বণ্টনের কথাও বলেছেন তাঁরা।
দুর্নীতি বন্ধে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও শিক্ষক নিয়োগের দাবি জানান তাঁরা। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদের দুর্নীতি বন্ধে সেখানে সরকারি কর্মকর্তাদের যুক্ত করার দাবি জানানো হয়।
গতকাল সোমবার জেলা প্রশাসক সম্মেলনের শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধিবেশনে তাঁরা এসব কথা বলেন। সচিবালয়ের মন্ত্রিপরিষদ কক্ষে আয়োজিত ওই অধিবেশন বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে পৌনে ৬টা পর্যন্ত চলে। আলোচনা করেন ১৬ জন ডিসি। তাঁরা মাঠপর্যায়ের শিক্ষা প্রশাসন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের চিত্র তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, বেসরকারি এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ না দিলে শিক্ষার মান কমে যাবে। এ ছাড়া শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যদের প্রশাসন ক্যাডারে প্রেষণে পদায়ন না করার দাবি জানিয়েছেন ডিসিরা।
জবাবে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, 'দুর্নীতি সমাজের সামগ্রিক ব্যাধি। এটিকে আইন করে দূর করা যাবে না। এর জন্য দরকার সামাজিক সচেতনতা। এই সচেতনতা তৈরিতে জেলা প্রশাসকরা কাজ করবেন।' তবে ডিসিরা যখনই কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন, তখনই মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিয়েছে বলে মন্ত্রী দাবি করেন। তিনি আরো বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগে সরকারি প্রতিনিধি থাকেন। আর পরিচালনা পর্ষদে সরকারি কর্মকর্তাদের যুক্ত করা প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, 'শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় একটি বিধির মাধ্যমে। এই বিধিতে সরকারি কর্মকর্তাদের যুক্ত করার বিধান নেই।'
সাতক্ষীরা, চাঁদপুর ও বাগেরহাটের ডিসিরা বলেছেন, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি হয়। অর্থের বিনিময়ে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে শিক্ষার মান ক্রমেই নিম্নগামী হচ্ছে।
শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে তাঁরা বলেন, বর্তমানে প্রাথমিকে কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে যোগ্য শিক্ষক পাওয়া যায়। এই পদ্ধতি বেসরকারি পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাস্তবায়ন করলে একই ফল পাওয়া যাবে।
খুলনার ডিসি বলেন, শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যরা শিক্ষকতা না করে প্রশাসন ক্যাডারে চলে আসতে চান। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক স্বল্পতা দেখা দেয়। শিক্ষকরা যাতে শিক্ষকতা করেন, সেদিকেই মন্ত্রণালয়ের নজর দেওয়া উচিত।
কোচিং প্রসঙ্গ টেনে কয়েকজন জেলা প্রশাসক বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে কোচিং বেড়ে গেছে। শিক্ষক নামধারী একশ্রেণীর শিক্ষা ব্যবসায়ী কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত। এই শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বাধ্য করে কোচিংয়ে পড়ার জন্য। যে শিক্ষার্থীরা কোচিংয়ে পড়তে যায় না, তাদের শিক্ষকরা কম নম্বর দেন বলে জানা গেছে।

No comments

Powered by Blogger.