মাথা নত করে নয়

কারও মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজস্ব অর্থায়নে চলতি ২০১২-১৩ অর্থবছরেই পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রবিবার জাতীয় সংসদে ত্রয়োদশ অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে এ কথা বলেন। বিশ্বব্যাংকের প্রতি ইঙ্গিত করে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কারও কাছে মাথা নত নয়, আমরা নিজেদের পায়ে


দাঁড়াতে চাই। আমরা পরনির্ভরশীল হব না, কারও মুখাপেক্ষী হব না। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে ১৬ কোটি মানুষের মনের কথাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে। সংসদে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে এক ধরনের চেতনাদীপ্ত দৃঢ় অঙ্গীকারের কথাই উঠে এসেছে। এখন এ লক্ষ্যে প্রয়োজন একটি জাতীয় জাগরণ ঐক্য ও সংহতি।
বিশ্বব্যাংক শুধু ঋণচুক্তি বাতিলই করেনি; তারা দুর্নীতির অভিযোগও তুলেছে। একতরফাভাবে চুক্তি বাতিল করে তারা স্পষ্টতই এ দেশের মানুষকে অপমান করেছে। অথচ বিশ্বব্যাংক একটি উন্নয়ন সহযোগী ব্যাংক। তারা ঋণ দেয় এবং সুদে-আসলে তা আবার উঠিয়েও নেয়। কাজেই তাদের আচরণ হওয়া উচিত ব্যাংকের মতো; কোন ত্রাতা বা নির্দেশকের নয়। এ কথা ঠিক বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ। এ দেশের উন্নয়ন কর্মকা- পরিচালনার জন্য উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোর ওপর আমাদের এখনও নির্ভরশীলতা রয়েছে। কিন্তু এর সুযোগ নিয়ে উন্নয়ন সহযোগীরা ছড়ি ঘোরাতে পারে না। ঋণগ্রহীতা দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কোথায় তার টাকা কী ধরনের উন্নয়ন কর্মকা-ে ব্যবহার করবে তার সম্পূর্ণ অধিকার তার রয়েছে। এ জন্য ঋণ দাতা সংস্থা কোন প্রেসক্রিপশন দিতে পারে না। তারা বলতে পারে না যে রেলে, কৃষিতে ভর্তুকি দিতে পারবে না। জুটমিল বন্ধ করতে হবে। বিআরটিসি চালানো যাবে না ইত্যাদি।
প্রধানমন্ত্রী সংসদে দেয়া ভাষণে এসব দিক অত্যন্ত স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে বলেছেন, একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে আমরা মাথা উঁচু করে চলব। কারও প্রেসক্রিপশনে নয়। প্রসঙ্গত তিনি পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিজস্ব খাত থেকে কিভাবে হতে পারে তারও একটি রূপরেখা তুলে ধরেন।
শেখ হাসিনা তাঁর বক্তব্যে বলেন, চলতি অর্থবছরে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হবে। নির্মাণ কাজ শেষ হবে ২০১৬ সালে। আমাদের এবারের ২০১২-১৩ অর্থবছরের যে বাজেট সেখানে বার্ষিক উন্নয়ন খাতে যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে সেখান থেকে পদ্মা সেতুর জন্য আমরা অর্থ সাশ্রয় করতে পারি। বাজেটে অনুন্নয়ন খাতে যে ৫৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, সেখান থেকেও আমরা ২৪ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করতে পারি। প্রতিটি মন্ত্রণালয় কিছুটা কৃচ্ছ্রসাধন ও ত্যাগ স্বীকার করলে এ সাশ্রয়ী অর্থ দিয়েই আমরা অনতিবিলম্বে সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করতে পারি। পদ্মা সেতুর অর্থ সংস্থানের জন্য আমরা সারচার্জ বসাতে পারি, ৭৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বন্ড ইস্যু করব। নিজেদের বাজেট থেকে এ সেতু করতে হলে কিছু উন্নয়ন হয়ত কমাতে হবে, পাশাপাশি দাতা সংস্থার জন্য পথও খোলা রাখার কথা বলেন তিনি। কোন দাতা সংস্থা এগিয়ে আসতে চাইলে কিংবা কোন বিদেশী বিনিয়োগ করতে চাইলে তাদেরও স্বাগত জানানোর কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের যে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন তা জাতিকে আত্মনির্ভরশীল এবং আত্মমর্যাদাবোধ আরও জোরদার করবে। পদ্মা সেতু নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যেও নবজাগরণ দেখা গেছে। প্রবাসী বাংলাদেশীসহ দেশের বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সর্বোপরি সাধারণ মানুষ যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী সেতু নির্মাণে পাশে দাঁড়ানোর কথা বলছেন। এ লক্ষ্যে সরকারকে একটি জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করে এগিয়ে যেতে হবে।

সড়কে বলি
রাজধানীসহ সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন যে হারে হতাহতের ঘটনা ঘটছে, তাতে মনে হচ্ছে দেশের সড়কব্যবস্থা যেন ক্রমশ মৃত্যুর ফাঁদে পরিণত হচ্ছে। জীবনের জন্য পথ, মৃত্যুর জন্য নয়। তথাপি সড়ক দুর্ঘটনার বলি হচ্ছে শত শত তাজা প্রাণ। গত রবিবার বাসচাপায় ঢাকা কমার্স কলেজের অনার্সের ছাত্র তেইশ বছর বয়সী যুবক শাওনের রক্তে রঞ্চিত হলো মিরপুর স্টেডিয়াম রোড। তার এই মৃত্যুতে ক্ষোভে ফেটে পড়ে সহপাঠীরা। বন্ধু, সহপাঠীকে হারানোর বেদনায় তারা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ শুরু করে এবং এক পর্যায়ে কিছু গাড়ি ভাংচুরও করে। প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের আর কতদিন এই রকম মৃত্যুর কথা শুনতে হবে? দেশের কোন না কোন স্থানে প্রতিদিনই কারও না কারও জীবন প্রদীপ নিভে যাচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায়। সড়ক দুর্ঘটনা এতটাই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে যে তাকে থামানো যাচ্ছে না কোনমতেই। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত পনেরো বছরে দেশে প্রায় দেড়লাখেরও বেশি সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে যার ফলে প্রাণ হারিয়েছে অসংখ্য মানুষ। সড়ক দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তি বা পরিবারের স্বজনদের আহাজারি শোনা যায় প্রতিনিয়তই। কিন্তু তা থামানোর জন্য তেমন কোন ব্যবস্থা যেন নেই। সড়ক দুর্ঘটনা কেবল তাজা প্রাণই কেড়ে নিচ্ছে না, এটি আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনাজনিত কারণে দেশের ক্ষতি হচ্ছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ২ শতাংশ। নাজুক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামোগত সমস্যা, পরিকল্পনা ও নীতির দুর্বলতা, আইনের বাস্তবায়নের অসারতা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, অবৈধ গাড়ি পার্কিং, সিগন্যাল না মানার প্রবণতা, অবৈধ লাইসেন্সধারী ড্রাইভার, ওভারটেকিং মানসিকতা ইত্যাদি কারণে প্রতিনিয়তই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হতে হচ্ছে মানুষকে। শাওনকে প্রাণ দিতে হলো চালকের উদাসীনতার কারণে। ড্রাইভারের দায়িত্ব হচ্ছে যাত্রীকে নিরাপদে গন্তব্য স্থানে পৌঁছে দেয়া। কিন্তু বাস্তব চিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অধিক যাত্রী নেয়ার লোভে বাস চালক চলন্ত অবস্থাতেই যাত্রীদের নামিয়ে দেয় যার ফলে পা ফসকে অনেক সময় যাত্রীদের দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়। চালকদের উদাসীনতার কারণে এ রকম আর কত প্রাণ বিসর্জন দিতে হবে? সরকারকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে এই সব চালকদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত। এই উদাসীনতার রেশ কাটাতেই হবে। উদ্যোগ নিতে হবে নিরাপদ সড়কের ব্যবস্থা করার যাতে আর কোন তাজা প্রাণকে সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যু ফাঁদে পা দিতে না হয়।

No comments

Powered by Blogger.