সংবিধান সংশোধন বিতর্ক : পার্থক্যটি খুবই সূক্ষ্ম by ড. এম এ মালেক

বেশ কিছু দিন থেকে অর্থাৎ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক বাতিল ঘোষিত হওয়ার পর থেকে সংবিধান সংশোধন বিষয়ে পত্রপত্রিকায় এবং বিভিন্ন মহলে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। এক পক্ষ দাবি করছে, সংবিধান সংশোধন বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছেন তা অনুসরণ করে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করে দিলেই সংবিধান সংশোধন হয়ে যাবে।


অন্যরা দাবি করছেন, সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা সংসদের। সুপ্রিম কোর্ট সংশোধনের বিষয়ে রায় দিলেও সংসদ কর্তৃক তা গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত ওই সব সংশোধনী সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে না। এ দুটি বিষয়ে পত্রপত্রিকায় এবং টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলে দেশের বিশিষ্ট আইনজ্ঞ, রাজনীতিবিদ এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মধ্যে অনেকেই বক্তব্য দিয়েছেন। তাদের পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণেই জনমনে সংবিধানের বর্তমান অবস্থান নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। সংবিধান সংশোধন বিষয়ে দেশে এবং বিদেশে প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতির আলোকে এ সংশয় দূরীকরণের জন্য এই লেখা।
বাংলাদেশের জনগণের রাষ্ট্রচিন্তার অভিপ্রায়ের বহিঃপ্রকাশই হচ্ছে সংবিধান। জনগণ এ সংবিধানের দশম ভাগে সংবিধান সংশোধন বিষয়ে তাঁদের অভিপ্রায়ের বিষয়টি রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনাকারীদের নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। সংবিধান সংশোধনসহ কোনো আইন তৈরি বা সংশোধনের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হচ্ছে 'জাতীয় সংসদ'। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, সংবিধান সংশোধনে সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ার নিয়ে। সংবিধানে কিছু বাক্য কেটে দিয়ে অন্য কিছু লিখে দেওয়া কিংবা সংসদ কর্তৃক বিলুপ্ত করা কিছু বাক্য বা শব্দ ওই সংবিধানে পুনঃস্থাপন করে দেওয়ার সাংবিধানিক এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের আছে কি না? বিষয়টি গভীরভাবে পরীক্ষা করে দেখা যায়, সংসদের প্রণীত আইন সংবিধানসম্মত না হলে তা বাতিল ঘোষণা করার এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট কোনো আইন বাতিল ঘোষণা করলে সে ক্ষেত্রে সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইনের কার্যকারিতা লোপ পায়। এভাবে কার্যকারিতা লোপ পাওয়ার অর্থ এ নয় যে কার্যকারিতা লোপ পাওয়া বিধানিক অক্ষরগুলো মূল আইনের যথাস্থান থেকে উঠে যাবে কিংবা উঠিয়ে দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্ট আদেশ দিতে পারবে। পূর্ণ সুবিচার (ঈড়সঢ়ষবঃব ঔঁংঃরপব) অভিব্যক্তি এ দর্শন সমর্থন করে না। কোনো বিষয়ে আইন বা পদ্ধতি অপর্যাপ্ত হলে সে ক্ষেত্রে পূর্ণ সুবিচার করার এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধনের দায়িত্ব পালনে জনগণ সংবিধানে পদ্ধতি ও কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট কোনো আইনকে অকার্যকর ঘোষণা করার অর্থই হলো, যে মুহূর্তে সুপ্রিম কোর্ট এ ঘোষণা দেবেন সে মুহূর্ত থেকে ওই আইনের প্রয়োগ রহিত হয়ে যাবে। এ ধরনের রহিত হওয়া বিধানের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট ভিন্ন কিছু না বললে অকার্যকর ও বাতিল ঘোষিত বিধান জন্মকালে মৃত বলে ব্যাখ্যা করা হবে। সুপ্রিম কোর্টের এ ধরনের কোনো এখতিয়ার নেই, যার দ্বারা সংসদ প্রণীত আইনের অক্ষরগুলো তুলে দিয়ে সেখানে আগের অক্ষর বসিয়ে দেওয়া কিংবা ইচ্ছামতো কিছু অক্ষর লিখে দেওয়া যাবে।
যদি এমন হয় যে সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদ সংশোধন, বিয়োজন, সংযোজন সুপ্রিম কোর্ট অবৈধ বা বাতিল ঘোষণা করার পর সংসদ চুপ থেকেছে কিংবা রায় বিবেচনা করে সংবিধানে প্রতিফলন ঘটানোর জন্য কোনো দলেরই সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। সে ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগ কি বসে থাকবে? না, বসে থাকবে না। নির্বাহী বিভাগ দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারের জন্য সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করে নিতে পারবে। এখন প্রশ্ন হলো, পুনর্মুদ্রণ কিভাবে করতে হবে, তা নিয়ে। পুনর্মুদ্রণকালে সংসদ কর্তৃক তৈরি বা লিখে দেওয়া বিধানিক অক্ষরগুলো যথাস্থান থেকে সরিয়ে দেওয়ার এখতিয়ার নির্বাহী বিভাগের আছে কি না, এই এখতিয়ার যেমন সুপ্রিম কোর্টের নেই, তেমনি নির্বাহী বিভাগেরও নেই। নির্বাহী বিভাগ এ ক্ষেত্রে যে কাজটি করতে পারবে, তা হলো পুনর্মুদ্রণকালে বাতিল ঘোষিত অক্ষর বা অংশটি যথাস্থানে রেখে ওই অংশকে চিহ্নিত করে নিচে ফুটনোট দিয়ে ওই অংশটি সুপ্রিম কোর্ট বাতিল ঘোষণা করেছে মর্মে ব্যবহারকারীদের জানিয়ে দেওয়া। একইভাবে ওই বাতিলের ফলে প্রচলিত বা পুনরুজ্জীবিত বিধানটিও ফুটনোটে উল্লেখ করে দেওয়া। এটিই হচ্ছে সারা বিশ্বে প্রচলিত এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা। কিন্তু আমাদের দেশে ব্যতিক্রমধর্মী একটি ব্যবস্থা সম্প্রতি উদাহরণ হিসেবে উঠে এসেছে। তা হলো সংবিধান অষ্টম সংশোধনী মামলা, যার দ্বারা সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানে অনুচ্ছেদ ১০০ প্রতিস্থাপনসংক্রান্ত সংশোধন বাতিল ঘোষণা করে পূর্বের অনুচ্ছেদ পুনঃপ্রচলন (restored) করেছে। এ রায়ের প্রেক্ষিতে ১৯৯০ সালের ৩১ ডিসেম্বর নির্বাহী বিভাগ সংসদের গেঁথে দেওয়া বিধানিক অক্ষরগুলো সংবিধান থেকে সরিয়ে তদস্থলে সংসদ কর্তৃক বিলুপ্ত করা অক্ষরগুলো বসিয়ে দিয়েছে এবং সংসদের গেঁথে দেওয়া অক্ষরগুলো ফুটনোটে উল্লেখ করে দিয়েছে। এটি হওয়ার পেছনে অনেকেই কারণ হিসেবে বলে থাকেন আপিল বিভাগের যে বিচারপতি এ রায়টি লিখেছিলেন, তিনি পরবর্তীকালে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনকালে তাঁর তত্ত্বাবধানে আইনসচিব ওই ব্যবস্থায় সংবিধানটি পুনর্মুদ্রণ করেছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে যে কাজটি করা হয়েছে সেই কাজটিকে নজির হিসেবে উল্লেখ করে আলোচনার ঝড় তোলায় জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্ট রায় দেওয়ার পর সংসদ কর্তৃক তা গ্রহণ বা বাতিল করে সংবিধান সংশোধন না করা পর্যন্ত ওই রায়টি বলবৎযোগ্য কি না কিংবা ওই রায় দ্বারা সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে কি না। উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ। তবে আক্ষরিক নয়, প্রায়োগিক সংশোধন হয়েছে। কোনো ব্যক্তি ওই পরিস্থিতিতে কোনো সাংবিধানিক ইস্যু নিয়ে যখন আদালতে যাবেন কিংবা নির্বাহী বিভাগ বা সংসদের যখন সংবিধানের সর্বশেষ প্রায়োগিক অবস্থান জানার প্রয়োজন হবে তখনই সংবিধানের সর্বশেষ অবস্থান হয়ে দাঁড়াবে সুপ্রিম কোর্টের রায়সহ, রায় বাদ দিয়ে নয়। এতে তর্কের কিছু নেই। কারণ সুপ্রিম কোর্টের ঘোষিত আইনও সংসদের প্রণীত আইনের ন্যায় বলবৎযোগ্য আইন। সংসদের আইন এবং সুপ্রিম কোর্টের ঘোষিত আইনের প্রয়োগ প্রকৃতি অভিন্ন হলেও জন্ম প্রকৃতিতে ভিন্নতা রয়েছে। এ কারণে এ ভিন্ন প্রকৃতির আইনের নিবাসও ভিন্ন দুটি জায়গায়। সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইনের স্থান হয় 'ঝঃধঃঁঃব ইড়ড়শ'-এ অর্থাৎ বাংলাদেশ কোডে। আর সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক ঘোষিত আইনের স্থান হয় ল' রিপোর্টগুলোতে।
সংসদ আইন তৈরি করে, আইন প্রয়োগের দায়িত্ব পালন করে না, বিচার করে রায় ঘোষণা করে না। তেমনি সুপ্রিম কোর্ট সংসদের তৈরি কোনো আইন অসাংবিধানিক বা বৈধ ঘোষণা করতে পারে, মূল আইনে কোনো বাক্য বা অক্ষর লিখে দিতে পারে না। সংসদের তৈরি কোনো আইনে কোনো কিছু লিখে দেওয়ার এখতিয়ার যেমন সুপ্রিম কোর্টের নেই তেমনি এমন ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগেরও নেই। সংসদের প্রণীত কোনো আইনে কিছু লিখতে হলে বা বাদ দিতে হলে, তা সংশোধনী আনয়নের মাধ্যমে সংসদকেই করতে হবে, অন্য কেউ নয়। এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ উল্লেখ করতে চাই। অনেক সময় সংসদ এমন অনেক আইন প্রণয়ন করে থাকে, যা প্রণয়নের সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হয় না। পরবর্তী কোনো সময়ে এটা কার্যকর করার জন্য সরকারকে ক্ষমতা দেওয়া হয়। এ ধরনের আইন প্রণীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে Statute Book-এ স্থান করে নেয় এবং বিধানিক অক্ষরগুলো সুপ্ত অবস্থায় থাকে। সুপ্ত থাকার কারণে নির্বাহী বিভাগ যেমন এ আইনটিকে Statute Book-এ অন্তর্ভুক্তি থেকে বাদ দিতে পারে না, ঠিক তেমনি সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক বাতিল বা অসাংবিধানিক ঘোষিত বিধানিক অক্ষরগুলো অকার্যকর হওয়ার অজুহাতে যথাস্থান থেকে সরানো যাবে না, অকার্যকর অক্ষরগুলো আইনের মূল জায়গায় দৃশ্যত থেকে যাবে। এটি সুপ্রিম কোর্টও সরাতে পারবে না। নির্বাহী বিভাগও সরাতে পারবে না। সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী এটাকে সরানো কিংবা এটাকে পুনরুজ্জীবন দান সংসদকেই করতে হবে, অন্য কেউ পারবে না। এটিই হচ্ছে সংসদ কর্তৃক সংবিধানের আক্ষরিক সংশোধন। এ ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগ বা বিচার বিভাগ কারো নেই।
আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ_প্রত্যেকের ক্ষমতার পরিধি সংবিধান দ্বারা জনগণ কর্তৃক নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। প্রত্যেকেরই নিজ নিজ ক্ষমতার পরিধি অতিক্রম না করাই হচ্ছে আইনের শাসন। গণতান্ত্রিক সমাজে যা অতি প্রয়োজন। এর ব্যত্যয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আমি আগেই বলেছি, সুপ্রিম কোর্ট রায় দিলেই প্রায়োগিক সংশোধন হয়ে যায়। তবে আক্ষরিক সংশোধন সংসদকে করতে হয়। এটাই হচ্ছে সংশোধন পদ্ধতি।
পরিশেষে বলা যায়, সবারই মুখ্য উদ্দেশ্য সংবিধান সংশোধন। বিতর্কটি ছিল পদ্ধতি নিয়ে। দুটি পদ্ধতিতে যে সূক্ষ্ম ভিন্নতা আছে সেটিই আমি আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। সংবিধান সংশোধন বিতর্কে জড়ানো উভয় পক্ষের অবস্থান নিজ নিজ আঙ্গিকে সঠিক। আমি আশা করব দুই পক্ষেরই এখানে হার-জিতের কোনো কিছু নেই। জিততে হবে সুষ্ঠু, ন্যায়ানুগ পদ্ধতির। তার পরও বলা যায়, পার্থক্য খুবই সূক্ষ্ম, যে কারণে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
লেখক : আইন গবেষক

No comments

Powered by Blogger.