আইলার দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি-আরও বহু দূর যেতে হবে

২০০৯ সালে বৃহত্তর খুলনা ও বরিশাল জেলার মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আইলার দুই বছর পরও ওই এলাকা থেকে ক্ষতচিহ্ন মুছে যায়নি। বিশেষ করে ওই দুর্যোগের মূল আঘাতকেন্দ্র সাতক্ষীরা ও খুলনায় এখনও কেন স্বাভাবিক জীবন ও প্রকৃতি ফিরে আসেনি তার কারণ বহুবিধ।
অস্বীকার করা যাবে না যে বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের বিরূপ প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হয়ে থাকে। মানুষ যদিও ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়, তীব্র ঝড় ও লোনা প্লাবনে বিপর্যস্ত প্রকৃতি একটু সময় নেয়। কিন্তু আইলার দুই বছরপূর্তি উপলক্ষে সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে দেখা যাচ্ছে, এই দীর্ঘ সময়ে কোনো পক্ষই ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি_ না মানুষ, না প্রকৃতি। আমরা মনে করি, বৃহত্তর খুলনার উপকূলীয় জনপদগুলোতে আইলার ধ্বংসযজ্ঞ এখনও যেভাবে মুখব্যাদান করে আছে, তার দায় অনেকখানি নিতে হবে আমাদের কর্তাব্যক্তিদের। দুই বছর পরও ওই এলাকার ভূমি আবাদযোগ্য না হওয়ার মূল কারণ লোনা পানির আগ্রাসন। কেবল আইলার প্লাবন নয়, গত দুই বছরের প্রতিটি জোয়ার-ভাটা কিংবা সামুদ্রিক নিম্নচাপে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের দক্ষিণ জনপদগুলোতে লোনা পানি প্রবেশ করেছে। উপকূলীয় বাঁধগুলো যথাসময়ে মেরামত ও সংস্কার করা সম্ভব হলে এই আগ্রাসন নিঃসন্দেহে প্রতিরোধ করা সম্ভব হতো। দুর্ভাগ্যক্রমে নানা জটিলতায় জরুরি ওই কাজে অস্বাভাবিক বিলম্ব ঘটেছে। যেভাবে বাঁধগুলো মেরামত করা হয়েছে, তার কার্যকারিতা ও স্থায়িত্বও প্রশ্নহীন নয়। সমকালের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, সাতক্ষীরায় ধসে যাওয়া বেশ কিছু বেড়িবাঁধের ক্লোজার নির্মাণ কাজ এক মাস আগে শেষ হলেও বিভিন্ন এলাকায় বাঁধে নতুন করে দেখা দিয়েছে ফাটল। আমাদের মনে আছে, নতুন বাঁধ নির্মাণের অব্যবহিত পরেই ফের ধসে যাওয়ার কয়েকটি ঘটনাও সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছিল। বাঁধ মেরামত, সংস্কার বা নির্মাণের জন্য দরপত্র থেকে তদারকি পর্যন্ত নানা অনিয়মেরও অভিযোগ উঠছে। আমরা মনে করি, জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে উপকূলীয় অঞ্চলকে রক্ষার ক্ষেত্রে মজবুত ও কার্যকর বাঁধের বিকল্প নেই। এটা এখন প্রতিষ্ঠিত যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সামনের দিনগুলোতে বড় বড় জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা ও সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়বে। সেক্ষেত্রে বাঁধের উচ্চতা বাড়ানোও জরুরি। এ ব্যাপারে সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীদের দ্বিমত নেই। কিন্তু দায়সারা কাজ ও দুর্নীতির কারণে গুরুত্বপূর্ণ সেই উদ্যোগ ভেস্তে যেতে দেওয়া যাবে না। আমরা বিশেষভাবে বাঁধ নির্মাণ কার্যক্রমকে কড়া তদারকির আওতায় আনার দাবি জানাই। বাঁধ ভাঙা ও গড়ার মধ্য দিয়ে দুর্নীতির এক দুষ্টচক্র গড়ে উঠেছে বলে যে অভিযোগ বিভিন্ন সময়ে উত্থাপিত হচ্ছে, তাও গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখার আহ্বান জানাই আমরা। মনে রাখা জরুরি, উপকূলে মজবুত বাঁধই লোনা পানির আগ্রাসন রোধের কার্যকর উপায় হতে পারে। কেবল বাঁধ নির্মাণ নয়, পুনর্বাসন কার্যক্রমের অন্যান্য দিকেও কড়া নজরদারি প্রয়োজন। প্রয়োজন আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসনও। দুই বছর পরও আইলাদুর্গতরা যেভাবে কর্মসহায়-সম্বলহীন অবস্থায় অপরের দয়ার ওপর নির্ভর করে আছে, তা মেনে নেওয়া কঠিন। প্রায় এক বছর আগে আইলাদুর্গত এলাকা পরিদর্শনকালে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত পরিবারপ্রতি নগদ অর্থ সহায়তা এখনও কেন মানুষের হাতে পেঁৗছাচ্ছে না, তার ব্যবচ্ছেদ করলেই আইলাদুর্গত এলাকার অনেক সংকটের মূল কারণ স্পষ্ট হবে। বস্তুত সিডর-আইলা ক্ষত সারিয়ে তুলে উপকূল নিরাপদ রাখতে হলে এক দীর্ঘ ও বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হবে। সেক্ষেত্রে দূরদর্শিতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিকল্প নেই।

No comments

Powered by Blogger.