চারদিক-ভূত তাড়ানোর পর বিয়ে

চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিল বৈলঠা কোলপাড়াতেই বোধ হয় আজ রাতটা থেকে যেতে হবে, বৃষ্টির এমনই ভাব। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। বিল বৈলঠা কোল আদিবাসী পাড়ার একটা ছোট্ট ঘরে বসে পরিণতির কথা ভেবে চিন্তায় পড়েছি। আমি আনোয়ার হোসেন, মানে আমাদের দিলু ভাইয়ের দিকে তাকাই, দিলু ভাই তাকান বৃষ্টির দিকে। বেখেয়ালে একসময় দিলু ভাইয়ের মাথার ওপর চাল থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। কিন্তু বৃষ্টিতে আমরা এতই বিভোর যে সেদিকে খেয়াল নেই।


শেষে রুপালি হাজরা মেয়েটা ‘ভিজে যাচ্ছেন তো’ বলে হাঁক ছাড়তেই দিলু ভাইয়ের হুঁশ হলো। সরে বসলেন। এমন সময় পাশে এসে দাঁড়ালেন দুলালী রায়। দুলালী এ পাড়ারই বউ, জাতে খাঁটি বাঙালি হিন্দু। বিয়ে হয়েছে কোল আদিবাসী পরিবারে। কার্তিকপুরে বাপের বাড়ি। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছেন? মানিয়ে নিতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না?
দুলালী একটু হাসলেন। বললেন, ‘সে রকম কিছু না। আমরা হিন্দু। তাই ওদের অনেক আচার-অনুষ্ঠানই আমাদের সাথে মেলে। তবে খাদ্য-খাবারে কিছু পার্থক্য দেখা যায়।’
কোলদের বিয়ে আর আপনাদের বিয়ে কি একই নিয়মে হয়?
‘না, হুবহু মেলে না। কোলদের বিয়ের বিশেষ কিছু নিয়ম আছে, যেগুলো আমাদের নেই। আমাদের বিয়ে হয় দুই দিন ধরে। প্রথম দিনে বিয়ে, দ্বিতীয় দিন বাসি বিয়ে। আছে সাতপাকে বাঁধা। কোলদের সে রকম কিছু নেই। তা ছাড়া শুনেছি কোলদের বিয়েতে বরযাত্রার আগে ভূত তাড়ানো হয়। কনের বাড়িতেও সে রকম কিছু করা হয়। হিন্দু বিয়েতে সে রকম কিছু করা হয় না।’
ভূত তাড়ানো মানে? বিয়েতে কি ভূতের উপদ্রব হয় নাকি?
দুলালী এ বিষয়ে আর বিশেষ কিছু বলতে পারলেন না। কী আর করা? অবশেষে দিলু ভাই-ই কল্পনা মুরমুকে নানা রকম প্রশ্ন করে কোল বিবাহ সমাচার সংগ্রহ করে ফেললেন। সাংবাদিক বলে কথা। দিলু ভাই আর কোল-কন্যা কল্পনা মুরমুর কথাবার্তার মাধ্যমে কোল আদিবাসীদের বিয়ে সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা পেয়ে গেলাম। কোল বিয়েতে ছেলে ও মেয়ে পক্ষের মধ্যে যোগাযোগকারী হিসেবে একজন ঘটক লাগে। ঘটককে তাঁরা বলেন আইবেরি। কোলেরা সাধারণত নিজেদের গোত্রের মধ্যেই বিয়ের জন্য চেষ্টা করে। কিন্তু এ দেশে কোল আদিবাসীর সংখ্যা এত কম যে তারা এখন নিজেদের মধ্যে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিতে গেলে অনেক সময় পূর্ব আত্মীয়তার পরিচয় পাওয়া যায়। এ জন্য সম্প্রতি কোল আদিবাসীরা বাঙালি হিন্দুদের সঙ্গেও ছেলেমেয়ে বিয়ে দিচ্ছে। উপযুক্ত ছেলে বা বিবাহযোগ্য মেয়ের সন্ধান এনে দেন ঘটক। অথবা কোনো কোল পরিবার কোথাও উপযুক্ত পাত্রপাত্রীর সন্ধান জানলে, সেখানে প্রস্তাব নিয়ে ঘটক পাঠায়। দুই পক্ষ সম্মত হলে বিয়ের দিন ধার্য হয়। বিয়ের দিন বর ও কনে উভয় পক্ষের বাড়িতেই সকাল থেকে শুরু হয় নানারকম আচার-অনুষ্ঠান। এর মধ্যে থানপূজা অন্যতম। ভবিষ্যৎ দম্পতির সুখের মিলন ও মঙ্গল কামনাই এ পূজার উদ্দেশ্য।
সাধারণত দুপুরের দিকে এটা করা হয়। উভয় পক্ষের বাড়ির উঠানে প্রশস্ত জায়গায় একটা ‘থান’ (স্থান) ঠিক করা হয়। ওই জায়গায় নানারকম আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এক কোপে একটা পাঁঠা বলি দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি ভূত তাড়ানোর দায়িত্ব নেয়, ওই ব্যক্তি বলি দেওয়া পাঠার কাঁচা রক্ত খায়। সাধারণত মুরব্বিগোছের কেউ যেমন—কাকা, মামা, জ্যাঠা-সম্পর্কীয় ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ছেলে ও মেয়ের বাড়িতে এই ভূত তাড়ানোর কাজ করে থাকেন। নানারকম আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে তা করা হয়। বর ও কনের বাড়িতে এই অনুষ্ঠানের লৌকিক আচারের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য দেখা যায়। যিনি ভূত তাড়ান, তাঁকে বলে আডা। আডা একটা বড় পিঁড়ির ওপর কনেকে বসিয়ে নেচে নেচে কনেকে নিয়ে ঘুরতে থাকেন। এ সময় তিনি গান করেন ও নাচেন, ভূত তাড়ান। এরপর সাদা ধুতি কাপড় ও গেঞ্জি পরে বর বা কনের বাড়ির চারপাশে ঘুরতে থাকেন এবং নানারকম বাক্য বলতে থাকেন। প্রায় দৌড়ে দৌড়ে তিনি বাড়ির চারপাশে ঘুরতে থাকেন এবং ভূতদের উদ্দেশে মন্ত্রগোছের কিছু কথা বলতে থাকেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে বিয়েবাড়িতে আসা এবং ওই বাড়ির কিছু লোক মিছিলের মতো চলতে থাকে। সেই সঙ্গে ঢোলক ও মাদল বাজতে থাকে। বাড়ি প্রদক্ষিণ শেষে ভূত তাড়ানো ব্যক্তি থানে ফিরে আসেন। থানে একখানা বড় ও লম্বা থান কাপড় দিয়ে বলি দেওয়া পাঁঠা ঢেকে রাখা হয়। ভূত তাড়ানো ব্যক্তি কাপড়ের নিচে ঢুকে ওই পাঁঠার তাজা রক্ত পান করেন। এ সময় জোরে জোরে ঢোলক ও মাদল বাজতে থাকে। স্থানবিশেষে কোথাও কোথাও দামাই-নাচ নাচা হয়। চৈত্র মাসে কোল আদিবাসীদের বিয়ে বেশি হয়, বৈশাখ ও ভাদ্রে কোনো বিয়ে হয় না। ভূত তাড়ানো একটি রূপক অনুষ্ঠান। এর মাধ্যমে মূলত দুটি বাড়িকেই অপদেবতা ও অমঙ্গলমুক্ত করা হয়। এরপর যথারীতি বিকেল বা সন্ধ্যাবেলা বরপক্ষ তার লোকজন নিয়ে কনের বাড়িতে যায়। রাতে বিয়ে হয়। হিন্দুদের বিয়েতে লাগে যৌতুক, কোল বিয়েতে লাগে পণ। ছেলেপক্ষ থেকে কনেপক্ষকে পণ দেওয়া হয়। তবে সে পণ শাড়ি বা কাপড়চোপড়, চাল ইত্যাদি দ্রব্যসামগ্রী। বিয়ের পরের দিনই কনেকে বর নিজেদের বাড়িতে নিয়ে আসে ও সংসারজীবন শুরু করে।
মৃত্যুঞ্জয় রায়

No comments

Powered by Blogger.