শ্রদ্ধাঞ্জলি-ইতিহাস ধরে রেখেছেন রশীদ ভাই by হারুন হাবীব

বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে যে রশীদ তালুকদারের সুগভীর সম্পর্ক, সেই খ্যাতিমান আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদার বিদায় নিলেন পৃথিবী থেকে ২৪ অক্টোবর। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর জামালপুর এবং ময়মনসিংহ মুক্ত হলো। বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আবদুল আজিজের নেতৃত্বে আমাদের মুক্তিবাহিনীর দলগুলো ময়মনসিংহ টাউন হলে অবস্থান নিল। কিন্তু ঢাকার পথে পা বাড়ানো হলো না আমার। আহত হয়ে পড়ে থাকলাম ময়মনসিংহে।


হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যদের ১৬ ডিসেম্বরের ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণের দৃশ্য দেখার ভাগ্য আমার হলো না। দেড় সপ্তাহ পর ঢাকায় ফিরে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই পেশা হিসেবে বেছে নিলাম সাংবাদিকতা। আমি রিপোর্টার, লেখালেখির কাজ, ছবি তোলা আমার কাজ নয়। তবু বলতে গেলে পেশায় ঢোকার প্রায় প্রথম দিন থেকেই বয়োজ্যেষ্ঠ রশীদ ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠল।
অবশ্য রশীদ তালুকদার নামটির সঙ্গে গোটা দেশই পরিচিত তখন। এর একমাত্র কারণ, খ্যাতিমান এই আলোকচিত্রীর ক্যামেরায় বন্দি হওয়া জাতীয় ইতিহাসের অসংখ্য ছবি, যা সেদিনকার পত্রপত্রিকার পাতায় স্থান পেয়ে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান আলোড়িত করেছিল। রশীদ ভাই তখন দৈনিক সংবাদের স্টাফ ফটোগ্রাফার। সম্ভবত ১৯৬২ থেকে এক যুগেরও বেশি কাজ করেন তিনি দেশের সর্বপ্রাচীন ও এককালের বহুলপঠিত দৈনিকটিতে। এরপর ১৯৭৫ সালে যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে।
বলিষ্ঠ শরীর এবং ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন এই মানুষটি এতই ভাগ্যবান যে তিনি তাঁর স্বদেশের প্রায় প্রতিটি ইতিহাস সৃষ্টিকারী ঘটনার ছবি তোলার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের উত্তাল গণ-অভ্যুত্থান এবং সত্তরের দেশ কাঁপানো অসহযোগ আন্দোলন তাঁর ক্যামেরায় বন্দি। সেদিনকার রমনা রেসকোর্সে ৭ মার্চে ভাষণরত বঙ্গবন্ধুর যে ঐতিহাসিক ছবিগুলো তিনি তুলেছিলেন, সে ছবি যুগ যুগান্তর ধরে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস মনে করিয়ে দেবে। শুধু তা-ই নয়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা নগরীতে পাকিস্তানি গণহত্যার অসংখ্য ছবি ক্যামেরাবন্দি করেন তিনি। এ রকম বিরল কৃতিত্ব খুব কম আলোকচিত্রীরই রয়েছে।
আমি প্রেসক্লাবে খুব একটা নিয়মিত নই। কিন্তু রশীদ ভাই এবং তাঁর সময়কার আলোকচিত্রীরা সকাল-বিকেল প্রেসক্লাব কেন্দ্র করেই কাটাতেন। যদ্দূর মনে পড়ে, তাঁর একটি ভেসপা মোটরসাইকেল ছিল। কাঁধে ক্যামেরা ঝোলানো রশীদ ভাই এ বাহনটিতেই চাপতেন বহুকাল। সংবাদচিত্রের খোঁজে মুহূর্তে প্রেসক্লাব থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতেন ঢাকা নগরীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব এবং যুদ্ধকালীন দুজন কৃতী আলোকচিত্রীকে আমি ঘনিষ্ঠভাবে জেনেছিলাম। তাঁদের একজন মোহাম্মদ আলম, অন্যজন রশীদ তালুকদার। মোহাম্মদ আলম কয়েক বছর আগেই চলে গেছেন। এবার চলে গেলেন রশীদ ভাই। বাংলাদেশ প্রেস ইন্টারন্যাশনাল ও বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় দীর্ঘকাল পেশাজীবন কাটানোর সুবাদে সাংবাদিকতা পেশার বহু মানুষকে জানার সুযোগ হয়েছে। অনেকের সঙ্গে সম্পর্ক গভীরও হয়েছে। কিন্তু রশীদ ভাই এবং মোহাম্মদ আলমের কথা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমাকে মনে করতে হবে। এমন উদার, প্রাণখোলা মানুষ, এমন সাহসী ও পরিপূর্ণ মানুষ তাঁরা, যেন পৃথিবীর প্রতিটি দুঃখ-যন্ত্রণাকে অট্টহাসি আর দুর্বিনীত মনোবল দিয়ে পরাজিত করার যোগ্যতা রাখেন তাঁরা!
রশীদ তালুকদার প্রথম বাংলাদেশি, যিনি আন্তর্জাতিক 'পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড' লাভ করেন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি প্রতিবছর বিশ্বের একজন সেরা ফটো সাংবাদিককে এ পুরস্কার দিয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক এ পুরস্কারের প্রধান উপলক্ষ ছিল রশীদ তালুকদারের তোলা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ছবি।
তিনি জাপান ফটোগ্রাফিক সোসাইটি ও আশাহি সিমবুন থেকে সেরা আলোকচিত্রীর পুরস্কার, ইউনেসকো, থাইল্যান্ড ও বিপিএস স্বর্ণপদকসহ দেশি-বিদেশি অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেন।
দৈনিক ইত্তেফাকে টানা ২৯ বছর চাকরি করে ২০০৭ সালে রশীদ তালুকদার অবসরে যান। পেশাগত জীবনে আমি আলোকচিত্রী নই। কিন্তু আমার সঙ্গে রশীদ ভাইয়ের সম্পর্কের একটি বড় উপলক্ষ হয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের ছবি। নানা রণাঙ্গনে প্রিয় স্টেনগানটির সঙ্গে ক্যামেরাও সঙ্গী হয় আমার। আলোকচিত্রী না হয়েও কি মনে করে যুদ্ধ-কর্মকাণ্ডের ফাঁকে ক্যামেরাবন্দি করি আমি সময়ের চিত্র। একবারও ভাবিনি এগুলোই একদিন কথা বলবে। এসব ছবি ও নেগেটিভগুলো কী করে সংরক্ষণ করা যায়, এ নিয়ে বহুবার আমি রশীদ তালুকদারের পরামর্শ নিয়েছি। আমার বয়োজ্যেষ্ঠ রশীদ ভাই আজ চলে গেলেন, সব স্মৃতি নিয়ে আমি এই কীর্তিমানকে শ্রদ্ধা জানাই।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও কথাশিল্পী
hh1971@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.