একসঙ্গে আন্দোলন করলেই অধিকার আদায় সম্ভব

৯ জুলাই প্রকাশিত হবে বিভিন্ন সময় গাওয়া শ্রোতাপ্রিয় ৪০টি গান নিয়ে কুমার বিশ্বজিতের এক মোড়কে চারটি অ্যালবাম। অ্যালবাম ও অন্যান্য প্রসঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রবিউল ইসলাম জীবন একসঙ্গে চারটি অ্যালবাম প্রকাশ করতে যাচ্ছেন। এমন ইচ্ছা কিংবা পরিকল্পনা কিভাবে মাথায় এল?
ইচ্ছাটা ছোটবেলা থেকেই। যখন বড় শিল্পীদের সংকলিত গানের অ্যালবামগুলো দেখতাম বঙ্ আকারে, তখন মনে হতো, আমিও যদি কখনো নিজের গান নিয়ে এমন অ্যালবাম করতে পরতাম! সৃষ্টিকর্তা আমাকে ইচ্ছাটি পূরণ করার সামর্থ্য দিয়েছেন। গানের সংখ্যাও দিয়েছেন। একসঙ্গে চারটি অ্যালবাম বের হচ্ছে আমার। ভাবতেই ভালো লাগছে। অ্যালবামগুলোর নাম 'মেঘের পালকি', 'একটা আকাশ', 'স্বপ্নের আনাগোনা' ও 'প্রেমের আবাস'।
এই গানগুলো তো বিভিন্ন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের। তাদের অনুমতি নিয়েছেন?
এটা আমার সংগীতজীবনের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা। প্রতিটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আমাকে অনেক সাহায্য করেছে গান দেওয়ার ব্যাপারে। এ নিয়ে আমি দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলাম। কিন্তু সবার আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ!
গানগুলোর গীতিকার-সুরকারদের সঙ্গে কথা হয়েছে?
প্রত্যেক গীতিকার-সুরকারের সঙ্গে আমি ব্যক্তিগতভাবে কথা বলেছি। তাঁরাও চেয়েছেন তাঁদের গানগুলো এই প্রজন্মে আসুক। আসলে একজন সৃষ্টিশীল মানুষ পয়সার চেয়ে তাঁর সৃষ্টির প্রচারই কিন্তু বেশি চান। আর আমাদের দেশের গীতিকার-সুরকাররা সারা জীবন অর্থের পেছনে দৌড়াননি। নিজেদের সৃষ্টির পেছনে দৌড়েছেন।
এই ৪০টি গানের কোনটা আপনার কাছে আলাদা? কেন?
প্রতিটি গানই আমার কাছে সমান প্রিয়। তাই আলাদাভাবে একটা গানের কথা বলা কঠিন! তবে এটা বলতে পারি, এই ৪০টা গানই মানুষের পছন্দের। আমার ভালো লাগার।
সংগীতজীবন শুরুর সময় আর এখনকার মধ্যে কোন পার্থক্যটা আপনাকে ভাবায়?
প্রযুক্তি। আমরা যখন শুরু করেছিলাম তখন প্রযুক্তি এত উন্নত ছিল না। মনে হয়, যদি আরো ৩০ বছর পর জন্ম নিতাম তাহলে এই সময়টা পেতাম। প্রযুক্তি শিল্পীদের জন্য অনেক সহায়ক। এত সুন্দর সাউন্ড, এত সুন্দর যন্ত্র! এগুলো তো আগে ছিল না। এ জন্য মনে হয় আমরা প্রযুক্তির দিক থেকে অনেক বেশি এগিয়েছি সৃষ্টির তুলনায়।
এর মানে সৃষ্টি আগেই ভালো ছিল?
এটা সর্বজনবিদিত যে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সময় আশি-নব্বইয়ের দশক। এখন যা হচ্ছে ওটাকে ভেঙেই হচ্ছে। এটা সারা পৃথিবীতেই।
এখনকার সংগীতকে আপনি কিভাবে দেখেন?
এখনকার সংগীত মেশিননির্ভর। এটাকে আমি মেশিনগান বলি। আমরা যে সূক্ষ্ম অনুভূতির জাতি, আমাদের মধ্যে যে ছোট ছোট অনুভূতি আছে এটা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এত অভিমানও নেই। আমাদের দেশে এখনো একান্নবর্তী পরিবার আছে। একতরফা প্রেম আছে। বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষই গ্রামে বাস করে। যতই আধুনিকতা আসুক, আমাদের শিকড়টাকে মনে রাখতে হবে। এখনকার গানে তো ইন্টারলিউড প্রিলিউডই নেই। গানের মধ্যে পরিশ্রম কম মনে হয়। যে কেউ চাইলেই গান করতে পারে। এ কারণে মাঝেমধ্যে এ পেশার প্রতি রাগ হয়, অভিমান হয়। মন চায় ছেড়ে দিই। পৃথিবীতে সবচেয়ে সহজ কাজ মনে হয় গান গাওয়াটাকে। এই অটোটিউনার নামক যন্ত্রটিকে যদি উপড়ে ফেলা যেত তাহলে বোধ হয় বাংলাদেশের সংস্কৃতিটা আরেকটু পরিচ্ছন্ন হতো।
ব্যক্তি কুমার বিশ্বজিতের কি পরিবর্তন ঘটেছে?
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই একটা ট্রানজেশন টাইম আছে। এটা প্রজন্মের পর প্রজন্ম হচ্ছে। আমার মধ্যে তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। আশির দশকে যে তারুণ্য ছিল এখনো আমি সেটা অনুভব করি। বয়স বাড়লেও মানসিকভাবে আমি তরুণই আছি! তবে দিন দিন দায়িত্ববোধ বাড়ছে। আগে হয়তো নিজেকে নিয়ে চিন্তা করতাম বেশি, এখন পরিবার নিয়েও ভাবতে হয়।
ছেলেবেলার কোন জিনিসটা আপনি বেশি মিস করেন?
টিনএজ বয়সেই আমার পরিচিতি চলে আসে। যে সময়টা মানুষের উচ্ছ্বাস করার, আনন্দ করার! তাই স্কুলজীবনটাই সবচেয়ে বেশি মিস করি। স্কুল থেকে ফিরে ঘুড়ি ওড়ানো, লাটিম ঘোরানো, তাস খেলা, আম কুড়ানো, পাখির বাসা থেকে ডিম পাড়া, সিতাকুণ্ডুতে মেলায় যাওয়া_এ বিষয়গুলোর কথা মনে পড়ে। এখন তো জনসম্মুখে যেতে পারি না। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে ফুটবল খেলতে। শীতকালে মাঠে গিয়ে একটু ব্যাডমিন্টন খেলতে। ওপেনলি বাজারে ঘুরতে চাইলেই তো এসব আর এখন সম্ভব নয়।
এই প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে কার কণ্ঠ আপনার ভালো লাগে?
ন্যান্সির গলাটা আমার কাছে দারুণ লাগে। অন্য যে কারো চেয়ে তার গলাটা আলাদা।
কার সুর-সংগীত আপনার পছন্দ?
হাবিব ওয়াহিদ। সংগীতের পাশাপাশি হাবিবের সুরটাও আমাকে বেশ টানে। তার গাওয়া কিছু গানও আছে যেগুলো মনকে খুব সহজে নাড়া দেয়। অন্য রকম অনুভূতির সৃষ্টি করে।
হাবিবের সুরে তো 'প্রজাপতি' (ছোট গল্প) চলচ্চিত্রে আপনি কাজও করেছেন? কাজ করার গল্পটা যদি শোনাতেন...
ফেরদৌস ভাই একদিন আমাকে ফোন দিয়ে বলেন, 'হাবিব তো তোমার জন্য একটা গান করতে চায়। তুমি কী বল?' বলি, করব না কেন? অবশ্যই করব। পরে হাবিব জানায় সে অনেক চিন্তাভাবনা করে গানটি করেছে। একদিন রাত ১০টায় যাই গানটির রেকর্ডিং করতে। গল্প করতে করতেই দুই-আড়াই ঘণ্টা কেটে যায় আমাদের। ওর মধ্যে যে সারল্য আছে তা আমার ভীষণ ভালো লাগে। ওর জীবনের অনেক কথা আমার সঙ্গে শেয়ার করে। ভোররাতের দিকে গানটির রেকর্ডিং শেষ হয়।
প্রথম চলচ্চিত্রে (স্বামী-স্ত্রীর ওয়াদা) সুর করেই দুটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেলেন। কিন্তু এরপর নতুন কোনো ছবিতে কাজ করছেন না কেন?
আমার মনে হয় আমি অনেক কাজ করছি। আসলে জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পর আরো বেশি সাবধান হয়ে গেছি। ছবি বাছাই করতে গিয়ে খুব দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছি। বাড়ি তৈরিসহ নানা কাজে ব্যস্ত আছি। তবে আমার হাতে এখনো দুটি ছবির কাজ আছে। সেটা এখনই বলতে চাই না। এর আগে নতুন একটি অ্যালবামের গান তৈরির কথা ভাবছি।
বাড়ি করছেন কোথায়?
উত্তরায় নিজের মতো করে বাড়িটি তৈরি করছি। এরই মধ্যে কাজ প্রায় শেষ। বাড়ির একটা দেয়াল বরাদ্দ রেখেছি বাংলাদেশের শিল্পীদের জন্য। সেখানে প্রতিবছর একজন করে লিজেন্ড শিল্পীর হাতের ছাপ নেওয়া হবে সংরক্ষণের জন্য!
অডিও বাজারের অবস্থা এখন অনেকটাই নাজুক? এর কারণ কি শুধুই পাইরেসি?
এর মূল কারণ অবশ্যই পাইরেসি। এর বাইরে ইন্টারনেট, এফএম রেডিও, ডাউনলোড_সব মিলিয়ে আমাদের অস্তিত্বটা চলে গেল আর কি!
এর পাশাপাশি শিল্পী এবং প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোর মতবিরোধও তো রয়েছে...
দুই পক্ষের অমিলও একটা কারণ। তবে পাইরেসি মূল। সবচেয়ে বড় কথা, প্রযুক্তি পরিবর্তন করতে হবে। আমার মনে হয় ক্যাসেটের পর এখন সিডিরও সময় শেষ। এখন যেতে হবে মেমোরি চিপস অথবা ইউএসবিতে। এগুলো ডিকোড করা যায়। এগুলো চীন নতুন করে বের করছে। আমি যত দূর জানি, ভারতেও এ প্রচেষ্টা চলছে। তবে পাইরেসি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সবাই একসঙ্গে না থাকার এ সুযোগটা সবাই নিচ্ছে। সবাই মিলে একসঙ্গে না নড়লে জীবনেও এর সমাধান সম্ভব নয়। এই এক না হওয়ার পেছনেও কিছু লোক কাজ করছে।
তারা কারা?
আছে। আমি তাদের নাম বলতে চাই না। যাদের কোনো কাজকর্ম নেই তারাই এসব করছে, যাতে নতুন প্রজন্ম কাজ করতে না পারে। এভাবে চলতে থাকলে পরবর্তী সময়ে বাংলা গানের কাজ হবে কি না আমার সন্দেহ। কোনো গানেরই কোনো মা-বাপ নেই। এ সুবিধাই সবাই ভোগ করছে।
প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন অর্থলগি্ন করছে না বললেই চলে? তারা নতুন শিল্পীদের অ্যালবামের দিকেই ঝুঁকছে। এটা কি কোনো কারণ নয়?
সব কিছুর মূল কারণ সবার এক হতে না পারা।
আপনারা অনেক স্বপ্ন দেখিয়ে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গানচিল শুরু করেছিলেন। এখন গানচিলেরও তো তেমন কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ছে না...
আমরা কিছুটা হলেও পূরণ করতে পেরেছি। একা আমার পক্ষে তো সম্ভব নয়। আমাদের সঙ্গে যাঁরা ছিলেন তাঁদের ব্যর্থতা, আমার ব্যর্থতা_সব মিলিয়ে গানচিলের এই দশা।
যে ইন্ডাস্ট্রির জন্য আপনারা এত দিন সংগ্রাম করেছেন। সেই ইন্ডাস্ট্রির এই যে করুণ দশা_আপনাকে পীড়া দেয় না?
এটার জন্য আমার এত কষ্ট করা, অথচ মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির (এমআইবি) নেতৃত্বে এসেও কিছু করতে পরালাম না। বাংলাদেশে দ্বিতীয় অডিও ক্যাসেট আমার। আমাদের এত সুন্দর মার্কেট হওয়ার পর নতুন প্রজন্ম যদি ফল ভোগ করতে না পারে এটা তো অনেক বেদনার। আমি সরে দাঁড়ালেও পেছন থেকে ইন্ডাস্ট্রির জন্য কাজ করছি। সুখবর হলো, সম্প্রতি ইঙ্গিত পেয়েছি, সবাই মিলে একসঙ্গে বসার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সবাই একসঙ্গে আন্দোলন করলেই নিজেদের অধিকার আদায় করা সম্ভব।
আপনি একবার বলেছিলেন ছেলের (নিবিড়) সুরেও গান করে যেতে চান...
মানুষের কত রকম স্বপ্নই তো থাকে। নিবিড় এখন পড়ছে ক্লাস থ্রিতে। পিয়ানো শিখছে। বাসায় নিজে নিজেই গানের প্রজেক্ট বানাচ্ছে প্রতিদিন। আবার ফেলেও দিচ্ছে। আমি এখনো স্বপ্ন দেখি, একদিন তার সুরে গান করব। বেঁচে থাকলে হয়তো সেটা পূরণও হবে।
সংগীতে আপনার বড় প্রাপ্তি কী বলে মনে করেন?
বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা।
সংগীতের বাইরে কোন কাজটা করেছেন, যেটা নিয়ে আপনি গর্ববোধ করেন?
আমি ছোটখাটো কিছু সংগঠনের সঙ্গে জড়িত, যেখানে শিশুদের নিয়ে কাজ করা হয়। শিশুদের ভালোবাসা ভালো লাগাগুলো আমার মধ্যে অন্য রকম অনুভূতির জন্ম দেয়।
বেঁচে থাকতে থাকতে কোন ইচ্ছাটি পূরণ করতে চান?
ছোট্ট একটা ইনস্টিটিউট করতে চাই, যাতে সংগীতের যা কিছু অর্জন তা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারি।
অবসরে কী করেন?
অবসরে ছেলের সঙ্গে এঙ্ বঙ্ খেলি। ওকে জেতানোর জন্য ইচ্ছা করেই হেরে যাই। জেতার পর ও যে আনন্দটা পায়, তা দেখে আমিও খুশি হই।

No comments

Powered by Blogger.