চরাচর-পাঠাগারের আলো by আলম শাইন

পাঠাগারকে বলা হয় মানব জীবনের জ্ঞানতীর্থ। তীর্থস্থানের মতোই এটি অতিপবিত্র একটি স্থান। জ্ঞানতৃষ্ণা নিবারণের জন্য বা জ্ঞানের অমৃতসাগরে সাঁতার কাটার উদ্দেশ্যেই মূলত পাঠাগারের উৎপত্তি। যত দূর জানা যায়, পৃথিবীতে প্রথম পাঠাগার স্থাপিত হয় প্রাচীন রোমে। যখন থেকে গ্রন্থ রচিত হতে থাকে তখন থেকেই সংরক্ষণ করতে থাকে রোমকরা। পর্যায়ক্রমে তা মিসর, ব্যাবিলন, চীন, তিব্বত ও ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে।


যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একসময় এ দেশের আনাচে-কানাচে অজস্র পাঠাগার গড়ে উঠলেও আকাশ সংস্কৃতির কবলে পড়ে তা আবার দ্রুত হারিয়ে যায়। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝির দিকেও এ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাঠাগারের বেশ রমরমা অবস্থা ছিল। পাড়া বা মহল্লার উঠতি যুবকরা অথবা নেতৃত্বস্থানীয়রা পাঠাগার গঠন করতে পারলে নিজেদের ধন্য মনে করত তখন। ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অথবা মেম্বার প্রার্থীদের নির্বাচনী উপঢৌকনের মধ্যে একটি থাকত গাঁয়ে পাঠাগার গঠন করে দেওয়া। সেই সময়ে পাঠাগারের এমনই জনপ্রিয়তা ছিল যে পাড়ার বখাটেরা পর্যন্ত এতে অংশ নিতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত। আজেবাজে আড্ডায় না জড়িয়ে একদল যুবক ছুটত খেলার মাঠে, আরেক দল ছুটত জ্ঞান আহরণের জন্য গাঁয়ের ছোট্ট পরিসরের পাঠাগারে। পড়ন্ত বিকেলে ঠাসাঠাসি করে পাঠাগারে বসে বই পড়ে সময় কাটাত তারা। কোনো ঝগড়াঝাঁটি নেই, নেই কোনো বাদানুবাদ। অথচ একগাদা লোক বসে বই পড়ছে নীরবে-নিভৃতে। ব্রিটিশ আমলেই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গোপন সংগঠনগুলো পাড়ায়-মহল্লায় পাঠাগার আর জিমনেশিয়াম গঠন করতেন। পাঠাগার আন্দোলন গড়ে তোলা হতো শহরে-গ্রামে। ভালো বইয়ের সন্ধানে একে অপরের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় মত্ত থাকত। অনেকে প্রিয় কোনো গ্রন্থের প্রিয় চরিত্র নিয়ে 'ফ্যান ক্লাব' পর্যন্ত গঠন করত। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ 'দস্যু বনহুর এবং মাসুদ রানা' ফ্যান ক্লাব। আশপাশে পাঠাগার না থাকলে অথবা প্রয়োজনীয় বই হাতের কাছে না পেলে দূর-দূরান্ত থেকে বই ভাড়ায় এনে পড়ত তখনকার যুবক-যুবতীরা। সোজা কথা, পাঠাগারের কল্যাণে তারা তখন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ত তুলনামূলকভাবে অনেক কম। ইভ টিজিং এখনকার মতো এত মহামারির আকার ধারণ করেনি সেই সময়। যুবক-যুবতীরা নেশার রাজ্যে ডুবসাঁতার কাটার সুযোগ পায়নি খুব একটা। এখন বই বিক্রি বেড়েছে ঠিকই, তবে পাঠাভ্যাস কমেছে অনেকটাই। সরকার আগের তুলনায় বেশি পরিমাণে বই কিনে পাবলিক লাইব্রেরিগুলোতে সরবরাহ করে ঠিকই, কিন্তু পড়ুয়ার অভাবে বইগুলো অক্ষত থেকে যাচ্ছে। বই অক্ষত থাকা কোনো শুভ লক্ষণ নয়। এটি জাতির জন্য খুব খারাপ একটি দিক। আর এ খারাপ দিকটির পেছনের কারণ একটিই, সেটি হচ্ছে জ্ঞানচর্চার অভ্যাস থেকে সিটকে পড়া। তৃণমূল পর্যায়ে (গ্রামেগঞ্জে) আগের মতো পাঠাগারও নেই, পাঠাভ্যাসও নেই। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। বেশি বেশি পাঠাগার বানিয়ে পাঠাভ্যাস গঠন করে যুবসমাজকে কুপথ থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে, তাহলে অপরিসীম লাভবান হবে জাতি।
আলম শাইন

No comments

Powered by Blogger.