সাময়িক প্রসঙ্গ-ট্রানজিট থেকে সর্বোত্তম সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে by এম রহমতউল্লাহ

টা ঠিক ট্রানজিট নয় বরং বাংলাদেশের বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থান ব্যবহার করে ভারত থেকে ভারতে যাচ্ছে ভারতীয় পণ্য। এ পণ্য তৃতীয় কোনো দেশে গেলে অবশ্যই ডবি্লউটিও বিধান বিবেচনায় নিতে হতো। এটাও মনে রাখা দরকার যে, দশকের পর দশক ধরে ভারত এ সুবিধা ব্যবহার করতে পারেনি।


এ ক্ষেত্রে ডবি্লউটিও কিছু করতে পারেনি এবং প্রকৃতপক্ষে তাদের কিছু করার সুযোগও নেই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে বাংলাদেশের ভেতর দিয়েই আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রানজিট পণ্যের চালান গেছে। এ জন্য ১৯৭২ সালের নৌ-প্রটোকল চুক্তি এবং ২০০৯ সালের নৌ-প্রটোকল সংশোধন চুক্তির সেসব ধারা ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে ট্রানজিট সুবিধা প্রদানের বিনিময়ে বাংলাদেশকে কোনো মাশুল প্রদানের বিধান নেই। এ ক্ষেত্রে ট্যারিফ কমিশন চেয়ারম্যানকে প্রধান করে যে পাঁচটি কোর কমিটি গঠন করা হয়েছে তাদের সুপারিশের আওতায় সরকার তার অবস্থান স্পষ্ট করতে পারে। বাংলাদেশের ভূখণ্ডে সড়ক, রেল ও নৌপথ ব্যবহার করে ভারতে যে পণ্য যাবে তার বিনিময়ে মাশুল আদায় ছাড়াও যোগাযোগ সুবিধা গড়ে তোলার মূলধন ব্যয়, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়, পরিবেশের ক্ষতি বাবদ অর্থ আদায়ের প্রস্তাব-সুপারিশ কোর কমিটিগুলো করেছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানানো হয়েছে।
ত্রিপুরায় পণ্য গেছে আশুগঞ্জ আইডবি্লউটিএ নৌবন্দর সুবিধা ব্যবহার করে। আশুগঞ্জে ২৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নৌবন্দর সুবিধা উন্নত করার কথা। এজন্য ভারত সহজশর্তে ঋণ প্রদান করবে, এমনটিই চূড়ান্ত হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বন্দরটিতে সুবিধা বাড়ানোর কোনো কাজ শুরু হয়নি, কেবল কিছু বালুর বস্তা ফেলে সাময়িক সময়ের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যে প্রটোকলের আওতায় ভারতে নৌপথে ট্রানজিট পণ্য যাওয়ার কথা তাতে দুটি রুট চিহ্নিত করা আছে। এক. গৌহাটি-আরিচা-নারায়ণগঞ্জ-চাঁদপুর-মংলা হয়ে কলকাতা। দুই. করিমগঞ্জ-ভৈরব-চাঁদপুর-মংলা হয়ে কলকাতা। ২০০৯ সালে এর সংশোধন করে আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর হয়ে সড়কপথে আগরতলা পর্যন্ত পণ্য পরিবহনের বিধান রাখা হয়। ভারত প্রটোকলে সংশোধনের সুযোগ নিচ্ছে। মূল প্রটোকলে ট্রানজিট মাশুল ছিল না, কেবল জলপথের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বছরে ৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা ফি প্রদানের বিধান রয়েছে। এটা কোনোভাবেই ট্রানজিট ফি বা চার্জ নয়। এ পথে বাংলাদেশ হয়ে ভারতের পণ্য ভারতে গেলে তাদের আর্থিকভাবে যথেষ্ট লাভ থাকে। বর্তমানে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে পশ্চিমবঙ্গ এবং অন্যান্য এলাকার পণ্য আনা-নেওয়া করতে যে সড়ক ও রেলপথ ব্যবহার করতে হয় তা ব্যয়বহুল। কিন্তু আশুগঞ্জ পর্যন্ত নৌপথে আসা-যাওয়া এবং মাত্র ৪০ কিলোমিটারের মতো সড়কপথ ব্যবহার করা হলে দূরত্ব অনেক কমে যায়, সময়ও বাঁচে। বলা চলে, দূরত্ব কমবে অন্তত এক-তৃতীয়াংশ। এতে যে ব্যয় কমবে ভারতের, তারই একটি অংশ বাংলাদেশকে ভারতের দেওয়া উচিত বলে জোরালো মত রয়েছে। হিসাবটা এভাবে হতে পারে, বর্তমানে 'চিকেন করিডোর হয়ে' পণ্য পরিবহনের জন্য ভারতের যদি ১০০ ডলার ব্যয় পড়ে, নৌপথে আশুগঞ্জ এসে তারপর ৪০ কিলোমিটার সড়কপথ ব্যবহার করে ত্রিপুরায় পাঠানো হলে তা নেমে আসবে ৬০ ডলারে। তাদের যে ৪০ ডলার সাশ্রয় হবে তার একটি অংশ বাংলাদেশকে দেওয়া উচিত। আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া হয়ে আগরতলার দূরত্ব খুব কম। এ পথের জন্য যদি ট্রানজিট মাশুলও ধরা হয় তার পরিমাণ হবে সামান্য। বাংলাদেশ ভারতীয় পণ্য ভারতীয় ভূখণ্ডে আনা-নেওয়ার জন্য তার ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দিয়ে কেবল এ সামান্য অর্থে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। এভাবে ট্রানজিট প্রদানকারী ও ব্যবহারকারী উভয় দেশই লাভবান হতে পারে এবং তা দু'দেশের জনগণের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিকাশেও অবদান রাখবে।
ট্রানজিটের জন্য অবকাঠামো সুবিধা গড়ে তুলতে ভারতের ঋণ প্রদানের কথা। সড়ক, রেল ও নৌ_ সব ধরনের রুটের জন্যই এ অর্থ ব্যয় হবে। কিন্তু এ সংক্রান্ত অঙ্গীকার এখন পর্যন্ত বাস্তব রূপ লাভ করেনি। এটা সহজেই বোধগম্য যে, ট্রানজিটের জন্য সড়কের চেয়ে বাংলাদেশের রেল ও নৌপথ ব্যবহার করা সব দিক থেকেই উপযুক্ত। বাংলাদেশের সড়কপথে মালামালবাহী ভারী যানবাহন কী পরিমাণ চলাচল করতে পারবে, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত রয়েছে। আমাদের সড়কপথে অনেক সমস্যা। তাছাড়া জমির স্বল্পতার কারণে সব পথ ইচ্ছা করলেই ৪ বা ৬ কিংবা ৮ লেনের করা যাবে না। ভারতের অভ্যন্তরের অনেক সড়কপথ ১২ টন মালামাল বহনকারী ট্রাকের উপযুক্ত। কিন্তু বাংলাদেশের বেশিরভাগ সড়কে ৮ টনের বেশি মালবাহী যানবাহন চললেই সমস্যা। এ কারণে সড়কপথে ট্রানজিটের পরিবর্তে ট্রানশিপমেন্টের প্রস্তাব রয়েছে এবং তা যুক্তিযুক্ত। এ জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বাংলাদেশি ট্রাক ব্যবহার করতে হবে। তবে মূল ট্রানজিট চালু হতে পারে রেলপথে। ভারত থেকে বাংলাদেশ হয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে যেতে হলে কুলাউড়া থেকে মহিষাসন পর্যন্ত ৩৯ কিলোমিটার রেলপথের সীমিত উন্নয়ন করা দরকার। এ পথটি ২০০২ সাল পর্যন্ত সচল ছিল, এখন বন্ধ রয়েছে। তবে মূল অবকাঠামো রয়েছে। এ পথটি ২ বছরের মধ্যে সচল করা সম্ভব। আখাউড়া থেকে আগরতলা পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ কাজও হাতে নেওয়ার কথা। বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ভারতের রেলপথে যোগাযোগ রয়েছে। দর্শনা হয়ে নিয়মিত ট্রেন যায় শিয়ালদহ। তবে সমস্যা রয়েছে যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতুতে। এতে রেলপথ রয়েছে, কিন্তু মালবাহী রেল চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ থাকায় ট্রানজিটের জন্য এ পথ ব্যবহার এখন সম্ভব নয়। কনটেইনার যেতে পারবে কি-না, সেজন্য টেকনিক্যাল কমিটি কাজ করছে।
অর্থাৎ ভারতকে ট্রানজিট প্রদানের সম্ভাব্য তিনটি রুট হচ্ছে : আশুগঞ্জ পর্যন্ত নৌপথ এবং তারপর ৪০ কিলোমিটারের মতো সড়কপথ, ট্রানশিপমেন্ট সুবিধাসহ সীমিত মাত্রায় সড়কপথ এবং রেলপথ। প্রতিটি ক্ষেত্রেই অবাধ চলাচলে সমস্যা রয়েছে এবং তা দূর করা চাই। এ ক্ষেত্রে ভারত যদি তার ব্যয় সাশ্রয় বিবেচনা করে বাংলাদেশকে বেঁচে যাওয়া অর্থের হিস্যা দিতে রাজি থাকে, তাহলে বিষয়টির পারস্পরিক লাভজনক সমাধান হতে পারে।
কেউ কেউ বলেন, ট্রানজিটের জন্য মাশুল আদায় ডবি্লউটিওর বিধানে নেই। ট্রানজিটের প্রকৃত সংজ্ঞা অনুযায়ী এ কথায় যুক্তি রয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ ভারতকে যে সুবিধা দিতে চায় তা ট্রানজিটের চিরায়ত বিধান অনুযায়ী নয়, বরং পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে। প্রকৃতপক্ষে, এটা ঠিক ট্রানজিট নয় বরং বাংলাদেশের বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থান ব্যবহার করে ভারত থেকে ভারতে যাচ্ছে ভারতীয় পণ্য। এ পণ্য তৃতীয় কোনো দেশে গেলে অবশ্যই ডবি্লউটিও বিধান বিবেচনায় নিতে হতো। এটাও মনে রাখা দরকার যে, দশকের পর দশক ধরে ভারত এ সুবিধা ব্যবহার করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে ডবি্লউটিও কিছু করতে পারেনি এবং প্রকৃতপক্ষে তাদের কিছু করার সুযোগও নেই।
ভারত, নেপাল ও ভুটানকে যে ট্রানজিট সুবিধা বাংলাদেশের দেওয়ার কথা তার অবকাঠামো নির্মাণে বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন পড়বে। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান এবং অন্যান্য সূত্র থেকে এ জন্য ঋণ মিলতে পারে। ভারতও ঋণ দিতে পারে। কারণ ট্রানজিটের প্রধান লাভ তারাই পাবে। তাদের ঋণের শর্ত হওয়া উচিত সহজ এবং সুদের হার নামমাত্র।
অনেকে মনে করেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা ব্যবহার করে ভারতীয় পণ্য গেলে বাংলাদেশ তার সম্ভাবনাময় একটি বড় বাজার হারাবে। সরলভাবে দেখলে এ কথায় যুক্তি রয়েছে। কিন্তু আমরা অন্যভাবেও বিষয়টিকে দেখতে পারি। ভারতের পশ্চিম-দক্ষিণাঞ্চলীয় বিভিন্ন রাজ্য থেকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পূর্বাংশে পণ্য নিলেও তার পরিবহন ব্যয় যথেষ্ট থাকবে। সময়ও লাগবে। সে তুলনায় বাংলাদেশ রয়েছে অনেক সুবিধাজনক অবস্থানে। বাংলাদেশ যদি তার অর্থনৈতিক শক্তি বাড়াতে পারে, ভারতের পূর্বাঞ্চলের ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী বহুমুখী পণ্য উৎপাদন করতে পারে, তাহলে সেখানকার বাজারের সুবিধা হারানোর শঙ্কা কম। আমাদের উদ্যোক্তারা প্রয়োজনে সীমান্ত এলাকায় গিয়ে কারখানা স্থাপন করবেন। ভারত কিংবা অন্য দেশের উদ্যোক্তারা অর্থনীতির এ হিসাব সহজেই ধরে উঠতে পারবেন যে কলকাতা বা হুগলি কিংবা চেন্নাই-মুম্বাইয়ের চেয়ে কুমিল্লায় স্থাপন করা কারখানায় তৈরি পণ্য আগরতলায় কম দামে বিক্রি হবে।
ট্রানজিট এবং কানেকটিভিটির মতো ইস্যুতে আমাদের চীনের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের সময় চট্টগ্রামে গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের প্রস্তাব এজেন্ডায় ছিল। চট্টগ্রাম থেকে মিয়ানমার হয়ে চীনের কুনমিংয়ের রাজধানী ইউনান পর্যন্ত একটি রুট চালুর প্রস্তাব বিবেচনাধীন। এ রুট চালু হলে চীনেরও সুবিধা_ তারা চট্টগ্রাম বন্দরের সুবিধা ব্যবহার করতে পারে। এ পথে এশিয়ান হাইওয়েতে ওঠা তাদের জন্য সহজ। এ জন্য বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমার সীমান্ত পর্যন্ত সড়ক ও রেলপথ নির্মাণ করা চাই। অন্যদিকে মিয়ানমারের ভেতরে যে অবকাঠামো সুবিধা নির্মাণ করতে হবে, সে জন্য চীনের সহায়তা মিলবে। কারণ তারা চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে কানেকটিভিটির সুবিধা পেয়ে যাবে। মিয়ানমার যাতে রাজি হয় সে জন্য বাংলাদেশকেও কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ইয়াংগুন সফরকালে এ ইস্যুতে অগ্রগতি হবে বলে আশা করা যায়।
ট্রানজিট-ট্রানশিপমেন্ট-কানেকটিভিটি, এসব হচ্ছে বিশ্বায়নের যুগের বাস্তবতা। এর বাইরে থাকা কঠিন, কিংবা বলা যায় কাঙ্ক্ষিত নয়। কিন্তু এর বিনিময়ে সম্ভাব্য সর্বোত্তম সুবিধাও বাংলাদেশকে নিশ্চিত করতে হবে।

ড. এম রহমতউল্লাহ : ইউএনএসকাপের সাবেক পরিচালক (ট্রান্সপোর্ট) এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের পরিবহন খাতের নীতি সংক্রান্ত উপদেষ্টা
 

No comments

Powered by Blogger.