ব্যাংকে গ্রাহক হয়রানির অভিযোগ বাড়ছে by ওবায়দুল্লাহ রনি ও আবদুল কাদির হাওলাদার

সেখানকার সিটিব্যাংক এনএর মাধ্যমে ২০০৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশে কিছু অর্থ পাঠান। অগ্রণী ব্যাংকে খোলা ৬১৭৩ নম্বর হিসাবে ওই অর্থ পাঠানো হয়। টাকা তুলতে গেলে অগ্রণী ব্যাংক থেকে জানানো হয়, ওই হিসাবে কোনো অর্থ জমা হয়নি। কাদির নরওয়ের সিটিব্যাংক এনএতে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, ২৪ ডিসেম্বর ওই হিসাবে অর্থ জমা হয়েছে।


এরপরও ওই অর্থ না পেয়ে ২০১১ সালের ৩ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি অভিযোগ করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়ার ক'দিনের মাথায় ওই অর্থ জমা দেখায় অগ্রণী ব্যাংক। ব্যাংক গ্রাহকদের এমন নানা অভিযোগ রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ কেন্দ্রে । বেশ কিছু অভিযোগ নিষ্পত্তি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই বিশেষ সেল। সোনালী ব্যাংকের মাগুরা জেলার বুনাগাতী বাজার শাখার গ্রাহক কুমারেশ চন্দ্র বিশ্বাস। ১৯৯৪ সালে ওই শাখায় তিনি ৫০০ টাকা মাসিক কিস্তিতে ২০ বছর মেয়াদি একটি ডিপিএস খোলেন। এ হিসাবের নমিনি করা হয় তার ছেলে রাকেশ বিশ্বাসকে। গত বছর এপ্রিলে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে কুমারেশ মারা যান। ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ১৭ বছরে ওই হিসাবের পাস বইয়ে ৩ লাখ ৬২ হাজার ১৬১ টাকা স্থিতি দাঁড়ায়। বাবার মৃত্যুর ফলে ওই টাকা তুলতে গেলে ডিপিএসের মেয়াদ শেষ হয়নি বলে জমা করা টাকার ওপর সরল সুদ হিসাবায়ন করে ২ লাখ ৩২ হাজার ৬৮৭ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। তবে রাকেশ সে টাকা না নিয়ে গত বছরের ২৯ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ করেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে এ বিষয়ে দ্রুত ও সুষ্ঠু সুরাহা করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এরপর ২০ জুলাই পুঞ্জীভূত সুদসহ ডিপিএসের অর্থ বাবদ তাকে ৪ লাখ ৪ হাজার ৭০ টাকা দেয় ব্যাংকটি। এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ হুমায়ূন কবির সমকালকে বলেন, মেয়াদ পূর্ণ না হলে সাধারণত ডিপিএসের লাভ দেওয়া হয় না। এ ক্ষেত্রেও তেমন হতে পারে। তবে গ্রাহকের অর্থ আত্মসাৎ কিংবা আটকে রাখার বিষয়টি সঠিক নয়। অনেক সময় ব্যাংকের নিয়মকানুনের কারণে অর্থ পরিশোধে কিছুটা দেরি হয়। তবে সেটিকে আটকে রাখা বলা চলে না।আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের ঢাকার নন্দীপাড়া শাখায় একটি সঞ্চয়ী হিসাব রয়েছে মহিউদ্দিন আহমেদের। গত বছর মার্চের শেষদিকে বিশেষ প্রয়োজনে টাকা ওঠাতে ব্যাংকে যান তিনি। ব্যাংকের ক্যাশ কাউন্টারে বড় অঙ্কের চেক জমা দেন তিনি। তবে ক্যাশ অফিসার জানিয়ে দেন, তার হিসাবে ওই পরিমাণ টাকা নেই। তিনি হিসাব বিবরণী উঠিয়ে দেখেন, ওই মাসের শুরুর দিকে আল-আরাফাহ্ ব্যাংকের মতিঝিল শাখা থেকে ৫ লাখ টাকা তোলা হয়েছে। তবে তিনি টাকা তোলা তো দূরের কথা, মতিঝিল শাখায়ই যাননি এবং কাউকে অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেকও দেননি। বিষয়টি নিয়ে তিনি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অভিযোগ করেন। পরে যে চেক দিয়ে মহিউদ্দিনের অ্যাকাউন্ট থেকে ৫ লাখ টাকা তোলা হয়েছে সেটি খুঁজে বের করে ওই ব্যাংক। চেকে করা স্বাক্ষর আর মহিউদ্দিনের স্বাক্ষরের সঙ্গে প্রায় ৫০ শতাংশ পার্থক্য দেখা যায়। এরপর কে কবে টাকা তুলেছে, কে চেক যাচাই করেছে_ এসব বিষয় অনুসন্ধান করতে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসে। জানা যায়, ব্যাংকের নন্দীপাড়া শাখারই এক কর্মকর্তা মহিউদ্দিনের চেক বই থেকে একটি পাতা সরিয়েছিলেন। সেই চেকের পাতায় মহিউদ্দিনের স্বাক্ষর জাল করে টাকা তুলেছেন। একজন বিশেষজ্ঞ কৃষি পরামর্শক ড. মোঃ আইয়ুব আলী। বাংলাদেশের একটি বিদেশি ব্যাংকে তার সঞ্চয়ী হিসাব আছে। তিনি জেনেভা থেকে সম্মানী বাবদ পাওয়া ২ লাখ ৮৪ হাজার ১১৮ টাকা ওই হিসাবে পাঠান। নিয়ম অনুযায়ী এ অর্থকে রেমিট্যান্স হিসেবে গণ্য করার কথা। তবে তা না করে ওই ব্যাংকের এক কর্মকর্তা তার হিসাব থেকে ১০ শতাংশ হারে আয়কর কেটে রাখতেন। বিষয়টি তিনি বাংলাদেশ ব্যাংককে জানান। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে মাত্র দু'দিনের মাথায় ১০ শতাংশ হারে কাটা অর্থ ফেরত দেওয়া হয়। একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে নাইজেরিয়া প্রবাসী সাইদুর রহমানের ক্ষেত্রেও।এ ধরনের ঘটনা ব্যাংক খাতের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে_ জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, এ ধরনের ঘটনা ঘটছে কি-না, জানি না। তবে যদি ঘটে থাকে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি বলেন, আস্থার ফলেই গ্রাহক ব্যাংকে টাকা রাখেন। সে আস্থার জায়গা যদি নড়বড়ে হয়ে যায় তাতে সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতের ওপর প্রভাব পড়বে। তাই ব্যাংকগুলোকেই বেশি দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে যে সেবা কার্যক্রম চালু করেছে, সেখান থেকে দ্রুত কিছু কঠিন পদক্ষেপ নিলে ব্যাংকাররা আর এ ধরনের ঘটনা ঘটাবেন না বলে তিনি মনে করেন।কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে গ্রাহক হয়রানির আরও বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে। যেমন_ খুলনার খালিশপুরের পুরনো কলোনির ১০৫ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা একেএম মানিক মিয়ার নামে ইতালি থেকে পাঠানো অর্থ তুলতে না পারা, চট্টগ্রামের পটিয়ার জাহানারা বেগমের হিসাবে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা টাকা না দেওয়া, আবুধাবি থেকে আইপিওর জন্য এফডিডি করে রফিকুল ইসলামের পাঠানো অর্থ জমা না করার ঘটনা ঘটেছে। এ তিনটি ঘটনা ঘটেছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিভিন্ন ব্যাংকে।

No comments

Powered by Blogger.