হঠাৎ পুঁজিবাজার বন্ধ

মকাল প্রতিবেদকআবারও ব্যাপক বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে দেশের শেয়ারবাজার। গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শেয়ার ব্যবসা নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আইন স্মরণ করিয়ে দেওয়ার পর বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে বাজার সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ব্যাপক বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থায় ব্যাপক দরপতন ও অস্থিরতার আশঙ্কায় গতকাল মঙ্গলবার হঠাৎ করেই দেশের উভয় শেয়ারবাজারের লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হয়।


প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসইতে গতকাল কোনো লেনদেনই হয়নি। তবে দ্বিতীয় শেয়ারবাজারে দুই মিনিটেরও কম সময় লেনদেন হলেও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে তা বন্ধ করা হয়। পাশাপাশি নির্বাহী আদেশে ওই দুই মিনিটের লেনদেনও বাতিল করা হয়েছে। সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে আজ বুধবার দেশের উভয় শেয়ারবাজারে স্বাভাবিক লেনদেন হতে পারে বলে জানিয়েছেন ডিএসই সভাপতি শাকিল রিজভী ও সিএসই সভাপতি আল মারুফ খান। এদিকে লেনদেন বন্ধের পর গতকাল হাজারখানেক বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারী রাজধানীর শাপলা চত্বর অবরোধ করে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন। গতকালের লেনদেন স্থগিতের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে গত কয়েকদিনে শেয়ারবাজার বিষয়ে সরকার যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত ডিএসই ও সিএসইর প্রতি লেনদেন স্থগিত রাখার দাবি জানিয়েছেন তারা। হঠাৎ লেনদেন বন্ধ : অন্যান্য দিনের মতো সকাল ১১টায় লেনদেন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও গতকাল দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসইতে কোনো লেনদেন হয়নি। সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালনা পর্ষদের জরুরি সভায় লেনদেন বন্ধ রাখার তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত হয়। দুপুর ১২টায় সংবাদ সম্মেলনে ডিএসইর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মোশাররফ এম হোসেন বলেন, 'সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের (সামরিক ও বেসামরিক) শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের বিষয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদে অস্পষ্টতা প্রতীয়মান হয়েছে। ডিএসই কর্তৃপক্ষ মনে করে, এর ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে এবং শেয়ারবাজারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সে কারণে শেয়ারবাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে লেনদেন বন্ধ রাখা হয়েছে।' সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ থাকা উচিত বলে জানান তিনি।তবে গতকাল যথারীতি সকাল ১১টায় চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) লেনদেন শুরু হয়। প্রায় সব শেয়ারের দর কমার মধ্য দিয়ে লেনদেনের শুরু হওয়ায় সিএসই নির্বাচিত খাত সূচক ৫৩ পয়েন্ট পড়ে যায়। এ অবস্থায় আরও বড় দরপতনের আশঙ্কায় এবং ডিএসই লেনদেন বন্ধ রাখার খবরে সিএসই কর্তৃপক্ষও লেনদেন বন্ধ করে দেয়। সিএসইর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ সাজিদ হোসেন জানান, গতকালের সব লেনদেন বাতিল করা হয়েছে। লেনদেন বন্ধের ঘোষণা দিয়ে সিএসই সভাপতি সংবাদ সম্মেলনে জানান, যেহেতু ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লেনদেন বন্ধ রেখেছে, সে কারণে সিএসই কর্তৃপক্ষও লেনদেন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি বলেন, দেশের প্রধান শেয়ারবাজার বন্ধ থাকার পরও দ্বিতীয় শেয়ারবাজার চালু বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির আশঙ্কা ছিল। এ অবস্থায় লেনদেন বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া বিকল্প ছিল না। ব্যাপক দরপতনের মুখে গত বছরের ২৩-২৪ জানুয়ারিতেও উভয় শেয়ারবাজারের লেনদেন বন্ধ রাখা হয়েছিল। আজ স্বাভাবিক লেনদেন হবে : গতকাল লেনদেন বন্ধ থাকলেও আজ দেশের উভয় শেয়ারবাজারে স্বাভাবিক লেনদেন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছে ডিএসই ও সিএসই। উদ্ভূত সংকটময় অবস্থায় সরকারের ব্যাখ্যা না পাওয়ার প্রেক্ষাপটেই আবার লেনদেন চালু করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।গতকাল লেনদেন বন্ধ করার পর উভয় স্টক এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের বারবারই বলেছিলেন, সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যাখ্যা না পাওয়া পর্যন্ত লেনদেন চালুর বিষয়ে তারা কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না।ডিএসই ও সিএসই শীর্ষ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, লেনদেন বন্ধের পর দিনভরই তারা অর্থমন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন। কেউ সাড়া দেননি। এমনকি নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসির মাধ্যমেও যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চেয়ে সকালে চিঠি পাঠানো হলেও রাত ১০টায় অর্থমন্ত্রী সাড়া দেন। রাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে বৈঠক হবে বলে জানা গেছে। সারাদিন সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারার পরও আবার লেনদেন চালু করার কারণ জানতে চাইলে সিএসই সভাপতি আল মারুফ খান সমকালকে রাত ৯টায় বলেন, 'অনেক তো অপেক্ষা করলাম। এখন আর সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।' তিনি আরও বলেন, 'পরিস্থিতি যেখানে দাঁড়িয়েছিল তা নিয়ন্ত্রণে এবং বিনিয়োগকারীদের এ অবস্থা অনুধাবন করার জন্য যথেষ্ট সময় দেওয়ার দরকার ছিল। একদিন লেনদেন বন্ধ রাখার মাধ্যমে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি। এখন বিনিয়োগকারীরা নিজেদের বুদ্ধি বিবেচনা করবেন, কেন আমরা লেনদেন বন্ধ রেখেছিলাম, আর কেনই বা লেনদেন চালুর সিদ্ধান্ত নিলাম।' ডিএসই সভাপতি শাকিল রিজভীও বলেন, 'অনির্দিষ্টকালের জন্য লেনদেন বন্ধ রাখা কোনো সমাধান নয়।' জানা গেছে, আজ এসইসি চেয়ারম্যান সংবাদ সম্মেলন করে পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দেবেন। এর আগে বিকেল ৪টায় ডিএসই সভাপতি সমকালকে বলেছিলেন, শেষ পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করব। তিনি রাতে বলেন, 'সরকারের কাছে আমরা বলতে চেয়েছিলাম, শেয়ারবাজার অত্যন্ত সংবেদনশীল। এখানে যে কারও বক্তব্য রাখা উচিত নয়। সরকারি কোনো কর্মকর্তার বেফাঁস কোনো মন্তব্যে শেয়ারবাজারের কোনো বিরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তার দায়-দায়িত্ব সরকারেরই নেওয়া উচিত। স্টক এক্সচেঞ্জের এ ক্ষেত্রে কোনো দায় থাকবে না।'শাপলা চত্বর দখল করে বিক্ষোভ : লেনদেন না হওয়ায় সকাল ১১টায়ই রাস্তায় নেমে আসেন বিনিয়োগকারীরা। ঢাকায় ডিএসই কার্যালয়ের সামনের রাস্তা অবরোধ করে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শেয়ার ব্যবসা নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত এবং কালো টাকা বিনিয়োগের বিষয়ে এনবিআরের নতুন প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহারের দাবি করেন। বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ কর্মসূচি শাপলা চত্বর থেকে ইত্তেফাক মোড় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় মতিঝিলের ব্যস্ত রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওই এলাকায় ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। বিক্ষোভ কর্মসূচি স্থগিত করার পর সন্ধ্যা ৬টায় যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।দুপুর সাড়ে ১২টায় শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা ডিএসই কার্যালয়ের সামনে থেকে শাপলা চত্বরের দিকে রওনা হলে বিপুলসংখ্যক পুলিশ তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। কয়েক হাজার বিনিয়োগকারীর চাপে শেষ পর্যন্ত পুলিশ বিনিয়োগকারীদের পথ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। তবে উভয় পক্ষের সংযমী আচরণের কারণে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এরপর বিনিয়োগকারীরা শাপলা চত্বরে গিয়ে অবস্থান নেন।বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজার বিষয়ে সরকারের নীতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীর তীব্র সমালোচনা করে বক্তব্য দেন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শেয়ার ব্যবসার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার দাবি জানান তারা। একই সঙ্গে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে অর্জিত আয় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা যাবে না মর্মে এনবিআর যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন তারা। গত এক বছরের দরপতনে বিনিয়োগকারীরা যে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন তা উল্লেখ করে সরকারকে সতর্ক করে বলেন, এই মরণ খেলার জবাব নির্বাচনে পাবেন।

No comments

Powered by Blogger.