রঙ্গব্যঙ্গ-দ্বিখণ্ডিত by মোস্তফা কামাল

ভারত বিভাজন নিয়ে একটা গল্প শুনেছিলাম। গল্পটি এ রকম_ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে 'ভারত ছাড়' আন্দোলন তখন তুঙ্গে। ব্রিটিশরা ভাবল, যেহেতু ভারত ছেড়ে চলে যেতে হবে, সেহেতু ভারতবাসীকে শান্তিতে থাকতে দেব না। কিন্তু অশান্তি সৃষ্টির উপায় কী! অনেক চিন্তা-ভাবনার পর ব্রিটিশরা ঠিক করল, দেশটাকে ভাগ করে দিতে হবে। তা ছাড়া মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও চাইছেন মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র। এই সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে। তখন ব্রিটিশরা


ভারতীয় নেতাদের বলল, আর আন্দোলন করতে হবে না। আমরা শিগগিরই চলে যাব। তবে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে যে কলহ আছে, তা মিটিয়ে যেতে চাই। তারপর মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহসহ অন্য নেতাদের ডাকা হলো। ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে বলা হলো, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র হবে।
ব্রিটিশ প্রশাসনের বক্তব্য শুনে মওলানা আজাদ দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি আবেগ এবং ক্ষোভমিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, 'পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান আমার দুটি হাত। সেই হাত দুটি ছেঁটে ফেলবেন! এভাবে আমাকে পঙ্গু করে যাবেন না।'
ব্রিটিশ প্রশাসক বললেন, 'ওই দুই অঞ্চলের মানুষ চাইছে ভাগ হতে। আমরা কী করব? আমরা তো বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে যেতে পারি না!'
মওলানা আজাদ ওই বক্তব্যের প্রতিবাদ করে বললেন, 'এটা কিছুতেই হতে পারে না।' ভারতের অন্য নেতারাও জোরেশোরে বলে উঠলেন, হতে পারে না। তুমুল প্রতিবাদ শুরু হলো ভারতে।
জিন্নাহ আমতা আমতা করে বললেন, 'ভাগ হলে হোক না, হলে যদি ভালো হয়!'
তারপর যা হওয়ার তাই হলো। ভারত বিভাজন হয়ে গেল। মওলানা আজাদ চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, 'ভারত বিভাজন করে ব্রিটিশরা যে কত বড় ক্ষতি করল, তা একদিন ভারত ও পাকিস্তানবাসী টের পাবে।'
প্রিয় পাঠক, ঢাকা বিভাজনের সঙ্গে ভারত বিভাজনের কোনো তুলনা চলে না। আর সে কারণে এ প্রসঙ্গটাও তোলা হয়নি। তুলেছি এ কারণে যে তখন ভারত বিভাজনের সঙ্গে দেশের আবেগের প্রশ্ন জড়িত ছিল। সেই আবেগের মূল্য দেননি ব্রিটিশ শাসকরা। ঢাকা বিভাজনের সঙ্গেও মানুষের আবেগ জড়িত। রাজধানী ঢাকার ৪০০ বছরের ইতিহাস। সেই ইতিহাসও কি দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাবে? এ বিষয়ে দুই বন্ধুর কথোপকথন এখানে তুলে ধরছি।
প্রিয়তা ও মুহিত দুই বন্ধু। ওরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইস্যু নিয়ে কথাবার্তা বলে থাকে। এবার তাদের বিষয়বস্তু হচ্ছে ঢাকা বিভাজন প্রসঙ্গ।
'পারলাম না! আর পারলাম না!' মুহিত কথাটা বলতে বলতে সোফায় হেলান দিয়ে বসল। তার কথা শুনে প্রিয়তা এগিয়ে গিয়ে বলল, কী পারলে না?
'ঠেকাতে পারলাম না।'
'মানে?'
'ঢাকা বিভাজন ঠেকাতে পারলাম না।'
'ঠেকাতে গিয়েছিলে নাকি? কী দিয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করলে? বাঁশ, লাঠি নাকি অন্য কিছু?'
'ইয়ার্কি করছ, তাই না?'
'আরে! ইয়ার্কি করব কেন?'
'তুমি এই কয় দিন পত্রপত্রিকা পড়োনি? দেখোনি ঢাকা বিভাজন নিয়ে কত সমালোচনা করা হলো? আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কেউ চায়নি। কেউ না। সবাই আপত্তি করেছে, প্রতিবাদ করেছে। সুধী সমাজ রীতিমতো মাঠে নেমেছে। বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল ব্যাপক সমালোচনা করেছে। তার পরও কোনো কাজ হয়নি।'
'কিন্তু এত গোঁয়ার্তুমি কেন করছে? সমস্যা কি মেয়র খোকা?'
'খোকার কথা আর বলো না। কোনো কাজ না করেই বোয়াল মেরেছে।'
'মানে!'
'ঢাকার কোনো উন্নয়ন তিনি করেছেন? করেননি। তার পরও সরকারের জনপ্রিয়তা যেহেতু ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে, সেহেতু খোকার মতো লোককেও ভয় পাচ্ছে। আর সেই সুযোগটিই নিয়েছেন তিনি। সরকার যদি ক্ষমতায় এসেই নির্বাচন দিয়ে দিত তাহলে খোকাকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ ছিল না। অথচ সরকার বিপদে আছে দেখে খোকাও বলেন, 'নির্বাচনে যাব না, তবু ঢাকা ভাগ করবেন না!'
'আমি তো দেখছি খোকাই বুদ্ধিমান। তিনি দেখেছেন, সব মানুষ ঢাকা বিভাজনের বিরুদ্ধে। তাই তিনি মানুষের পক্ষে অবস্থান নিয়ে সবার আবেগকে স্পর্শ করেছেন।'
'ঠিক বলেছ। কিন্তু সরকার কী করল? রীতিমতো জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিল! সরকারের সুহৃদদের কথাও শুনছে না! সমস্যা কী?'
'আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। সব কিছুতেই সরকারের একগুঁয়ে মনোভাব! মানুষের সমালোচনার জবাবে উল্টো প্রধানমন্ত্রী বললেন, টাকা থাকলে নাকি ঢাকাকে চার ভাগ করতেন! এসব কথা শুনলে স্রেফ গা জ্বলে!'
'আচ্ছা, ঢাকাকে ভাগ করে তারা কি অর্জন করতে চায়? ঢাকা ভাগ হলেই কি মানুষের সেবা দোরগোড়ায় পেঁৗছে দিতে পারবে? এত সেবা তো মানুষ চায়নি।'
প্রিয়তা হো হো করে হেসে ওঠে। ওকে হাসতে দেখে মুহিত বলল, কী হলো, হাসছ কেন?
'চমৎকার একটা কথা বলেছ। আমরা তো এত সেবা চাইনি! আর ঢাকাকে আলাদা করলেই যে সেবা দিতে পারবে তার কোনো নিশ্চয়তা আছে? সরকার বরং সিটি করপোরেশনকে শক্তিশালী করতে পারত। তোমার মনে আছে, মোহাম্মদ হানিফ মেয়র থাকাকালে দাবি উঠেছিল সিটি পুলিশের? যার নিয়ন্ত্রক হবেন মেয়র। নগরবাসীর নিরাপত্তা দেবে এই পুলিশ। দাবি উঠল ডেসা, ওয়াসা সিটি করপোরেশনের হাতে ছেড়ে দেওয়ার। এসবের দিকে যায়নি জনগণের ভোটে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার।'
'তার মানে ওই কথাটিই ঠিক। যে যায় লঙ্কায় সে হয় রাবণ! ক্ষমতায় যাওয়ার আগে অনেক বড় বড় কথা। ক্ষমতায় গেলে সব ভুলে যায়।'
'হুম, আমাদের দুর্ভাগ্য বলতে হবে। আমার মনে হয় কি জানো, সরকার ইগো সমস্যায় ভুগছে। ঢাকার মতো জনবহুল শহর তো বিশ্বে আরো আছে। সেগুলো চলছে না? একবার লন্ডন শহরকে বিভক্ত করে থ্যাচার সরকার বেশ বিপদেই পড়েছিল। পরে আবার এক করতে বাধ্য হয়েছিল ব্রিটেন সরকার।'
হঠাৎ মুহিতের মোবাইলে একটি ফোন আসে। তার এক চাচা গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছেন। বাস স্টেশনে এসে তিনি ফোন করে বলেন, বাবা মুহিত, আমি জয়নাল, তোমার বাসায় আসব। তুমি কোন ঢাকায় থাকো বাবা? উত্তর, না দক্ষিণ?
মুহিত বিপদে পড়ে। এর জবাব কী দেবে সে? উত্তর-দক্ষিণ বলতে গেলে মহা ভেজাল হয়ে যাবে। তাই সে বলল, চাচা, আপনি সংসদ ভবনের সামনে আসেন। ওখান থেকে আপনাকে নিয়ে আসব।
মুহিত কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে তার চাচাকে আনার জন্য হাঁটতে শুরু করে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.