প্যাকেট পণ্যে প্রতারণার ফাদ by সারোয়ার সুমন

দেশের অভ্যন্তরীণ বাজরে প্রতি কেজি শুকনো মরিচের বিক্রয়মূল্য ১১০ থেকে ১১৫ টাকা। খোলা বাজারে গুঁড়ো হয়ে সেই মরিচ বিক্রি হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৯০ টাকায়। কিন্তু প্যাকেট করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ওই একই মরিচ বিক্রি করছে ৩শ' থেকে ৩২০ টাকায়। এ হিসাবে কেবল প্যাকেট করে শুকনো মরিচ ব্যবসায়ীরা মুনাফা করছে ১৩০ শতাংশ। অপরদিকে ১৬০ টাকায় কেনা হলুদ প্যাকেটজাত হয়ে বিক্রি হচ্ছে ৫শ' থেকে সাড়ে ৫শ' টাকায়।


এ পণ্যে ব্যবসায়ীরা মুনাফা করছে ১৭০ শতাংশেরও বেশি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলের তৈরি করা এক প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে প্যাকেটের নামে মুনাফার ফাঁদ পাতার এ চিত্র!
শুধু হলুদ-মরিচ নয়; আটা, ময়দা, জিরা, ধনিয়াসহ বিভিন্ন রকমের মসলা নিয়েই এমন প্রতারণা চলছে ভোগ্যপণ্যের বাজারে। নিম্ন- মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তসহ সাধারণ মানুষের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ খোলা পণ্যের চেয়ে প্যাকেট পণ্যের ওপর বেশি আস্থাশীল। আর এর ফায়দা নিয়ে দ্বিগুণ লাভ করছে কিছু ব্যবসায়ী। প্যাকেট পণ্যের দাম নির্ধারণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কঠোর নজরদারি না থাকায় এভাবে অধিক মুনাফার দিকে ঝুঁকছে কিছু ব্যবসায়ী। তাই অখ্যাত কিছু কোম্পানিও মসলা প্যাকেট করতে শুরু করেছে। আবার ঝুঁকি এড়াতে ভেজাল ব্যবসায়ীরাও আটা-ময়দাসহ বিভিন্ন পণ্য ঢুকাচ্ছে প্যাকেটে!
প্যাকেট পণ্যে মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব গোলাম হোসেন বলেন, 'প্যাকেটের কারণে কোনো পণ্যের দাম সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। কিন্তু বাজারে প্যাকেটের নামে কোনো কোনো কোম্পানি দেড়শ' থেকে দুইশ' শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করছে। এদের নিয়মের আওতায় আনতে ইতিমধ্যে কয়েক দফা বৈঠক করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মূল্য নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ট্যারিফ কমিশনকে।'
বাজার ঘুরে দেখা যায়, মসলাসহ বিভিন্ন পণ্য প্যাকেট হচ্ছে দু'ভাবে। একটি ব্র্যান্ডের রঙিন প্যাকেট, অন্যটি সাদা পলি প্যাকেট। আটা, ময়দাসহ মসলা জাতীয় পণ্য আছে রাঁধুনী, রাণী, প্রাণ, বিডি, আফতাব, আরকু ফ্রেশ, এসিআইসহ বিভিন্ন ব্রান্ডের। সর্বোচ্চ ২শ' গ্রামের প্যাকেট নিয়ে এদের সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে ইস্পাহানি গ্রুপ। তবে ফাহিমা নামে অখ্যাত আরেকটি নতুন ব্রান্ডের মসলা দেখা যাচ্ছে বাজারে। এ ছাড়া অধিক মুনাফার আশায় খুচরা ব্যবসায়ীরা সাদা পলিব্যাগে প্যাকেট করে বিক্রি করছে আটা, ময়দা, চাপাতা, মসলাসহ বিভিন্ন পণ্য। খোলা পণ্যের তুলনায় ব্র্যান্ডের পণ্যে কেজিপ্রতি ব্যবধান ৩০ থেকে ২শ' টাকা পর্যন্ত। খোলা পণ্যের তুলনায় সাদা পলিব্যাগে প্যাকেট করা পণ্যের ব্যবধান হচ্ছে কেজিপ্রতি ৫ থেকে ২০ টাকা। আবার ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করতে ভেজাল ব্যবসায়ীরা মসলাসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করছে প্যাকেট করে।
খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি খোলা এলাচ বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ২শ' থেকে এক হাজার ৩শ' টাকায়। অথচ প্যাকেটজাত এলাচ কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৬শ' থেকে এক হাজার ৭শ' টাকায়। ৫০০ গ্রামের একটি ব্র্যান্ডের মরিচ ১৫৫ টাকা এবং অখ্যাত ব্র্যান্ডের মরিচ বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ টাকায়। অথচ খোলা বাজারে একই মানের মরিচের গুঁড়া বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। তার মানে, প্রতি কেজি প্যাকেট মরিচ কিনলে ভোক্তাদের আধা কেজিতে ১শ' এবং কেজিতে ২শ' টাকা অতিরিক্ত গুনতে হচ্ছে। অথচ চট্টগ্রাম বন্দরের আমদানি চিত্র পর্যালোচনা করে গত তিন মাসে কোনো শুকনো মরিচ বাইরে থেকে আমদানি হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। একই সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মাত্র ৫৪ টন হলুদ আমদানি হলেও এর চাহিদা পূরণ করছে মূলত দেশের উৎপাদিত হলুদ। তারপরও ৫শ' গ্রামের একটি অখ্যাত কোম্পানির হলুদের প্যাকেট বিক্রি হয় ১৩৫ টাকায়। আর নামকরা ব্র্যান্ড হলে তা ২৫০ টাকা। অথচ খোলাবাজারে একই মানের হলুদের গুঁড়ার মূল্য ৮০ টাকা। এ হিসাবে প্রতি কেজি হলুদে ব্যবধান দাঁড়াচ্ছে প্রায় সাড়ে ৩শ' টাকা। জিরা, ধনিয়াসহ অন্যান্য মসলাতেও খোলা এবং প্যাকেট পণ্যের মধ্যে দামের এমন ব্যবধান রয়েছে।
আটা-ময়দা, চা পাতাসহ অন্যান্য পণ্যের প্যাকেটেও দ্বিগুণ দাম দিতে হচ্ছে ভোক্তাদের। চট্টগ্রামের ফইল্যাতলী বাজারে নজরুল ট্রেডার্স প্রতি কেজি খোলা আটা ও ময়দা বিক্রি করছে ২৫ ও ৩৫ টাকায়। অথচ নামি ব্র্যান্ডের প্যাকেটজাত আটা ও ময়দা কিনতে গ্রাহকদের দিতে হচ্ছে যথাক্রমে ৩৫ ও ৪৩ টাকা। এ হিসেবে কেবল প্যাকেটের কারণে প্রতি কেজি আটা-ময়দার দাম বাড়ছে ১০ থেকে ১২ টাকা! আবার খোলাবাজারে চা পাতার কেজি ২৬০ টাকা হলেও প্যাকেটের ক্ষেত্রে সেই দাম গিয়ে ঠেকছে ৩শ' থেকে সাড়ে ৩শ' টাকায়।
এদিকে প্যাকেট পণ্যে অতিরিক্ত দাম নেওয়ার ব্যাপারে কয়েকটি নামি কোম্পানির কর্মকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তাদের সবার উত্তর ছিল অভিন্ন। ট্যাক্স, ভ্যাট, প্যাকেজিং ও বাজারজাতসহ অন্যান্য খরচ যোগ হওয়ায় নাকি তাদের বাড়তি দাম নিতে হচ্ছে।
এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ছৈয়দ ছগীর আহমদ। তিনি সমকালকে বলেন, 'বৈধভাবে ব্যবসা করতে গেলে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। অথচ একই মানের পণ্য কেবল প্যাকেটজাত করে যারা দ্বিগুণ লাভ করছে তাদের ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তৎপরতা নেই। রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে সীমান্তপথে অবৈধভাবে মসলা নিয়ে আসা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও রহস্যজনক কারণে নিশ্চুপ রয়েছে তারা।'

No comments

Powered by Blogger.