সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুর দ্বন্দ্ব by মামুন আল মোস্তফা

ণতন্ত্র কী? দেখতে কেমন? এর আলোচনা বিষম গোলের হেতু। আমার মতো অভাজনের কাছে গণতন্ত্র লালনের 'অচিন পাখি'র চেয়েও অচেনা। প্রিয় পাঠক, কেন অচেনা, সেটার বিবরণই উদ্দিষ্ট।গণতন্ত্রের নামে, জনগণের নামে কী না হয়? কি বিদেশে, কি দেশে। গণতন্ত্রের পীঠস্থান আমেরিকা থেকেই শুরু করা যাক। কারণ পণ্ডিতরা বলেন, সেখানে জনগণের সার্বভৌমত্ব কায়েম আছে। আমেরিকার আব্রাহাম লিংকনের ১৮৬৩ সালের গ্যাটিসবার্গের ভাষণের শেষ


অংশটি গণতন্ত্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংজ্ঞা হিসেবে দুনিয়াজোড়া সমাদৃত_'জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য'। পুরো বাক্যের সারকথা ছিল : তাঁর সরকার_যেটা জনগণের, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য_যেন দুনিয়া থেকে হারিয়ে না যায়, সে জন্য সবাইকে নিবেদিতপ্রাণ হতে হবে। লিংকন যখন ভাষণটি দেন, তখন আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ চলছিল। উত্তরের রাজ্যগুলো দক্ষিণের রাজ্যগুলোর বিরুদ্ধে লড়ছিল। আর লিংকন গিয়েছিলেন তাঁর অনুগত উত্তরের সেনাবাহিনীকে উদ্দীপনা জোগাতে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, লিংকন যে 'জনগণের সরকারের' দোহাই দিচ্ছেন, তা পুরোপুরি জনগণের সরকার ছিল না। তাঁর সরকার যদি পুরোপুরি জনগণের সরকারই হবে, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে ১১টি রাজ্য মিলিতভাবে অস্ত্রধারণ করেছিল কেন? তাহলে দেখা যাচ্ছে, লিংকন সাহেব 'জনগণ' বলতে কেবল নিজের দিককার লোকদেরই বুঝিয়েছেন। এত বড় পণ্ডিত ব্যক্তি যদি 'জনগণ' বলতে কেবল নিজের অনুগতদের কথা বোঝেন, তাহলে আমাদের নেতা-নেত্রীদের দোষ হবে কেন? আমাদের এক নেত্রী যখন বলেন, দেশের জনগণ আনন্দঘন পরিবেশে ঈদ উদ্যাপন করেছে, তখন আমরা কেন বুঝে নিই না, তিনি তাঁর দলের লোকদের কথাই বলছেন। আর অন্য নেত্রী যখন বলেন, দেশের জনগণ ভালো নেই, সুখে নেই, তখন আমাদের বুঝে নেওয়া উচিত, তিনিও তাঁর কর্মী-সমর্থকদের কথা মাথায় রেখেই মন্তব্য করছেন। সাধারণভাবে আরো বুঝতে হবে, জনগণের যে অংশটি তাঁদের দলের বাইরে, তারা নেতা-নেত্রীদের হিসাবেরও বাইরে।
মার্কিন দেশে জনগণের ইচ্ছাই সব। আমাদের দেশেও তা-ই। একেই বলে জনগণের সার্বভৌমত্ব। আমাদের সংবিধান শুরু হয়েছে প্রস্তাবনার মাধ্যমে, জনগণের সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করে_'আমরা, বাংলাদেশের জনগণ...এই সংবিধান রচনা ও বিধিবদ্ধ করিয়া সমবেতভাবে গ্রহণ করিলাম।' এই জনগণের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশই হলো সংবিধানসহ যাবতীয় আইনকানুন। এরই আলোকে ১৯৭২ সালে এই জনগণ জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু একই 'জনগণ' ১৯৭৮ সালে এই চারটি নীতির দুটি পরিবর্তন করে ফেলে। তারা ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গায় আল্লাহ্র ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস এবং সমাজতন্ত্রের বদলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার_এই অর্থে সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ করে। ২০০৬ সালে এসে দেশের সর্বোচ্চ আদালত ১৯৭৮ সালের 'জনগণের অভিপ্রায়'কে অসাংবিধানিক বলে রায় দেন। ২০১১ সালে এসে সেই 'জনগণ' পঞ্চদশবারের মতো সংবিধান সংশোধন করে। সঙ্গে সঙ্গে জনগণের একটি অংশ ঘোষণা দেয়, অচিরেই তারা এই সংবিধানকে ছুড়ে ফেলে দেবে। জনগণের কী অপার লীলা!
এত শক্তিধর 'জনগণ' কারা? একটি দেশে বসবাসকারী সবাই? পণ্ডিতরা মত দেন, কোনো নির্দিষ্ট সীমানায় বসবাসকারীদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। যদি তা-ই হয়, তাহলে কিছু বিষয়ে জট খোলে। যেমন_আব্রাহাম লিংকনের সরকার জনগণের সরকার। কারণ সেখানে ২৫টি অঙ্গরাজ্যের সমর্থন ছিল। বাংলাদেশের সংবিধান ১৫ বার সংশোধন করা হয়েছে; সেগুলোতে হয়তো সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সম্মতি ছিল এবং এখনো আছে। কিন্তু মাঝে মাঝে বেশ শঙ্কা হয়। যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছামাফিক সব কিছু নির্ধারিত হয়, তাহলে তো কখনো কখনো বেশ গোল বাধতে পারে। যেমন_১৯৪৭ সালের লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী ভারত ও পাকিস্তান দুটি রাষ্ট্র হলো। সাব্যস্ত হলো, ভারতে হিন্দুরা, আর পাকিস্তানে মুসলমানরা থাকবে। কিন্তু আদতে তা হলো না। খোদ বাংলাদেশ আর পাকিস্তান মিলে যত মুসলমান, তার চেয়ে বেশি মুসলমান থেকে গেল 'হিন্দুস্তানে'। এ নিয়ে ভারতে জনগণের মধ্যে গোসসার শেষ নেই। তারা সেখানে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়; মুসলমান দেখতে চায় না। তাদের এই অভিমানকে ধারণ করার রাজনৈতিক দলও জুটে গেল_বিজেপি। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে তারা একবার সরকারও গঠন করেছিল। এখন বিরোধী দলে। কিন্তু সরকারে আসাটা একটি নির্বাচনের ব্যাপার মাত্র। তারা যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের আবেগকে ধারণ করে মুসলমানদের পাকিস্তানে আর বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করে, তাহলে কী হবে? সেটা তো গণতান্ত্রিকই হবে। আচ্ছা, কোথাও পাঠানোর ব্যবস্থা করল না, বরং সে দেশেই রাখল এবং সংবিধানে লিখে দিল_মুসলমানসহ ভারতের জনগণের সব কাজের মূল ভিত্তি হবে 'দেব-দেবী'দের ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস (এ রকম একটা কিছু বাংলাদেশেও অনেক দিন চালু ছিল)। সেটাও তো গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত হবে। তাই গণতন্ত্র আর জনগণের সিদ্ধান্তের কথা যখন আসে, তখন খুবই ভীত হয়ে পড়ি। ভীত হই যখন দেখি, এ দেশের ছোট ছোট জাতিসত্তা বৃহত্তর জাতীয় পরিচয়ের মধ্যে থেকেই নিজেদের জন্য আলাদা একটু জায়গা চেয়ে যাচ্ছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠরা তাতে কান দিচ্ছে না। নিন্দুকরা ধারণা করেন, তাঁদের কথা কখনো শোনা হবে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কি সহিংস ইতিহাসের কথা একেবারেই ভুলে যেতে চায়?
আমি জোর করে হলেও ভাবতে চাই, বাংলাদেশে কখনো এমন সংখ্যাগরিষ্ঠতা হবে না, যেখানে সংখ্যালঘুর বিশ্বাসকে, পরিচয়কে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে ঢেকে ফেলার চেষ্টা করা হবে। গণতন্ত্র মানে কি কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠতার বড়াই? হিটলার যখন অসহায় ইহুদিদের দেশছাড়া করছিলেন, দুনিয়াছাড়া করছিলেন, তখন সেই সিদ্ধান্তের পেছনে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতাই ছিল না, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। তাহলে সিদ্ধান্তটা কোন দিক থেকে অগণতান্ত্রিক ছিল?
লেখক : প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.