রাজনৈতিক নোংরামি, প্রতিষ্ঠান হারাচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ-তিন বছরে ৭৫ শিক্ষক-কর্মচারী চাকরিচ্যুত by অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য

রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হওয়ায় দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিচালনা কমিটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান পদে দলীয় অনুগতদের নিয়োগ দিয়ে থাকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক 'নোংরামি'র কারণে বর্তমান সরকারের তিন বছরে সারা দেশে ৭৫ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। মতাদর্শ ভিন্ন হওয়ায় এসব শিক্ষকের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা


জানিয়েছেন।চাকরিচ্যুতদের মধ্যে ৩১ জন অধ্যক্ষ, ছয়জন উপাধ্যক্ষ, একজন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, চারজন সহকারী অধ্যাপক, ১৫ জন প্রভাষক, চারজন প্রধান শিক্ষক, একজন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, একজন সুপার, পাঁচজন সহকারী প্রধান শিক্ষক, তিনজন সহকারী শিক্ষক, একজন অফিস সহকারী ও তিনজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী রয়েছে। বাংলাদেশ নির্যাতিত শিক্ষক-কর্মচারী ফোরামের এক পরিসংখ্যানে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের অক্টোবর মাসে এ ফোরামের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরপরই বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের ভিন্ন মতাদর্শ, তোয়াজনীতি অনুসরণ না করায় শিক্ষকদের চাকরিচ্যুতসহ নানা হয়রানি করা হয়। আর এর প্রভাব পড়ে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। তাদের মতে, বিএনপি শাসনামলে আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষক-কর্মচারীদের আর আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিএনপিপন্থী শিক্ষক-কর্মচারীদের নানাভাবে হয়রানিসহ চাকরিচ্যুত করা হয়। স্বাধীনতার ৪০ বছরেও এর পরিবর্তন হয়নি বলে তাঁরা মনে করেন। শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ বজায় রাখতে শিক্ষকদের ওপর এভাবে নির্যাতন বন্ধ করার কথাও বলছেন তাঁরা।
বাংলাদেশ নির্যাতিত শিক্ষক-কর্মচারী ফোরামের আহ্বায়ক অধ্যক্ষ রাফিকা আফরোজ কালের কণ্ঠকে বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দলীয়করণের উদ্দেশ্যে ঢাকাসহ সারা দেশে ৭৫ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এ ছাড়া সহস্রাধিক বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীকে জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করা, চাকরি থেকে অব্যাহতি, অবৈধভাবে সাময়িক বরখাস্ত, চূড়ান্ত বরখাস্ত, বেতন ভাতা বন্ধ, সামাজিকভাবে হেয়, হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনসহ বিভিন্নভাবে হুমকির সম্মুখীন হতে হয়েছে। তিনি বলেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আদালতের রায় পাওয়ার পরও অনেককে কর্মস্থলে যোগদান করতে দেওয়া হচ্ছে না।
সংগঠনটির সদস্যসচিব বাহাউদ্দিন বাহার বলেন, শিক্ষক বাঁচলে শিক্ষা বাঁচবে, শিক্ষা বাঁচলে দেশ বাঁচবে। তাই শিক্ষাকে রক্ষা করতে হলে অবিলম্বে সারা দেশের নির্যাতিত শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রাপ্য সুবিধা দিতে হবে। তিনি বলেন, আগের সরকারের আমলেও একইভাবে শিক্ষকদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এ ধরনের চাকরিচ্যুতি বন্ধ হওয়া দরকার।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক মো. নোমান উর রশীদ বলেন, 'প্রথমত, আমি এ পরিসংখ্যান জানি না। দ্বিতীয়ত, এসব হয়রানি থেকে শিক্ষকদের সুবিধা দেওয়ার জন্য মাউশির আইন সেল রয়েছে। এ আইন সেল শিক্ষকদের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দিতে সাহায্য করে।'
যাঁদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে : প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা ইস্পাহানী গার্লস কলেজের অধ্যক্ষ রাফিকা আফরোজকে তাঁর কলেজে প্রায় তিন ঘণ্টা অবরুদ্ধ রেখে চাপ প্রয়োগ করে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়। তিনি আদালতে মামলা করলেও তা নিষ্পত্তি না করেই কর্তৃপক্ষ আইন অমান্য করে অধ্যক্ষ পদে আরেকজনকে নিয়োগ দিয়েছে।
পটুয়াখালী জেলার আবদুল করিম মৃধা কলেজের অধ্যক্ষ বাহাউদ্দিন বাহার বিরোধী দলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় তাঁকেও সরিয়ে দেওয়া হয়। ধর্ম প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শাজাহান মিয়া প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি হওয়ার তিন দিনের মাথায় তাঁর বাসায় অন্যায়ভাবে সভা ডেকে আলোচ্যসূচি ছাড়াই অধ্যক্ষ বাহারউদ্দিন বাহারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ বিষয়ে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন বিচারাধীন ছিল। বরখাস্তের সে বিষয়টিও আমলে নেওয়া হয়নি।
ঢাকা মহানগরের ধানমণ্ডি ড. মালিকা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ মো. আবদুস সাদিককে ওই প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল চারদলীয় জোট সরকারের আমলে। শুধু এ অপরাধে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাঁর কক্ষে তালা লাগিয়ে কোনো কারণ ছাড়াই বিধিবহির্ভূতভাবে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এইচএসসি পরীক্ষার সময় হলে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেন মোমবাতি জ্বালানো হয়নি_এ অভিযোগে ঢাকার কেরানীগঞ্জের ইস্পাহানী কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল কাইয়ুমকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। গাজীপুরের শ্রীপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ তোফাজ্জল হোসেন আকন্দ কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সভা চলাকালে অর্ধশতাধিক সন্ত্রাসী প্রবেশ করে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নিয়ে অধ্যক্ষকে কলেজ থেকে বের করে দেয়। পরে ওই কলেজের ২৬ জনকে ডিঙ্গিয়ে ২৭ নম্বরকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
রাজবাড়ীর পাংশা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মাহামুদুল হক রুজেন জেলা বিএনপির নেতা। এ অপরাধে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তিনি আদালতের শরণাপন্ন হন। কিন্তু আদালত অবমাননা করে অধ্যক্ষকে চূড়ান্তভাবে অপসারণ করা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক তদন্তে প্রমাণিত ও দুর্নীতির দায়ে ঢাকার যাত্রাবাড়ীর দনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বরখাস্তকৃত অধ্যক্ষ মো. সাহাদত হোসাইন অবৈধভাবে তালা ভেঙে অধ্যক্ষের কক্ষ দখল করেন। এ অনিয়মের প্রতিবাদ করায় কলেজের উপাধ্যক্ষ মো. একরামুল হকের বেতন ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে কোনো তদন্ত ছাড়াই উপাধ্যক্ষকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। একই কারণে ওই কলেজের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক জামিলা রশিদকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ছাড়া ক্ষমতাসীন দলের ঢাকা-৫ আসনের সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান মোল্লা এ কলেজের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ খাদেম আশরাফুল আলমকে কলেজে যেতে নিষেধ করেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
সোনারগাঁও কাজী ফজলুল হক উইম্যানস কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ আমির হোসেনকে পদত্যাগ করতে বলেন। তিনি রাজি না হওয়ায় চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে তাঁকে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়।
বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যক্ষ রেজাউল করিম বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের অত্যাচারে শিক্ষকরা দিশেহারা। একের পর এক শিক্ষক চাকরিচ্যুত হচ্ছেন। ১০০ টাকা বাড়িভাড়া দিয়ে শিক্ষকদের মর্যাদাহানি ঘটানো হচ্ছে। স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কলেজে শিক্ষকদের এমপিও দেওয়া হচ্ছে না।

No comments

Powered by Blogger.