সন্দেহভাজন হয়ে হাজত খাটে নিরপরাধ মানুষ-চলে পুলিশের গ্রেপ্তার-বাণিজ্য, অনেকেই হয় নিঃস্ব by আশরাফ-উল-আলম

পরাধী শনাক্ত না করা গেলে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি উল্লেখ করে থানায় মামলা করা হয়। এমন সব মামলায় আসামি গ্রেপ্তার করা হয় সাধারণত ঢালাওভাবে। চলে ক্ষমতার অপব্যবহার। এভাবে গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের বেশির ভাগই একসময় অব্যাহতি পায়। ততদিনে যা ক্ষতি হওয়ার তা তো হয়েই যায়। কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে বেশ কিছু মামলায় দেখা গেছে, সন্দেহভাজন হয়ে গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের অনেকেই পুলিশ ও আদালতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি
বা আইনজীবীদের জন্য টাকা খরচ করতে করতে কেউ কেউ নিঃস্ব হয়ে গেছেন।\রাজধানীর কয়েকটি থানার বেশ কয়েকটি মামলার নথি থেকে জানা যায়, হত্যা, চুরি, ডাকাতিসহ যেসব মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে আসামি করা হয়, সেসব ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটিত হয় খুব কমই। এসব মামলায় অসংখ্য ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হয় না।
গুলশান থানায় দুই বছর আগে গ্রেপ্তার হওয়া ফারুক (পুরো নাম নয়) নামে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নিজের ঠিকানা প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁকে একটি মামলায় সন্দেহভাজন অপরাধী হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকারী পুলিশ কর্মকর্তা থানায় নেওয়ার পরই বলেন, টাকা খরচ না করলে রিমান্ডে নেওয়া হবে। তিনি টাকা দিতে পারেননি। এরপর তাঁকে রিমান্ডে নেওয়া হয়। এরপর আবার তাঁর কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হয়। স্বজনরা কিছু টাকা দেন। পুলিশের দাবি পূরণ করতে না পারায় তাঁকে আরেকটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এভাবে তাঁকে তিনটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে তিনি আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পান। এরপর আবার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে তাঁকে ওই সব মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে বলে তদন্ত কর্মকর্তা তাঁর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নেন। পরে তাঁকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে প্রতিবেদন দেওয়া হয়।
রাজধানীর রমনা মডেল থানা এলাকার ৯২, নিউ সার্কুলার রোডে নির্মাণাধীন একটি বাড়ির চতুর্থ তলার সিঁড়িতে এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায় ২০০৯ সালের ৩০ অক্টোবর। ওইদিনই থানা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) কাজী মো. মহিনুল ইসলাম একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরিকল্পিতভাবে শ্বাসরোধে ওই ব্যক্তিকে হত্যা করা হয় বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়। মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করা হয়। গ্রেপ্তার হয় ১৬ জন। দেড় বছর তদন্ত করে এ মামলায় গত ৫ মে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে আসামিদের অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করে পুলিশ। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
গুলশান থানা এলাকার প্রগতি সরণির হাজি এন্টারপ্রাইজ নামের দোকানে ২০০৪ সালের ১৩ জুন তিন অস্ত্রধারী যুবক আগ্নেয়াস্ত্রসহ ঢুকে পড়ে। তারা দোকানের মালিক আব্বাস আলীর মাথায় গুলি করে কালো রঙের একটি ট্যাঙ্কি্যাবে করে পালিয়ে যায়। এই ট্যাঙ্কি্যাবেই তারা এসেছিল। এ সময় স্থানীয় জনতা ট্যাঙ্কি্যাবের পেছনে পেছনে দৌড়াতে থাকে। ট্যাঙ্কি্যাবটি কুড়িল চৌরাস্তার কাছে থামিয়ে খুনিরা একটি বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে। তাদের আর পাওয়া যায়নি।
এ ঘটনায় আব্বাস আলী নিহত হন। গুলশান থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহতের ছোটভাই আলতাব হোসেন। এজাহারে বলা হয়, সাক্ষীরা হত্যাকারীদের দেখলে চিনতে পারবেন। তদন্তে কোনো কূলকিনারা না পেয়ে গুলশান থানা পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দিলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ ঘটনার তদন্তে নামে। তারাও ব্যর্থ হয় এবং ২০০৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সিআইডি পরিদর্শক মো. আকবর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। তদন্তকালে যাঁরা গ্রেপ্তার হন, তাঁদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। মামলার নথি থেকে দেখা যায়, ঘটনার তদন্ত চলাকালে বিভিন্ন সময় ২০ সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
রমনা থানার মামলা নম্বর ৫২, তারিখ ১৪ মে, ২০০৬ সাল। এটি একটি হত্যা মামলা। এ মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে এ পর্যন্ত ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।
একটি টাকা চুরির মামলায় অজ্ঞাতপরিচয়দের আসামি করে কদমতলী থানায় মামলা করেন রেজাউল করিম নামে এক ব্যক্তি। মামলা নম্বর ২১, তারিখ ২০ মার্চ, ২০১১। এ মামলায় চারজনকে সন্দিগ্ধ আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়। গত ১০ মে পুলিশ মামলাটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। অব্যাহিত পান আসামিরা।
২০০৬ সালের ১ মে বাড্ডা থানায় অজ্ঞাতপরিচয়দের আসামি করে আবুল কালাম আজাদ নামের এক ব্যক্তি একটি চুরির মামলা দায়ের করেন (মামলা নম্বর ৫)। মামলার তদন্তকালে পুলিশ মো. ফারুক হোসাইন ওরফে হাসান, মো. হান্নান, মো. শামীম, মো. সেন্টু, বাচ্চু মিয়া, মো. জাকির, নাছির উদ্দিন, মিলন হোসেন, কামাল হোসেন ও বশির_এই ১১ জনকে গ্রেপ্তার করে। একই বছরের ২৯ জুলাই পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। অব্যাহতি পান আসামিরা। একই থানায় জুলাই মাসের ২৯ নম্বর মামলায় ১১ জনকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়। ঘরের দরজা ভেঙে পাঁচ লাখ টাকার মালামাল চুরির মামলা ছিল এটি। এ মামলায়ও একই বছরের ডিসেম্বরে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।
২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মোহাম্মদপুর থানায় দায়ের করা একটি হত্যা মামলায় বিভিন্ন সময়ে সাতজন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত ৯ অক্টোবর আদালত চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে সাত আসামিকেই মামলা থেকে অব্যাহতি দেন।
শুধু এ কটি মামলায়ই নয়। এরকম অসংখ্য মামলা হয় রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে। অজ্ঞাতপরিচয়দের আসামি করে ঢাকায় কতটি মামলা দায়ের করা হয় তার হিসাব সংশ্লিষ্ট আদালত বা কোনো দপ্তরে রাখা হয় না। তবে ঢাকার আদালতে গড়ে মাসে প্রায় দুইশটি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এসব মামলা ঢাকার ৪১টি থানায় দায়ের করা মামলা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণা, অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করে দায়ের করা মামলায় প্রতি মাসে কয়েকশ লোককে গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রায় সব ক্ষেত্রেই সন্দেহভাজন আসামিদের গ্রেপ্তার করে তাদের আদালতে পাঠানোর পর পুলিশ রিমান্ডে নেয়। আইনজীবীদের কাছে জানা যায়, প্রত্যেক আসামির ক্ষেত্রে রিমান্ডের আবেদনে বলা হয়, আসামিদের বিরুদ্ধে ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে, সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। রিমান্ড শেষে আবার আদালতে পাঠিয়ে আসামিদের জেলহাজতে পাঠানোর সুপারিশ করে তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদন দেন। ওই প্রতিবেদনেও বলা হয়, আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে ইত্যাদি। অথচ দীর্ঘদিন তদন্তের পর আসামিদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
ফৌজদারি আইনে অভিজ্ঞ এমন আইনজীবীদের কাছে আরো জানা যায়, গ্রেপ্তার থেকে অব্যাহতি পাওয়া পর্যন্ত আসামিদের মধ্যে অনেক নিরীহ ব্যক্তি থাকেন, যাঁদের বিরুদ্ধে কখনো কোনো অভিযোগ নেই বা দেশের কোনো থানায় মামলা নেই, এমন ব্যক্তিও থাকেন। আর এসব নিরীহ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের শুরু থেকেই পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয়। আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীনও হতে হয়। গ্রেপ্তার হওয়ার পর ঘাটে ঘাটে পুলিশকে টাকা দিতে হয়। আদালত থেকে জামিন নিতে আইনজীবী ও আদালতের কর্মচারীদের ঘাটে ঘাটে টাকা দিতে হয়। এভাবে অনেককে সহায় সম্বল বিক্রি করে দিতে হয়।
ফৌজদারি মামলা পরিচালনা করেন এমন একজন অভিজ্ঞ আইনজীবী সৈয়দ আহমেদ গাজী কালের কণ্ঠকে বলেন, পুলিশ সন্দেহ করে গ্রেপ্তার করেছে এমন অনেক আসামির পক্ষেই তিনি মামলা পরিচালনা করেছেন। তিনি বলেন, গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া, অন্য আরো মামলায় জড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে, সবশেষে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা বলে আসামিদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে থাকে পুলিশ। তিনি আরো বলেন, সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তারের কিছু নীতিমালা থাকা দরকার। আইনে সন্দেভাজনদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে দিকনির্দেশনা রয়েছে। তবে তা মানা হচ্ছে না। সন্দেহভাজনদের গ্রেপ্তার এ দেশের পুলিশের একটি ব্যবসা বলে তিনি মনে করেন। আরেকজন তরুণ আইনজীবী রিপন নিজের অভিজ্ঞতায় বলেন, গ্রেপ্তারের পর পুলিশকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে এসব আসামিকে পার পেতে হয়।
বিশিষ্ট আইনজীবী ও ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, আমলযোগ্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সন্দিগ্ধ আসামি গ্রেপ্তারে পুলিশ ক্ষমতার অপব্যবহার করে বলে নানা অভিযোগ রয়েছে।
ফৌজদারি মামলা পরিচালনাকারী বিশিষ্ট আইনজীবী ও ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. বোরহান উদ্দিন বলেন, ঘটনাস্থলের মানুষ বা প্রত্যক্ষদর্শীর প্রাথমিক সাক্ষ্য নিয়ে বা প্রত্যক্ষদর্শী না থাকলে পারিপাশ্বর্িক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা কাউকে সন্দেহ করে গ্রেপ্তার করতে পারেন। কিন্তু এদেশে ঢালাও গ্রেপ্তার করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি আরো বলেন, প্রভাবশালীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার চাপে (কাউকে গ্রেপ্তার করতে না পারলে ওপরের থেকে বলা হয় কোনো কাজই করে না) যাচাইবাছাই ছাড়া গ্রেপ্তার করা হয়। আর গ্রেপ্তার করলেই কিছু অনৈতিক সুবিধা আদায় করা যাবে_এমন অভিযোগ তো রয়েছেই।
ঘটনার কোনো ক্লু ছাড়া অযথা কাউকে গ্রেপ্তার করলে আসামিরা হয়রানির শিকার হন এমন বক্তব্য স্বীকার করে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মো. আবদুল্লাহ আবু বলেন, পুলিশকে আসামি গ্রেপ্তারে সচেতন হতে হবে। তবে তিনি বলেন, আইনে অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছে এমন সন্দেহে কাউকে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া আছে। পুলিশ সেই কাজটিই করে। মাঝে মাঝে পুলিশ বাড়াবাড়ি করে স্বীকার করে তিনি বলেন, তদারকির ব্যবস্থা থাকলে এমনটি হতো না।
চলছে 'পলিটিক্যাল ড্রাইভ'

No comments

Powered by Blogger.