ইতিহাস ভুলে আশাবাদী বাংলাদেশ by সাইদুজ্জামান

শুরুতেই বেমক্কা টোয়েন্টি টোয়েন্টি!
ওয়ানডেতে মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে গেছে বাংলাদেশ। টেস্টেও একে-ওকে কখনো-সখনো বিপাকে ফেলে বাংলাদেশ। কিন্তু টোয়েন্টি টোয়েন্টি? মাত্রাতিরিক্ত শট খেলার বদভ্যাস নিয়ে যে দলকে প্রতিনিয়ত সমালোচিত হতে হয়, সেই বাংলাদেশ দলের তো ২০ ওভারের ক্রিকেটকে ঈদ আনন্দ মনে হওয়ার কথা। কিন্তু টিম বয় থেকে শুরু করে বাংলাদেশ অধিনায়কও টোয়েন্টি টোয়েন্টি প্রসঙ্গে সংকুচিত। মুশফিকুর রহিমের ম্যাচ-পূর্ব কথাবার্তায় আশার চেয়ে নিরাশার ছায়াটাই প্রগাঢ়।


অবশ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের অধিনায়ক ড্যারেন সামি আজ টোয়েন্টি টোয়েন্টি দিয়ে মিরপুরে শুরু হওয়া ওয়ালটন সিরিজের প্রচারণায় নেমে পড়েছেন, 'মনে হচ্ছে কাল (আজ) সবাই জমজমাট ক্রিকেটই দেখতে পাবেন।'
ইদানীং মিরপুরে দর্শক টানার জন্য বিজ্ঞাপনের প্রয়োজন হয় না। সদ্য সমাপ্ত বিসিবি কাপের ম্যাচেও হাজার আটেক দর্শক ছিলেন গ্যালারিতে। আর গতকালের খবর, সৌজন্য টিকিট তো বটেই, দিবা-রাত্রির এ ম্যাচের টিকিট দর্শনীর বিনিময়েও পাওয়া যাচ্ছে না! জাতীয় দলের অধিনায়কত্বের দিনে মুশফিকুর রহিম এ দর্শক আগ্রহকে অনুপ্রেরণা হিসেবেই নিচ্ছেন, 'দর্শক আমাদের পক্ষে থাকবে। নিজেদের মাঠে খেলা। এটাও একটা ইতিবাচক দিক।' ঘরের মাঠে চেনা উইকেট আর গ্যালারিভরা দর্শক যে বাংলাদেশের বাড়তি শক্তি, সেটি স্বীকার করছেন ড্যারেন সামিও, 'দেশের মাটিতে বাংলাদেশ কঠিন প্রতিপক্ষ।' দুই অধিনায়কের ম্যাচ-পূর্ব ভাবনায় আরেকটি বড় মিল আছে। অবশ্য সে মিল ক্রিকেটের প্রাথমিক পাঠেও আছে_নির্দিষ্ট দিনে যে দল ভালো খেলবে, সে দলই জিতবে।
টোয়েন্টি টোয়েন্টি ফরম্যাটে কতটা ভালো খেলার সামর্থ্য রাখে বাংলাদেশ? মাত্র একটা সিরিজ আর কিছু প্রস্তুতি ম্যাচে জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের দেখেছেন স্টুয়ার্ট ল। যা দেখে নিজের উপলব্ধিটা গতকাল একটু অন্যভাবে প্রকাশ করেছেন অস্ট্রেলীয় এ কোচ, 'টোয়েন্টি টোয়েন্টি মানেই চার-ছক্কা নয়। আমি চাই ছেলেরা স্মার্ট ক্রিকেট খেলুক। জোরে মারতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। ব্যাপার হলো, বল ফিল্ডারের ফাঁক গলে গেল কি না।' এ সমস্যার আবর্তেই যে আটকে আছেন বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানরা! ফিল্ডিংয়ের ফাঁক খুঁজে বের করার চেয়ে প্রতি বলেই মারতে উন্মুখ ব্যাটসম্যান। যা বিপদ ডেকে আনে। আবার সাময়িক সাফল্য এলেও অতিরিক্ত শট খেলার কারণে গতি হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে পুরো দলের ইনিংস।
অধিনায়কত্ব ক্যারিয়ার শুরুর আগে সহ-খেলোয়াড়দের বিশাল চিঠি দিয়েছেন মুশফিকুর রহিম। যে চিঠির প্রতিটি ছত্রে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের অনুরোধ ছিল বলেই জানা গেছে। গতকালও সে দায়িত্ববোধের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি। বিশেষ করে ব্যাটসম্যানদের, 'দেশের মাটিতে স্পিন আমাদের মূল শক্তি। গত এক বছর ধরে পেসাররাও ভালো করছে। আমি মনে করি দলকে জেতানোর ৬০ ভাগ দায়িত্ব ব্যাটসম্যানদের নিতে হবে। সেটা তারা জানেও।'
টোয়েন্টি টোয়েন্টির অলি-গলি না চিনলেও একটা ব্যাপারে বাংলাদেশ দল নিশ্চিত যে, মিরপুরের উইকেটে ১৪০/১৫০ রান করতে পারলে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে 'ধরে' ফেলা যাবে। আর সেই রানটা করতে হলে চাই ভালো শুরু। অনভ্যস্ততার পাশাপাশি টোয়েন্টি টোয়েন্টি ব্যর্থতার চিহ্নিত দ্বিতীয় কারণ পাওয়ার হিটিংটা ভালোই জানেন তামিম ইকবাল। তাঁর উদ্বোধনী সঙ্গী ইমরুল কায়েসও মিড উইকেট বাউন্ডারির ওপর দিয়ে বল গ্যালারিতে পাঠাতে জানেন। তিন নম্বরে মোহাম্মদ আশরাফুল কী পারেন আর কী পারেন না, এটা মিরপুর স্টেডিয়ামসংলগ্ন খুদে ব্যবসায়ীরাও জানেন! আশরাফুল যেন এ দেশের চলমান ক্রিকেট প্রতিচ্ছবি! প্রতিভার কমতি নেই। কিন্তু বিপুল ঘাটতি প্রয়োগ ক্ষমতায়। টেস্ট-ওয়ানডে তো বটেই, আন্তর্জাতিক টোয়েন্টি টোয়েন্টিতেও সবচেয়ে অভিজ্ঞ বাংলাদেশি ক্রিকেটার আশরাফুল। সফলতমও। ২০০৭ টোয়েন্টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জেতা ম্যাচে ৬১ রানের দুর্দান্ত একটি ইনিংস আছে আশরাফুলের।
জোহানেসবার্গের সে ম্যাচ অনায়াসে আজকের অনবদ্য অনুপ্রেরণা হতে পারত। ৬ উইকেটে সেই জয়ের কথা উঠছেও। তবে সেটার রেশ কাটতে না কাটতেই পর্দা সরিয়ে চোখ রাঙাচ্ছে নিকট-অতীত। এ মাঠেই ২০১১ বিশ্বকাপ ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ৫৮ রানে চুরমার হয়েছিল বাংলাদেশ। শেষ আন্তর্জাতিক টোয়েন্টি টোয়েন্টির স্মৃতিও সুখকর নয় বাংলাদেশ দলের। ২০১০ সালে হ্যামিল্টনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ৭৮ রানে গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ। ১৬ টোয়েন্টি টোয়েন্টি ম্যাচে মাত্র ছয়বার পুরো ২০ ওভার ব্যাটিং করেছে বাংলাদেশ!
পরিসংখ্যান ঘাঁটাঘাঁটি করলে আরো ভীতিকর কিছু ঘটনা হয়তো আবিষ্কারও করা যাবে। কিন্তু অধিনায়কত্ব শুরুর দিনে নেতিবাচক যেকোনো আলোচনা থেকে শতহস্ত দূরে থাকতে চান মুশফিকুর রহিম, 'অতীতে নেতিবাচক কথা ভেবে আমাদের কোনো লাভ হয়নি। আমি সব কিছু ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে চাই।' দেখতে চান বলেই আইপিএল এবং কাউন্টিতে টোয়েন্টি টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলা সাকিব আল হাসান এবং তামিম ইকবালের ওপর সব দায় চাপিয়ে সরে পড়ছেন না অধিনায়ক, 'দলের ১১ জনের কাছ থেকেই প্রত্যাশিত নৈপুণ্য চাই। কারণ সিরিজের শুরুটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। নিউজিল্যান্ড সিরিজে প্রথম ম্যাচ জেতার পর ওরা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল। এ সিরিজেও তাই শুরুটা ভালো করতে চাই।'
সেটা সম্ভবও। যদি স্টুয়ার্ট ল'র প্রত্যাশিত 'স্মার্ট ক্রিকেট' খেলতে পারেন ব্যাটসম্যানরা। যদি রুবেল হোসেন এবং শফিউল ইসলাম প্রতিপক্ষের শুরুর ঝড়টা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন তো অব্যর্থ অস্ত্র হাতে যুদ্ধে নামবেন মুশফিকুর রহিম। স্পিন_মিরপুরের উইকেটে যে অস্ত্র বরাবরই ধারালো মনে হয়ে থাকে। যে অস্ত্রের সামনে অসহায়বোধ করে ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যানরা। চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে আসা টোয়েন্টি টোয়েন্টির দুর্ধর্ষ ব্যাটসম্যান কিয়েরন পোলার্ডের স্পিন অসহায়ত্বও সর্বজনবিদিত। ফতুল্লায় মারলন স্যামুয়েলস সেঞ্চুরি করেছেন বটে। তবে সে ম্যাচে সাকিব-রাজ্জাকরা খেলেননি। আর ফতুল্লা এবং মিরপুরের উইকেটের পার্থক্য যাত্রাবাড়ীর চৌরাস্তার চেয়েও দুর্বোধ্য।
তাই স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ দল। যে স্বপ্নভঙ্গেও বেদনা কিংবা ক্ষোভ নেই। যে দলের খেলাটাই রপ্ত করে ওঠা হয়নি, সে দলের কাছে জয়ের দাবি জানানোর যে উপায়ই নেই!

No comments

Powered by Blogger.