এক জয়ে সব আক্ষেপ দূর by শাহজাহান কবির

হাফিজুল ইসলামের বেশ কয়েকবার মনে হয়েছে, 'খেলাটা ছেড়ে দেই।' শুরুতেই ধাক্কা খেয়েছিলেন। বিজেএমসির ট্রায়ালে ২০০ মিটারের ১২টা দৌড় দিতে হবে একটানা। হাফিজুল ৭ রাউন্ড দিয়েই অজ্ঞান। কোচ মিলজার হোসেন এবং তাঁর অ্যাথলেট স্ত্রী হামিদা বেগমের এরপর এই তরুণকে স্প্রিন্টে আকৃষ্ট করতে অনেক বোঝাতে হয়েছে। 'উনারা বলতেন, ঘাবড়ানোর কী আছে। প্রথম প্রথম তো এমন হয়ই। ঢাকায় গিয়ে সারা দেশের অ্যাথলেটদের তুমি যখন পেছনে ফেলবে, তখন বুঝবে আনন্দটা কেমন।'


বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতিশ্রুত সেই আনন্দের খোঁজ পাওয়াটা এর পরও সহজ হয়নি। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে বেশ কয়েকবার লড়াইয়ে নেমেও যখন আবদুল্লাহেল কাফি, আবু আবদুল্লাহ, শামসুদ্দিনদের পেছনে ফেলা গেল না, মনটা আবার দমে যেতে থাকল হাফিজুলের। আর্মি স্টেডিয়ামে অনুশীলন করছিলেন, সেখানেই দেখা বিমল তরফদারের সঙ্গে। যেন স্বপ্নের নায়কের মতো উদয় হয়েছিলেন। হাফিজুলের কাছে বিমলের গল্প একরকম রূপকথাই মনে হতো। সেই বিমল আমেরিকা থেকে ফিরে হাফিজুলের কাঁধে হাত রেখে অভয় দিলেন, 'তোমার তো তাও ৫ ফুট ৪, আমি ছিলাম ৩। তাহলে পারবে না কেন তুমি? উচ্চতাটা বড় ফ্যাক্টর না, মনের জোরই আসল।' সেই মনের জোরে ২০০৭ সালের চ্যাম্পিয়নশিপে ১০.৫০ টাইমিং করলেন হাফিজুল। কিন্তু তাতেও হলো না, 'অলিম্পিক খেলা' আবু আবদুল্লাহ সোনা জিতলেন ১০.৩০ টাইমিং করে, শামসুদ্দিন করলেন ১০.৪০। হাফিজুলের তাই ব্রোঞ্জ। কিন্তু হতাশ হলেন না। তত দিনে টাইমিংয়ের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার নেশাটা যেন চেপে বসেছে। এসএ গেমসের অনুশীলন ক্যাম্পের ডাক পড়ল এক বছরের জন্য। বাংলাদেশের একজন অ্যাথলেটের কাছে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি বোধহয় কিছু নেই। বছরজুড়ে নিবিড় প্রশিক্ষণের সেই সুযোগ পেয়ে হাফিজুলের উৎসাহ বাড়ল কয়েক গুণ, তবে তৃতীয় দুর্ঘটনাটাও ঘটল এর কয়েক দিনের মধ্যেই।
পায়ের পেশিতে চোট পেলেন। ছোটখাটো ইনজুরি নয়, এসএ গেমসে কিছু করে দেখানোর স্বপ্নটাই গেল, বেরিয়ে যেতে হলো ক্যাম্প থেকে। মহাধুমধামে গেমসের সেই মহাযজ্ঞ যতই এগিয়ে আসে, হাফিজুলের মন ততই বিষণ্ন হয়। একদিন মাঠের এক কোণে বসে আর সবার অনুশীলন দেখছিলেন। বিমান বাহিনীর কোচ ওয়ারেন্ট অফিসার হাফিজকে পাশ দিয়ে যেতে দেখে প্রশ্নটা করেই বসলেন, 'স্যার, আমি কি আর ট্র্যাকে ফিরতে পারব না?' সেদিন আরো একবার স্নেহের পরশ পেলেন শেরপুরের এই তরুণ। 'মাঝে মাঝে মনে হতো, বাপদাদার ডিসপেন্সারিতে বসে থাকলেও এখন কত ভালো থাকতাম। আমার দাদা ছিলেন পল্লী চিকিৎসক, বাবাও। ছোটবেলায় দাদার টেবিলে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতাম, দাদা রোগী দেখতেন, ওষুধ বানাতেন। পরে বাবাও তাই করলেন। এলাকায় তাঁদের একটা খ্যাতি তৈরি হয়ে গেছে। আমি নিজেও এই পেশাটাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম।' তারপর ঘটনাচক্রেই অ্যাথলেট বনে গেলেন হামিদুল। কিছুটা নিজের কৌতূহল, কিছুটা স্থানীয় কোচ ও সাবেক অ্যাথলেট মিলজার হোসেনের অনুপ্রেরণায়, 'একসময় দেখলাম প্র্যাকটিস করতে আমারও ভালো লাগছে। তার ওপর বিজেএমসির চাকরির প্রস্তাবটা ছিল। মনে হলো, ভালোই তো খেলাধুলা করছি আবার নিজের হাতখরচটাও হয়ে যাচ্ছে।'
সেই হাফিজুল ইনজুরিতে পড়ে আক্ষেপের ফাঁদে আটকা পড়ছিলেন প্রায়। ওয়ারেন্ট অফিসার হাফিজ পথ দেখাননি, তবে সামর্থ্য আর আত্মবিশ্বাসের তন্ত্রিটা নাড়িয়ে দিয়েছিলেন কেবল, 'অ্যাথলেটের জীবনে ইনজুরিটা তো অনুষঙ্গ। ইনজুরিতে পড়েছ মানে, ট্রেনিংয়ে ১০০ ভাগ ঢেলে দিয়েছিলে তুমি। নইলে ইনজুরিতে পড়তে না। আর যারা ইনজুরিতে পড়ে না, ট্রেনিংয়ে শতভাগ দেয় না, তারা তাই সেরাও হতে পারে না।' শুনে হাফিজুলের অ্যাথলেট জীবনের শুরুর স্বপ্নটাই আবার যেন ফিরে আসে সর্বগ্রাসী হয়ে। এবারের সামার মিটের আগে আজহারুল ইসলামের নাম শোনা গেছে, নতুন তারকা হয়ে উঠেছিলেন মোহন খান। কিন্তু হাফিজুলের কথা সবাই যেন ভুলেই গিয়েছিলেন। অথচ অলিম্পিয়ান আবু আবদুল্লাহ বা বিকেএসপির বর্তমান কোচ আবদুল্লাহেল কাফিদের চ্যালেঞ্জ জানিয়েই হাফিজুলের উঠে আসা। কিন্তু কাঁহাতক আর ধৈর্য থাকে। ক্রম বিবর্ণ অ্যাথলেটিঙ্ অঙ্গন নিয়ে কারোই যখন আর আগ্রহ নেই, তখন এক তরুণের বারবার হোঁচট খেতে খেতে এগিয়ে চলা জীবন সংগ্রামের খোঁজ কে রাখে!
কিন্তু হাফিজুলের স্বপ্নটা মিথ্যে হয়নি। দর্শকশূন্য স্টেডিয়াম, আয়োজনের শত অব্যবস্থাপনা_স্বপ্নটা এতটা সাদা-কালো হয়তো ছিল না। কিন্তু অন্তর্গত এক আনন্দের কাছে এসব যেন ধর্তব্যের না। দৌড় শেষ করে হাফিজুল দুই হাত যখন মেলে ধরেছেন ঊর্ধ্ব গগনে, তখনো কিছুই বদলায়নি। ইলেক্ট্রনিক টাইমিং বোর্ড তখনো বিকল। ক্রীড়ামন্ত্রী এলেন সন্ধ্যা পার করে। প্রতিশ্রুতি দিলেন 'আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব, ২০১২ অলিম্পিকে অ্যাথলেটিঙ্ দল যেন থাকে।' এসব অঙ্কে হাফিজুলের এখন মন নেই। একবার হয়তো বলছেন, 'এটা প্রথম আর এটাই আমার শেষ দৌড়।' আবার ভাবছেন, 'বিদেশে যদি ট্রেনিংয়ে পাঠায়, তাহলে তো আমি সুযোগ পাবই।' বাংলাদেশে এসব অঙ্ক মেলানো আসলেই বোধহয় দুরূহ। হাফিজুল তাই সহজ পথটাই বাছেন, 'দ্রুততম মানব হব, এটাই আমার স্বপ্ন ছিল। সামার মিটে দ্রুততম মানব হওয়ার পর এখন মনে হচ্ছে অ্যাথলেটিঙ্ থেকে সর্বোচ্চটাই পেয়ে গেছি। তাই আর কোনো কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই। বিমান বাহিনীতে আমার চাকরিটাও স্থায়ী। খেলা ছেড়ে দেওয়ার পর হয়তো প্রশিক্ষকের কোনো দায়িত্ব পাব।' 'অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝার পর তাহারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল' ধরনেরই হাফিজুলের এই গল্প। বছর দুয়েক হয়েছে বিয়ের পর্বটাও সেরেছেন এই অ্যাথলেট। সংসারে তানহা নামে ছোট্ট একজন অতিথিও চলে এসেছে। অ্যাথলেটিঙ্রে বিবর্ণ অঙ্গনে হাফিজুলের এই গল্প কি কোনো বার্তা পাঠাতে পেরেছে?

No comments

Powered by Blogger.