তত্ত্বাবধায়কেই নির্বাচন আ. লীগও আসবে by মোশাররফ বাবলু

ত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনর্বহালের দাবি আবারও জানিয়েছেন সংসদে বিরোধী দলের নেতা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি বলেছেন, 'দলীয় সরকারের অধীনে দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। নির্বাচন হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই। আওয়ামী লীগকেও সেই নির্বাচনে আসতে হবে।' বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, 'দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছে। সরকারের পক্ষে এ সেতু নির্মাণ করা সম্ভব নয়। ইনশাল্লাহ, বিএনপি ক্ষমতায় এলে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে।' তিনি আরো বলেন, 'বর্তমান সরকার অযোগ্য, ব্যর্থ। এ সরকারকে আর সময় দেওয়া যাবে না।

রোডমার্চের মধ্য দিয়েই সরকারের বিরুদ্ধে এক দফা আন্দোলনের সূচনা হলো। সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।' ঘরে-বাইরে সর্বত্র আন্দোলন গড়ে তুলতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। গতকাল সোমবার ঢাকা থেকে সিলেট অভিমুখে রোডমার্চ কর্মসূচি পালনকালে বিভিন্ন পথসভায় এ আহ্বান জানান খালেদা জিয়া। ছয়টি পথসভায় বক্তব্য দেন তিনি। হাজার হাজার নেতা-কর্মী ও সমর্থক খালেদা জিয়ার বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানিয়ে মুহুর্মুহু স্লোগান দেন। সরকারের বিরুদ্ধে আরো কঠোর কর্মসূচি ঘোষণার দাবি জানান তাঁরা।
বর্তমান সরকার 'একতরফাভাবে' সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করার প্রতিবাদে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট এ রোডমার্চ কর্মসূচি পালন করছে।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় চারদলীয় ঐক্যজোটের মহাসমাবেশ থেকে সিলেট, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম-এ তিন বিভাগ অভিমুখে রোডমার্চের কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপির চেয়ারপারসন। চট্টগ্রামের রোডমার্চ স্থগিত করা হয়েছে। আগামী ১৮ অক্টোবর রাজশাহী বিভাগের রোডমার্চ শুরু হবে। এ দুই বিভাগের রোডমার্চ কর্মসূচির পর সরকারবিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আগামী ২৫ অক্টোবর ময়মনসিংহ জেলা শহরে জনসভার আয়োজন করছে বিএনপি। জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেবেন খালেদা জিয়া।
সিলেট অভিমুখে ২৬৫ কিলোমিটার রোডমার্চে ছয়টি পথসভা নির্ধারিত ছিল। নির্ধারিত স্থানগুলো হলো নারায়ণগঞ্জের তারাবো, নরসিংদীর ইটাখোলা, কিশোরগঞ্জের ভৈরব কোট্টাপাড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিশ্বরোড, হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের শেরপুর। এ ছাড়া কয়েকটি অনির্ধারিত স্থানে (নরসিংদীর পলাশ ও মাধবদীতে) বক্তব্য দেবেন খালেদা জিয়া।
আজ মঙ্গলবার বিকেলে সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে জনসভার মধ্য দিয়ে শেষ হবে সিলেট অভিমুখী রোডমার্চ। আগামী ১৮, ১৯ ও ২০ অক্টোবর রাজশাহী অভিমুখে পরবর্তী রোডমার্চে যাবে চারদলীয় জোট।
সরকারবিরোধী আন্দোলনে সর্বস্তরের জনগণকে সম্পৃক্ত করতে গতকাল থেকে রোডমার্চ শুরু হয়। কর্মসূচিতে জোটের শরিক, সমমনা দল ও নতুন মিত্রসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। কর্মসূচির প্রথম দিন পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রহরায় শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে।
গতকাল সকাল সোয়া ১০টার দিকে গুলশানের বাসভবন থেকে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রোডমার্চ কর্মসূচি শুরু করেন। গুলশান থেকে ঢাকা মহানগরীর ভিআইপি রোড দিয়ে নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দিয়ে সিলেট অভিমুখে রওনা হয় রোডমার্চের গাড়িবহর। নয়াপল্টন থেকে ফকিরেরপুল, মতিঝিল, টিকাটুলি হয়ে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরটি যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদ হয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার তারাবোতে পেঁৗছায়। প্রায় আড়াই হাজার গাড়ির বহর নিয়ে রোডমার্চে চারদলীয় জোটের শরিক দল জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোট, বিজেপি, খেলাফত মজলিস, সমমনা দল জাগপা, এনপিপি, বাংলাদেশ ন্যাপ, লেবার পার্টি, মুসলিম লীগ, ইসলামিক পার্টি, এনডিপি ও ভাসানী ন্যাপ, এলডিপি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির শীর্ষ নেতারা অংশ নেন। বিকল্পধারার শীর্ষ নেতারা গাড়িবহরে অংশ না নিলেও স্থানীয় নেতা-কর্মীরা ঠিকই রোডমার্চ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। এ ছাড়া বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, শ্রমিক দল, মহিলা দল, জাসাস, মুক্তিযোদ্ধা দল, ওলামা দল এবং বিএনপির সমর্থক বিভিন্ন সংগঠন রোডমার্চ কর্মসূচিতে অংশ নেয়। রাস্তার দুই পাশে দলের স্থানীয় নেতা-কর্মী, সমর্থক ছাড়াও সর্বস্তরের মানুষ হাত নেড়ে খালেদা জিয়াকে শুভেচ্ছা জানায়। তিনিও গাড়ির ভেতর থেকে হাত নেড়ে তাদের শুভেচ্ছার জবাব দেন। জাসাসের বিভিন্ন পর্যায়ের শিল্পীরা গণসংগীতসহ দলীয় গান পরিবেশন করেন।
খালেদা জিয়ার গাড়িতে রয়েছেন তাঁর ছোট ভাই শামীম এস্কান্দারের স্ত্রী কানিজ ফাতেমা।
এদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে একটি অগ্রবর্তী দল প্রতিটি পথসভায় আগে গিয়ে সেখানকার প্রস্তুতি দেখভাল করে। এ দলে রয়েছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব বরকত উল্লাহ বুলু, যুবদল সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, যুগ্ম সম্পাদক মীর নেওয়াজ আলী, স্বেচ্ছাসেবক দল সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেল, ছাত্রদল সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু প্রমুখ।
নারায়ণগঞ্জের তারাবো : খালেদা জিয়া দুপুর ১২টায় ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের তারাবো গিয়ে পেঁৗছান। স্থানীয় বাসস্ট্যান্ডে প্রথম পথসভায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনর্বহালের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, 'দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। এ সরকারের পায়ের নিচে মাটি নেই। তাদের ক্ষমতা থেকে হটাতে হবে। এরা ২০০৮ সালের নির্বাচনে জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসেনি। তাদের যে প্রভুরা ক্ষমতায় বসিয়েছে, তারাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।' বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ নয়_এ দাবি করে তিনি বলেন, এই কমিশন আজ্ঞাবহ কমিশন। তাঁরা এ ধরনের কমিশন মানবেন না।
পথসভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা বিএনপি নেতা কাজী মুনীরুজ্জামান। পথসভায় কেন্দ্রীয় নেতা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদপ্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার বক্তব্য দেন।
খালেদা জিয়া বলেন, সরকারের ভুল নীতির কারণে বস্ত্র ও তাঁত শিল্প ধ্বংস হয়ে গেছে। অনেক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। শ্রমিকরা বেকার হয়েছে।
সরকার পতনের আন্দোলনে সবাইকে শরিক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, 'এ সরকার ক্ষমতায় থাকলে দেশের মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে। চুয়াত্তরের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। তাই আন্দোলনের মাধ্যমে এদের হটাতে হবে।'
খালেদা জিয়া বলেন, নির্বাচনের আগে সরকার জনগণকে ধোঁকা দিয়েছিল। তারা বলেছিল, ১০ টাকা সের চাল খাওয়াবে। বিনা মূল্যে সার দেবে। ঘরে ঘরে চাকরি দেবে। তিনি জনতার উদ্দেশে প্রশ্ন রেখে বলেন, সরকার কি কথা রেখেছে? ঘরে ঘরে চাকরি পেয়েছেন? এ সময় হাজার হাজার মানুষ হাত উঁচিয়ে বলেন, না। তিনি বলেন, 'আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। আমি চাই দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে। সেজন্য আপনাদের কাছে আরেকবার এসেছি। আপনারা আমাদের আন্দোলনে যদি শরিক হন সরকার ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হবে। গত নির্বাচনে কারচুপি করে এরা ক্ষমতায় এসেছে। যেই বিদেশি প্রভুরা ক্ষমতায় যাওয়ার সময় তাদের সহায়তা করেছিল তারাও এখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।'
এ সময় খালেদা জিয়াকে রূপগঞ্জ ও কাঞ্চন পৌরসভার পক্ষ থেকে চাবি ও ধানের শিষ উপহার দেওয়া হয়। রূপগঞ্জ পৌরসভার মেয়র সফিকুল ইসলাম চৌধুরী ও কাঞ্চন পৌরসভার মেয়র মজিবুর রহমান ভুঁইয়া খালেদা জিয়ার হাতে উপহার তুলে দেন। এ সময় মঞ্চে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা, সেলিমা রহমান, মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব আবদুস সালাম প্রমুখ।
নরসিংদীর ইটাখোলা : দুপুর পৌনে ৩টায় খালেদা জিয়া নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার ইটাখোলা বাসস্ট্যান্ডে বক্তব্য দেন। এ সময় তিনি 'সরকার সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস তুলে দিয়েছে' বলে স্থানীয় জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি বলেন, 'তারা এখন দেব-দেবীতে বিশ্বাস করে। এরই মধ্যে তারা পূজা-পার্বণও শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু আমরা আল্লাহর ওপর ইমান রেখে দেশের মানুষের মঙ্গল ও কল্যাণে কাজ করতে চাই।'
প্রায় ১০ মিনিটের বক্তব্যে খালেদা জিয়া বলেন, 'দেশটাকে তারা ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে। দেশ বাঁচাতে, আগামী দিনগুলো সুন্দর করার জন্য রাস্তায় নেমেছি। আমার চাওয়ার কিছু নেই। তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছি। আপনারাই আমাকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছেন। এখন নতুন করে চাওয়ার কিছু নেই।'
খালেদা জিয়া বলেন, 'সরকার মূলত অন্যদের মালিক বানিয়ে আপনাদের শ্রমিক বানিয়ে রাখতে চায়। এটা কি আপনারা হতে দেবেন?' দ্রব্যমূল্যের বাড়তি টাকা এমপি-মন্ত্রীদের পকেটে চলে যাচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ যতবার ক্ষমতায় আসে তারা শুধু দুর্নীতি ও লুটপাট করে। তাদের লুটপাটে দেশ দেউলিয়া হতে চলেছে।
এ সময় দল থেকে বহিষ্কৃত প্রয়াত মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন স্থানে মান্নান ভূঁইয়ার বৃহৎ প্রতিকৃতি দেখা গেছে। সেখানে লেখা ছিল_শিবপুরের মাটি, মান্নান ভূঁইয়ার ঘাঁটি।
জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবির খোকনের সভাপতিত্বে পথসভায় আরো বক্তব্য দেন জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান, মহিলা দল সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা প্রমুখ। এ ছাড়া নরসিংদীর মাধবদী ও পলাশ দুটি অনির্ধারিত পথসভায় বক্তব্য দেন তিনি।
বহিষ্কার প্রত্যাহারের দাবিতে কাফনের কাপড় পরে শোডাউন : ভৈরব উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি গিয়াসউদ্দিনের বহিষ্কারাদেশ প্রতাহারের দাবিতে প্রায় পাঁচ হাজার দলীয় নেতা-কর্মী কাফনের কাপড় পরে রাস্তায় শুয়ে পড়েন। এতে খালেদা জিয়ার গাড়িবহর আটকে যায়। পরে পুলিশের সহযোগিতায় খালেদা জিয়ার বহর সিলেটের অভিমুখে রওনা দেয়। এ সময় নেতা-কর্মীরা বলেন, 'খালেদা জিয়ার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম। গিয়াস ভাইয়ের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করো, করতে হবে।' এর আগে বিকেল ৪টায় রোডমার্চ করে খালেদা জিয়া ভৈরবের আবেদিন হাসপাতালের কাছে বালুর মাঠ মঞ্চে আসেন। ভৈরবে শরীফুল আলমের সভাপতিত্বে খালেদা জিয়া বলেছেন, 'দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন এ দেশে হবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগকেও আসতে হবে।'
ভৈরবে পাল্টাপাল্টি শোডাউন : এরপর খালেদা জিয়া কোট্টাপাড়ার পথসভায় বক্তব্য দেন। পরে যাত্রাবিরতি করেন হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার হাইওয়ে ইন রেস্ট হাউসে। খালেদা জিয়া রোডমার্চের কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, সরকার দেশকে চরম সংকটের মধ্যে ফেলেছে। তারা সর্বত্র ব্যর্থ হয়েছে। দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে দেশ। বিশ্বব্যাংক এই দুর্নীতির কারণে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। এখন দুর্নীতি তদন্ত করছে তারা। তিনি দাবি করেন, বর্তমান সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারবে না। ইনশাল্লাহ তারা ক্ষমতায় এলে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে। ভৈরব থানার সভাপতি রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে সভায় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ওসমান ফারুক, জেলা সভাপতি ফজলুর রহমান, সহসভাপতি শরীফুল আলম প্রমুখ বক্তব্য দেন।
কিশোরগঞ্জের ভৈরব : বিকেল ৪টায় রোডমার্চ করে খালেদা জিয়া ভৈরবের আবেদিন হাসপাতালের কাছে বালুর মাঠ মঞ্চে আসেন। এ সময় খালেদা জিয়া দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন এ দেশে হবে না বলে আবারও ঘোষণা দিয়ে বলেন, 'তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগকেও আসতে হবে।'
খালেদা জিয়া বলেন, এ সরকার দেশের কোনো উন্নয়ন করতে পারেনি। এ সরকার অপদার্থ, ব্যর্থ ও নতজানু সরকার। তারা সাধারণ মানুষের কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। লুটপাট করা নিয়েই ব্যস্ত।
খালেদা জিয়া বলেন, এ সরকার ভারতের সঙ্গে গোপন চুক্তি করেছে। দেশের স্বার্থ না দেখে বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থা ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে। অথচ ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সদস্যরা সীমান্তে বাংলাদেশিদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করছে। সরকার এ ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবাদ করছে না। কারণ তাদের প্রতিবাদ করার সাহস নেই।
'আমার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আর শখ নেই' উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, 'আমি এর আগে তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছি। তাই আর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার শখ নেই। আমি দেশকে রক্ষা করতে চাই। দেশের কল্যাণে কাজ করতে চাই। আর নেতৃত্ব তুলে দিতে চাই আপনাদেরর হাতেই।'
জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ঘর থেকে বের হয়েছি উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, 'এর আগে একবার আমি ঘর থেকে বের হয়েছিলাম স্বৈরাচার পতনে। আর এবার বের হলাম দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায়।' তিনি যুব সম্প্রদায়ের উদ্দেশে বলেন, 'আমি তোমাদের সঙ্গে নিয়ে দেশকে রক্ষা করতে চাই। সামনে এগিয়ে যেতে চাই। তোমরা আমার সঙ্গে থেকো। আমরা গণবিরোধী এ সরকারকে পরাজিত করবই।' এ সময় ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে যোগ্য বিবেচনায় শিক্ষিত বেকারদের চাকরির প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।
খালেদা জিয়া বলেন, 'ভারতের জন্য যে রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে, ভারত এ রাস্তার ওপর দিয়ে চলাচল করতে কোনো ট্যাঙ্ দেবে না। আমাদের দেশের মধ্য দিয়ে পণ্য নিয়ে যাবে অথচ বাংলাদেশ কোনো ট্যাঙ্ পাবে না।'
খালেদা জিয়া বলেন, 'সরকার বলছে, ভারতকে ট্রানজিট দেওয়া হচ্ছে অথচ এটি কোনো ট্রানজিট নয়, ট্রানজিটের নামে ভারতকে করিডর দেওয়া হচ্ছে। দেশের জনগণ এ চুক্তি মানে না।'
বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, দেশের মানুষ চার বেলা খেতে পায় না। অথচ সরকার বলছে, জনগণ চার বেলা পেটপুরে খায়। প্রকৃতপক্ষে জনগণ নয়, চার বেলা খায় সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা।
খালেদা জিয়া বলেন, 'পত্রপত্রিকা জনগণের দুর্ভোগের কথা লেখে না। তারা আমাদের বিরুদ্ধে লেখে। টেলিভিশন খুললেই শুধু সরকারের গুণগান শোনা যায়। আমাদের বিরুদ্ধে দুর্নাম ও অপপ্রচার করা হয়।'
খালেদা জিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ আল্লাহকে বিশ্বাস করে না, বিশ্বাস করে মা দুর্গাকে। তারা আল্লাকে বিশ্বাস করে না বলেই সংবিধান থেকে বিসমিল্লাহ তুলে দিয়েছে। তিনি বলেন, কিছুদিন আগে তারা সংবিধান সংশোধন করেছে। সংবিধান থেকে আল্লার ওপর বিশ্বাস ও আস্থা তুলে দিয়েছে। কিন্তু সংবিধান সংশোধন নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি।
খালেদা জিয়া বলেন, 'নির্বাচন কমিশন আগামী নির্বাচনে ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচন করতে চায়। কিন্তু আমরা ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচন মানি না। কারণ, এতে ভোট জালিয়াতির সুযোগ থাকে। আমরা আগামী নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির কোনো সুযোগ দেব না।'
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিশ্বরোড বাঙ্গালপাড়ায় পথসভা : স্বৈরাচারী পরনির্ভরশীল অবৈধ সরকার দেশটাকে করদরাজ্যে পরিণত করতে চায় বলে মন্তব্য করেন খালেদা জিয়া। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিশ্বরোড বাঙ্গালপাড়ায় পূর্বনির্ধারিত পথসভায় তিনি বলেন, কোনো ভালো লোক আওয়ামী লীগ করে না। এরা নারীদের শ্লীলতাহানি করে ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে তা বাজারে ছেড়ে দেয়। এদের হাতে দেশের সম্মান-সম্ভ্রম নিরাপদ নয়।
খালেদা জিয়া বলেন, 'এমনিতেই জিনিসপত্রের দামে মানুষ দিশেহারা। তারপর দফায় দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছে সরকার। আপনারা কি এ সরকার আর চান? যদি না চান আমাদের আন্দোলনে শরিক হয়ে এ সরকারের পতন ত্বরান্বিত করুন।'
খালেদা বলেন, 'আমি আপনাদের কাছে এসেছি আন্দোলন-সংগ্রামে উৎসাহিত করার জন্য। এ সরকারের আমলে পদ্মা সেতু হবে না। দুর্নীতির মাধ্যমে তারা সব খেয়ে ফেলবে। আমরাই পদ্মা সেতু নির্মাণ করব। আমরা যোগ্য ও সৎ নতুন প্রজন্মের কাছে এ দেশের নেতৃত্ব তুলে দেব। এ নেতৃত্ব নেওয়ার জন্য আপনার প্রস্তুত হন।' খলেদা জিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পেঁৗছালে জেলা বিএনপির সভাপতি হারুণ আল রশিদ ও সাধারণ সম্পাদক জহিরুল হক খোকন তাঁকে স্বাগত জানান।
হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে জনসভা : এ সভায় তিনি বলেন, এ সরকার ব্যর্থ। তাদের আর সময় দেওয়া যায় না। খালেদা জিয়া বলেন, 'আমি মা ও বোন হিসেবে বলছি, এ ব্যর্থ সরকারের বিরুদ্ধে আপনারা আন্দোলন গড়ে তুলুন। আমি রাস্তায় নেমেছি, আপনারাও আসুন। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে এ সরকারকে বাধ্য করুন।' মৌলভীবাজার শেরপুরে পথসভা : রোডমার্চের সর্বশেষ পথসভা অনুষ্ঠিত হয় মৌলভীবাজারের শেরপুরে। এ পথসভায় সভাপতিত্ব করেন সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের ছেলে ও জেলা সভাপতি নাসের রহমান। মৌলভীবাজার পথসভা শেষে খালেদা জিয়া সিলেটের উদ্দেশে রওনা দেন। তিনি সিলেট সার্কিট হাউসে ওঠেন। সেখানেই রাতযাপন করবেন।
আজ মঙ্গলবার দুপুর ২টায় খালেদা জিয়া সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা ময়দানে জনসভায় বক্তব্য দেবেন।
নাজেহাল সাংবাদিকরা, অব্যবস্থাপনা রোডমার্চে
'সাংবাদিকরা অবশ্যই পুলিশ প্রটেকশনের বাইরে থাকবেন। তাঁরা কিভাবে সংবাদ সংগ্রহ করবেন, তা তাঁদের নিজস্ব বিষয়।' সাংবাদিক নাজেহাল ও সিলেট অভিমুখে খালেদা জিয়ার রোডমার্চে চরম অব্যবস্থাপনার বিষয়ে প্রশ্ন করলে খালেদা জিয়ার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম চৌধুরী এভাবেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
বিএনপির চেয়ারপারসনের নিরাপত্তা বিঘি্নত হওয়ার অজুহাতে রোডমার্চ কর্মসূচির গাড়িবহরে সংবাদকর্মীদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ফলে পেশাগত দায়িত্ব পালনে চরম ভোগান্তিতে পড়েন রোডমার্চের সঙ্গে থাকা সংবাদকর্মীরা। যদিও চারদল আহূত এই কর্মসূচির সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচারের জন্য বিএনপি চেয়ারপারসনের পক্ষ থেকেই অনুরোধ করা হয়েছিল।
জানা যায়, বিরোধীদলীয় নেতার পাঠানো ওই আমন্ত্রণপত্রে সোমবার সকাল সাড়ে ৯টায় বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে উপস্থিত থাকার জন্য বলা হয়েছিল। সে অনুযায়ী সংবাদকর্মীরা সেখানে অপেক্ষায় থাকলেও সকাল সোয়া ১০টার দিকে অনেকটা সংবাদকর্মীদের ফাঁকি দিয়েই রোডমার্চের যাত্রা শুরু করেন খালেদা জিয়া।
জানা যায়, খালেদা জিয়া যখন মগবাজারে সংবাদকর্মীরা তখনো গুলশানে। আবার সংবাদকর্মীরা যখন মগবাজারে পেঁৗছায়, গাড়িবহর তখন কাঁচপুর, আবার গাড়িবহর যখন কিশোরগঞ্জ, সাংবাদিকরা তখনো নরসিংদী। খালেদা জিয়া যখন সিলেট পেঁৗছান, তখন সাংবাদিকরা হবিগঞ্জে। এর ফলে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয় সংবাদকর্মীদের।
গুলশান অফিস সূত্রে জানা গেছে, কয়েক দিন ধরে পূর্বঘোষিত রোডমার্চ সফল করার জন্য দফায় দফায় বৈঠক করেছেন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। এমনকি এর জন্য কয়েকটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এ আলোচনায় সাংবাদিকদের বিষয়টিও প্রাধান্য পায়। নিরাপত্তাবিষয়ক এক বৈঠকে চেয়াপারসনের প্রেসসচিব মারুফ কামাল খান সোহেল সাংবাদিকদেরকে গাড়িবহরে ম্যাডামের প্রটোকলের আওতাধীন রাখার জন্য বলেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম চৌধুরী তাতে আপত্তি জানান। এর পরও প্রেস উইং থেকে সাংবাদিকদের মূল বহরে নেওয়ার কথা জানানো হয়।
মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম চৌধুরীর বক্তব্যে গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা ক্ষুব্ধ হন। তাঁরা বিষয়টি দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, খালেদা জিয়ার প্রেসসচিব মারুফ কামাল খান ও বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসকে টেলিফোনে জানান। এসব অব্যবস্থাপনার বিষয়ে জানার জন্য খালেদা জিয়ার প্রেসসচিব মারুফ কামাল খান সোহেলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এত বিশাল রোডমার্চে আগে থেকে ভালোভাবে প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। কিন্তু কিছু অযোগ্য-অদক্ষ লোকের কারণে তা সম্ভব হয়নি। তিনি এর জন্য কর্তব্যরত সাংবাদিকদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন।
রোডমার্চের প্রস্তুতিবিষয়ক সমন্বয়ক আ স ম হান্নান শাহ বলেন, 'আসলে এর সার্বিক বিষয় দেখছেন ঢাকা মহানগরের আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা। আমি কিছু জানি না।' সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।
রোডমার্চে অব্যবস্থাপনার কথা জানতে চাইলে প্রস্তুতি কমিটির এক সদস্য বলেন, আশানুরূপভাবে লোকসমাগম এবং সাদেক হোসেন খোকার তিন হাজার গাড়িসহ অন্যান্য প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়ায় তাঁরা এ কৌশল নিয়েছেন।
এদিকে সিলেট অভিমুখে খালেদা জিয়ার রোডমার্চে চরম অব্যবস্থাপনায় সোমবার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। এর কারণে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জের তারাব এলাকায় রোডমার্চ সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে বহনকারী গাড়ি দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জানা গেছে, ছাত্রদলের একটি মাইক্রোবাস খন্দকার মোশাররফের গাড়িটিকে চাপা দেয়। পরে ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকার গাড়িতে করে তিনি রোডমার্চে অংশ নেন।
রোডমার্চে চারদলীয় জোটের নেতারা
রোডমার্চে চারদলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমদ, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি ডা. শফিকুর রহমান, বিজেপির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ এমপি, ইসলামী ঐকজোটের মহাসচিব আবদুল লতিফ নেজামী, খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক, অন্যান্য দলের মধ্যে এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য রেদোয়ান আহমেদ, যুগ্ম মহাসচিব সাহাদাত হোসেন সেলিম, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) ইবরাহিম বীরপ্রতীক, জাগপার সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, এনডিপির চেয়ারম্যান গোলাম মোর্তুজা, সহসভাপতি হাবিবুর রহমান সিদ্দিকী, লেবার পার্টির মহাসচিব হামিদুল্লাহ আল মেহেদী, ন্যাপের চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি, মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া, মুসলিম লীগের নির্বাহী সভাপতি এ এইচ এম কামরুজ্জামান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.