গল্প- শত সহস্র ছুরি by আবু হেনা মোস্তাফা এনাম

নিজের ভেতর এক নিদারুণ অস্থিরতা বেওয়ারিশ কুকুরের মতো হন্যে হয়ে তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। বসলেও অস্থিরতা, না বসলেও তা-ই। বসলে মনের মধ্যে রাজ্যের দুশ্চিন্তা চড়ুই পাখির মতো পথের পাশের বৃষ্টির চুঁয়ানো পানি ডুব দিয়ে ডুব দিয়ে ঘোলা করে তোলে। আর হেঁটে বেড়ালে তার কথা বলা চায়ই চায়। তার মনের অতল অন্ধকার থেকে উঠে আসে কথার নক্ষত্রবীথি। কথা না বলে কি বাঁচা যায়? কথাই যেন পৃথিবীর সব সভ্যতার একেকটা নিস্তব্ধ ও নিরবচ্ছিন্ন রূপ, তার বাইরে আর সব ফানুস, সব শূন্য; সবই সীমাহীন আলস্যে নিষ্কর্মা দিনযাপন। কথা আছে তো তুমি আছ, কথা আছে তো তোমার অস্তিত্ব আছে, তুমি বেঁচে আছ; কথা নেই তো তোমার স্বপ্ন নেই, থাকলেও তার প্রকাশ নেই, উচ্চারণ নেই, অনুরণন নেই; তুমি জড়পিণ্ড। তার চলন নেই, ঠাঁট নেই, রূপ নেই, ঘ্রাণ নেই, কোমলতা নেই—কেবল রুক্ষ, আদিম জন্তুর ভয়ংকর ছায়া। আর সে কথা পেটের মধ্যে পুরে চুপ মেরে বসে থাকা যায়?
সে কথাই বন্ধ হয়ে গেল আশফাকের। কখনো কি সে ভেবেছিল এ রকম নির্বাক, নিস্তব্ধ হয়ে তাকে দিনরাত শূন্য ছাদের সাদা দেয়ালের সঙ্গে যুদ্ধ করে প্রতিনিয়ত পরাজিত হতে হবে? কেবল ডান দিকের জানালাটা ওর জীবনের মতো চৌকোনা একটা সম্ভাবনা, সবুজ আলোর হাতছানি। ছাদের দেয়ালে মাকড়সার জাল মুখস্থ করতে করতে ক্লান্ত হলে জানালাটার দিকেও তাকাবার চেষ্টা করে সে। পাশ ফেরার ক্ষমতা নেই, এমনকি ঘাড়টা অতি সন্তর্পণে ঘোরাতে চায়, কিন্তু প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ওর দুরভিসন্ধি আঁচ করে তীব্র বিদ্রোহে ঝনৎকার দিয়ে ওঠে। ফলে কেবল আঁখিতারা আর চঞ্চল কালো মণি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠা ছাড়া আর সবই ম্রিয়মাণ। ওইটুকুতেই ও বড্ড ক্লান্ত বোধ করে। মনে হয়, তাহলে বেঁচে আছি! বেঁচে থাকাটাই বড় তীব্র অনুভব। ওই যে সবুজ পাতার ভেতর দিয়ে বয়ে আসা আলো, ওর তন্দ্রার ভেতর নিমিলিত আঁখিপল্লবে স্পর্শের অনুরণন তোলে—আশফাক ওঠো, চোখ খোলো! ওঠো, ওঠো, চোখ খোলো!
চোখ খুললেই সামনে দুর্দমনীয় ছাদের সাদা দেয়াল, নয়তো বা কাজলের ঝুঁকে পড়া মুখ। কিন্তু ওই মুখ ভেঙেচুরে অসংখ্য ঢেউয়ের ভেতর দিয়ে বিকৃত পোকা হয়ে উড়ে আসে, চিনতে কষ্ট হয়, মনের মধ্যে দশ গন্ডা হাত-পা গজায়। হাতড়ে হাতড়ে ওই চোখ-মুখের আদল স্পষ্ট হলেও অস্পষ্ট গোঙানি ভেসে আসে—কে? কে? কে? আমি কাজল—ও কাজল! এখন সন্ধে, না রাত? দুপুর! দুপুরে না তোমার কত কাজ, সংসারের খুঁটিনাটি—রান্না ফেলে আবার এলে, চুলোয় কি নিমবেগুন, পুড়ছে বোধ হয়—রাজ্যের কথা ফুসকুড়ি তোলে।
শুয়ে শুয়ে এসব আশফাককে দিশেহারা করে তোলে। ভাবনার একেকটি সূত্র জানালার সামনের বকুলগাছটার রাশি রাশি পাতার আড়ালে ভীরু পাখি হয়ে উড়ে যায়। জানালার ওপারে ডাংগুলি খেলায় মত্ত কিশোরদের হইচই আচমকা ভেসে এলে আশফাকের তন্দ্রা লুপ্ত হয়, বারবার। তখন রৌদ্রের নিষ্করুণ রেখা বেয়নেটের মতো তার দৃষ্টি ধাঁধিয়ে দেয়। এ রকম রৌদ্রের তাতানো এপ্রিলে সে চলে গিয়েছিল আটজনের একটি দলের সঙ্গে। ধরা পড়ার ভয় ছিল, মৃত্যুর আশঙ্কা ছিল, কিন্তু সে মরেনি। আমঝুপিতে শেলের আঘাতে মারা পড়ে ননীগোপাল আর মাদার বক্স। ছিন্নভিন্ন লাশ কাঁধে করে আবার ফিরে আসতে হয়েছিল মেহেরপুরে। তত দিনে যে যার মতো শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে বেরিয়ে পড়েছে। কাঁসারিপাড়া, ফৌজদারিপাড়া, তাঁতিপাড়া—সবই ফাঁকা। যেদিকে চোখ যায়, কেবল শূন্য বাড়িঘর। দিনের বেলায় কাউকে চোখে পড়লেও রাতে কুকুরের টানা আর্তনাদ আর ঝিঁঝির ঝিল্লি রব ছাড়া সীমাহীন নিস্তব্ধতা, সীমাহীন অন্ধকার। ম্রিয়মাণ প্রজাপতির পাখার শব্দেও চাপ চাপ অন্ধকার ভেঙে পড়বে।
কী দুঃসময় গেছে, অবর্ণনীয়। মনের কালিঝুলি মাখা স্মৃতিবিভ্রমের মধ্যে বৈদ্যনাথতলার আমবাগান থেকে ভেসে আসে আমের বোলের ঘ্রাণ। সারি সারি আমগাছের মধ্যে বরফিকাটা রোদ, যেখানেই দাঁড়াও—মোটা মোটা প্রাচীন আমগাছগুলো কুচকাওয়াজে স্থির সৈনিকের মতো সার বেঁধে রয়েছে। আকাশ ছুঁয়ে ডালপালা, তার ফাঁকফোকরে উঁকি দেয় ভবেরপাড়া ক্যাথলিক মিশনবাড়ির সাদা দেয়াল, নাকি নিষ্কলুষ আকাশের অসীম পারাবার!
তন্দ্রার মধ্যে ভেসে ওঠে সিস্টার ক্যাথরিন গনজালভেসের মুখ। কাচের স্বচ্ছ মার্বেল বসানো চোখে সারা রাত জেগে জেগে সিস্টার পতাকা সেলাই করে টাঙিয়ে দেয় মিশনবাড়ির মাথায়। উড়ন্ত পতাকার ছায়া এসে মিশেছিল আমের ডালে। সিস্টার তেরেজিনার তুলা দিয়ে সেলাই করা WELCOME দেখে ক্ষুধার্ত শিশুদের সাদা করোটি রৌদ্রে ভাসে। মাথার মধ্যে কিটকিট করে হেঁটে বেড়ায় লাখ লাখ পোকামাকড়। ঘরের ছাদে বড় একটা মাকড়সা হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে। আশফাকের ভয় হয়, এই বুঝি ঝাঁপিয়ে নেমে আসবে মাকড়সাটা তার মাথার ওপর। মগজের মধ্যে ভেঙে দেবে রাশি রাশি পিঁপড়ের চাক। মগজের কোষে কোষে জমাট রক্তের চাঁই আর বৈদ্যনাথতলার সীমান্তজুড়ে গ্রামকে গ্রাম উজাড় করে ছুটে আসে মানুষ, হূদয়পুর সীমান্ত পেরিয়ে আসে শত শত মানুষ। দারিয়াপুর, মোনাখালী, রতনপুর, নাজিরকোনা, কেদারগঞ্জ, গৌরীনগর, রাধাকান্তপুর, বুড়িপোতা, মেহেরপুর, রুদ্রনগর থেকে আসে মানুষ। মার্কটালি আর পিটার হেসের ক্যামেরার কাচে দৃশ্যময় হয়ে ওঠে দুঃখী মানুষের মুখচ্ছবি। বৈদ্যনাথতলার মণ্ডপে সাদা পাঞ্জাবি পরা উষ্কখুষ্ক চুল এলিয়ে দিবসের নক্ষত্র হয়ে ফুটে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখে বাষ্পের কণা জমে উঠলে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গেয়ে ওঠে আসাদুল হক, শাহাবউদ্দীন, পিন্টু বিশ্বাস, মনসুর আলী। গান শুনে আমের মুকুল থেকে কান্নার ধ্বনি ভেসে আসে। একটা পথকুকুর নির্বাক অশ্রুপাত করে। অন্ধ বৃদ্ধা কাঁদে। আমের পাতায় পাতায় এপ্রিলের মঞ্জুরিত রোদ সাদা পাঞ্জাবি এবং মোটা কালো ফ্রেমের চশমার কাচে ঝিকমিক করে। ‘আমার রাজা গো, বাদশা গো’ বলে পাটের ফেঁসোর মতো ধূসর চুল উড়িয়ে এক বৃদ্ধা কেঁদে বুক ভাসালে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ মণ্ডপ থেকে নেমে আসেন। বাহু ও বুকের মধ্যে বৃদ্ধা অসহায় শিশুর মতো পাঞ্জাবি ভিজিয়ে দেন। ‘শালার বুড়ি কইরল কী, দেক দিনি’, এসব কথার কানাকানি উপেক্ষা করে ভৈরবের ঠান্ডা বাতাসে একজন জেনারেলের মায়াবী কাঁচা-পাকা গোঁফ কেঁপে উঠতে দেখল। বৃদ্ধার কান্না থামে। অবশ্য এই রক্তাক্ত দিবস-গোধূলির দিনেও এমন অজপাড়াগাঁয়ের নতুন নামকরণের আকিকা দেওয়ার জন্য বাসুকুরির সাবিত্রী মিষ্টির লোভ এড়াতে পারে না বলে বৃদ্ধার কান্না থেমেছিল, এমন রগড় করেনি কেউ। জেনারেলরা নাকি মিষ্টি পছন্দ করেন! এমন ভারাক্রান্ত স্মৃতির মধ্যেও চেহারা বিকৃত করে হাসি উদ্ভাসিত হয়—জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা ছাড়ার পর মেহেরপুরে এলে রেস্ট হাউসে কেউ ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর জন্য একদা কলকাতাজুড়ে বিখ্যাত মিষ্টান্ন সাবিত্রী খেতে দিলে সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘রসগোল্লা’ গল্প পড়ার অভিজ্ঞতা এবং ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিলের বৈদ্যনাথতলায় জেনারেল ওসমানীর কম্পিত গোঁফের কথা মনে পড়ে। শহরের ‘মিষ্টিমুখ’ নামের দোকান থেকে ১০ কেজি নকল সাবিত্রী কিনে জেনারেল এরশাদ দ্বিতীয় স্ত্রীর উদ্দেশে রওনা হলে বেশ রগড় হয়। বাসুকুরির মৃত আত্মার জন্য শোক জেগে ওঠে।
এসব স্মৃতির মধ্যে আশফাকের মনে উঁকি দেয় রফিক ভাইয়ের মুখ, মদনাডাঙার নাসিরউদ্দিনের মুখ, শত শত মুখের মিছিল—লাঠি, সড়কি, বল্লম, দা, বটি, লাঙলের ফাল আর গোটা কয়েক সাধারণ বন্দুক হাতে শত শত মানুষের মুখ। রফিক ভাই—ক্ষুধায় পেট ঠেকে যেত পিঠের সঙ্গে, এসে বসত বারান্দায়, দুষ্টুমি করত। কখনো রাগ নেই, অভিযোগ নেই। খেতে দিলে খেল, না দিলে না। মামাশ্বশুরের ছেলের জন্য কাদেরই বা এত হাঁড়ি খোলা থাকে। যেদিন কাজের চাপে কেউ হয়তো লক্ষই করল না, রফিক ভাই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দুষ্টুমি করে ক্লান্ত হয়ে ফিরে গেলেন। যেদিন লক্ষ করল, সেদিন দুই মামির সঙ্গে তার পাত পড়ল। সেই রফিক ভাই—বিদ্যুতের তার বিচ্ছিন্ন করতে গিয়ে ওয়াবদা রোডে, পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। তারই এক বন্ধু পাকিস্তানি বাহিনীকে জানিয়ে দিয়েছিল। মারের চোটে চোখ-মুখ ভাঙা মৌমাছির চাকের মতো ঘেয়ো হয়ে উঠেছিল, হাত-পায়ের প্রত্যেকটা গিঁট পাটকাঠির মতো ভেঙে দিয়েছিল, অণ্ডকোষে দুটো আস্ত থান ইট বেঁধে ঝুলিয়ে রেখেছিল। কদিন বেঁচে ছিলেন রফিক ভাই? লাশ পাওয়া যায়নি তাঁর। বিএ ভর্তি হয়েছিলেন, সেই মেহেরপুর কলেজের পেছনে গণকবরে তাকে পুঁতে রেখেছিল? কে জানে, মনসুর মামা ছেলের শোকে শুকিয়ে চাম দড়ি হয়ে পড়েছিলেন, রোজই প্রায় বসে থাকতেন কলেজের রাস্তায়।
রফিক ভাই বাঁচেননি, আশফাক বেঁচে আছে। নিজের প্রতি তার করুণা হয়, ধিক্কার জমে ওঠে। চারপাশে এত দলাদলি, এত কামড়াকামড়ি, পিঠ-চাপড়াচাপড়ি—এক রাজাকার পৌরসভার মেয়র হলো, মিথ্যা মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে মাসোহারা পাচ্ছে কেউ, চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হাত ছিন্ন করে দিল একদল আরেক দলের, দিনদুপুরে রফিকের ছোট ভাই অভাবের তাড়নায় সরকারি গুদামের চাল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ল, সাংসদের চ্যালা-চামুণ্ডার দল নেশায় মশগুল। সাথি বোসের মাঠের নাম দিয়ে দিল চণ্ডীতলা। চণ্ডীতলায় প্রতি সন্ধ্যায় কী করে এসব উঠতি তরুণেরা? বেঁচে থাকার এসব হীন প্রচেষ্টার জন্য ঘৃণা হয়। বেঁচে থাকা এত করুণ, এত কুশ্রী, এত জঘন্য, এত নির্মম, এত গ্লানিময়, এত দুঃখের, এত কষ্টের, এত আনন্দের—এসব যুগপৎ অনুভূতি তাকে অসহায় করে তোলে। বিজন অন্ধকারে নিরালম্ব করে রাখে।
নিরালম্ব অন্ধকারে ধম্মদার দোকানে চায়ের আড্ডায় অকস্মাৎ খবর শুনে আশফাকের শরীরে কেউ ঠান্ডা ছুরি চালিয়ে দেয়। ঝিনাইদহে মোফাখ্খার হোসেন চৌধুরীকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে। সড়কের ল্যাম্পপোস্টগুলো ঝপাৎ করে অন্ধ হয়ে গেলে চায়ের চুলো জ্বলে ধিকিধিকি। ঘুঘরো পোকা ওড়ে ফরফর। টোস্ট বিস্কিটের মুখ খোলা, ঝিঁঝি ওড়ে। পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে—এসব লাইন মনে উঁকি দেয়। টোস্টের সুঘ্রাণ নিয়ে পিপীলিকা উড়ে যায় অগ্নিকুণ্ডের মোহনীয় বৃত্তের দিকে।
কী করেছিল মোফাখ্খার? বারবার এসব প্রশ্ন মাথার মধ্যে কিলবিল করে উঠলে অন্ধ আক্রোশে ঘূর্ণিবাতাস বয়ে যায়। ধূলিতরঙ্গ আর উড়ন্ত অন্ধকারে কিটকিটিয়ে হাসে। কালো বাতাসে ক্ষিপ্ত অজগর শিস তোলে, গুম গুম বজ্রবিদ্যুতের শেল ফেটে পড়ে। ধম্মদা ঝাঁপ ফেলে দেয়। চুলোর কয়লা তেমনি ধিকিধিকি গনগনে। কেতলির নলে ফুটন্ত পানির বাষ্প। কী করেছিল মোফাখ্খার? সে পড়ছিল! টেবিলে খাতা খোলা ছিল! হারিকেন জ্বলছিল ঘোলা কাচের ভেতর! সে কি পালিয়ে যেতে চেয়েছিল? কেন? কেন? কালো প্রেতের ছায়া পড়েছিল হারিকেনের গুবগুবে শিখায়? কালো প্রেতের ছায়া বইয়ের ওপর? প্রেতের কালো ছায়া খোলা খাতায়? মোফাখ্খার...মোফাখ্খার...মোফাখ্খর...মোফাখ্খর...হারিকেনের লকলকে অগ্নিশিখায় খোলা বই-খাতার স্পর্শ পেয়ে জিব লম্বা করেছিল?
এসব উদ্ভ্রান্ত ভাবনার মধ্যে উষ্কখুষ্ক চুলে পথের সব ধুলো আশফাকের মাথায়-দাঁতে-চোখে-মুখে-নাকে। ঝোড়ো কাক হয়ে ভিজে বাড়ি ফিরলে কাজল অবাক হয়, লোকটা কি পাগল! কোথাও দুই দণ্ড বসলে কী হতো? ধম্মদার চায়ের দোকানও কি বন্ধ আজ? প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে উত্তর মেলে না। কাজলের ধারণা হয়, লোকটা অসুস্থ! গামছা এগিয়ে দেয়, কপালে হাত রাখে। তাপ বটে! তবে তা এমন বেশি কিছু নয়। বাতাসের ঝাপটায় জানালার কপাট খুলে ধাক্কা খায় তীব্র বেগে। জানালা বন্ধ করতে বারণ করে আশফাক। বাতাস আসুক, তুমুল ঝঞ্ঝা বায়ু উঠুক—ঘর-সংসার, পথঘাট, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড উড়িয়ে নিয়ে যাক, ভেসে যাক। শুকনো পাতা, রাশি রাশি বালি উড়ে ঘরদোর ভরে গেলে ভুতুড়ে ছায়া ছায়া অনুভূতি দশ মাথাওয়ালা রাবণের ত্রিশূল নিয়ে ভয় হয়ে তেড়ে আসে।
বজ্রবিদ্যুতে শত সহস্র ছুরি হাতে অন্ধকারে কারা তেড়ে আসে, সে ছুটে পালায়। তার পা চলে না। উদ্যত ছুরি তার চুল স্পর্শ করে। আগুনের ছুরি একটা পাগলা কুকুর হয়ে ছুটে আসে। আশফাকের সামনে হঠাৎ একটা বিরাট কুয়ার মুখ খুলে যায়। তার চারপাশে অসংখ্য কুয়া। কুয়ার মধ্যে ধু ধু বালিয়াড়ি, পালাবার পথ নেই। কুয়ার মধ্যে মাথার খুলি, হাড়হাড্ডি। সে কুয়ার গোলকধাঁধার মধ্যে। কুয়া থেকে উঠে আসে অসংখ্য কঙ্কাল। কঙ্কালগুলো তাকে জাপটে ধরে। আতঙ্কে আশফাকের প্রাণ উড়ে যায় বজ্রবিদ্যুতের সঙ্গে, ছুরির তীক্ষ ধার তাকে ফালা ফালা করে কেটে ফেলে রাখে। চিৎকার করে সে ডাকে কাজলকে। কিন্তু কণ্ঠ চিরে শব্দের লেশমাত্র বের হয় না। কণ্ঠ ও হাত-পায়ের রগ ছিঁড়ে সে পড়ে থাকে নিঃসাড় নিস্তব্ধ। কেবল অন্ধকারে জেগে থাকে আতঙ্কিত বিস্ফোরিত চোখের কালো মণি।
==============================



দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ আবু হেনা মোস্তাফা এনাম


এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.