বিদ্যমান সংবিধান দিয়ে কোনো গণতান্ত্রিক সরকার চলতে পারে না -সিজিএস’র সংলাপ
সংলাপে অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলেন, ১৯৭১ এবং ২০২৪-এর প্রত্যাশা অভিন্ন নয়। একাত্তরের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বিধায় চব্বিশের এই গণঅভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটেছে। অনেক রক্তের বিনিময়ে আমরা যে স্বাধীন দেশ পেয়েছিলাম, তাকে সমুন্নত রাখার জন্যই দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র গঠনের প্রয়োজন। ১৯৭১-এর পর সংবিধান রচনায় যে ধরনের আলোচনা হয়েছিল, তা থেকে আমরা দিকনির্দেশনা পেতে পারি। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংবিধানের পরিবর্তন করা হয়েছে বিভিন্ন দেশে। সংবিধান জীবিত ডকুমেন্ট, তাকে নিয়ে কাজ করা সম্ভব। গোঁজামিল দিয়ে সংবিধানকে সংশোধন করা হয়েছে বার বার, তা নিয়ে পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। সকল ধরনের মতামতকে সঙ্গে নিয়েই গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের দিকে এগিয়ে যাবে দেশ। সরকার সিদ্ধান্ত দিবে না, সিদ্ধান্ত দিবে ছাত্র-জনতা বলে আশা ব্যক্ত করেন তিনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ বলেন, সংবিধানে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এটি পুনর্লিখন ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। যদি কোনো দল নির্বাচনে ৩০০ আসনও পায় তারাও এই সংবিধান পরিবর্তন করতে পারবে না। কারণ সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে ‘এ’ ধারায় এমন কিছু জিনিস আনা হয়েছে যেটি সংশোধন করার কোনো উপায় নেই। তিনি বলেন, সংবিধান এমনভাবে পরিবর্তিত করা হয়েছে তাতে ব্যক্তিস্বার্থ বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর হাতে অবাধ ক্ষমতা থাকায় দলীয়, রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাংবিধানিক পুনর্লিখন ব্যতীত এই ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ বন্ধ করা সম্ভব নয়। সাংবিধানিক পদগুলোতে কেন, কীভাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল? তা আমাদের অজানা নয়। এমনকী রাষ্ট্রপতি নিয়োগের সিদ্ধান্ত একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর ছিল, ক্ষমতার অপব্যবহারে এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে? নির্বাচন কমিশন কারা নিয়ন্ত্রণ করে? রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও এর সমাধান হতে পারে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, সমান প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতকরণ। তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি সংবিধান সংস্কার নয়, পুনর্লিখন প্রয়োজন। যাতে নতুনভাবে কোনো দল ক্ষমতায় এসে সংবিধানে নিজেদের মতো পরিবর্তন করতে না পারে। সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। সাংবিধানিকভাবে সংখ্যাগুরুর অত্যাচার বন্ধের উপায় খুঁজে বের করতে হবে। সংবিধান সংশোধন নাকি নতুন করে পুনর্লিখন প্রয়োজন তা বিতর্কের বিষয়। কে পুনর্লিখন করবে? কে সংশোধন করবে? এই দায়িত্ব কোনো নির্দিষ্ট সরকারের নয়, এই দায়িত্ব জনগণের। সরকারের দায়িত্ব সকল স্তরের জনগণকে পথ তৈরি করে দিতে হবে সংবিধান প্রণয়নে অংশগ্রহণ করবার জন্য।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক কাঠামোতেও পুনর্গঠন প্রয়োজন। সংবিধান পুনর্লিখনের প্রয়োজন বলা হচ্ছে, কিন্তু জনগণের মতের প্রতিফলন আদৌ হচ্ছে কিনা এইটাও দেখার প্রয়োজন। ধারাবাহিক আকারে সংবিধানে সংশোধন করতে হবে। আদর্শিক ও রাজনৈতিক দিকগুলো থেকে জনগণের সদিচ্ছাকে গুরুত্ব দিতে হবে। ১৯৭১-এর প্রেক্ষাপট থেকে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সংবিধানে নতুনত্ব আনতে হবে। সকল প্রতিষ্ঠানকে বিগত সরকার এমনভাবে ধ্বংস করে গেছে যে, ব্যক্তি পর্যায়েও স্বৈরাচারিতা চলে গেছে, এর থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
আইন ও শালিস কেন্দ্রের (আসক) চেয়ারম্যান এডভোকেট জেড আই খান পান্না বলেন, বর্তমান সংবিধান ১৯৭১-এর প্রেক্ষিতে লেখা হয়েছিল। গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংস্কার প্রয়োজন। যে আইন ছিল শাসক শ্রেণির শোষণের জন্য, সেই আইন এখনো কীভাবে বিদ্যমান থাকে?
ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, সংসদের কাজ হলো সংবিধান বাস্তবায়ন করা, একই সংসদ সংবিধান প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে জড়িত থাকলে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। একটা দেশের সংবিধান সেই দেশের রাজনৈতিক জীবনবৃত্তান্ত। সার্বভৌমত্ব জনগণের জন্য হওয়া প্রয়োজন ছিল, যার প্রতিফলন দেখা যায়নি। মৌলিক অধিকার, সমতার কথা আছে, কিন্তু তা বাস্তবায়নের কথা নেই সংবিধানে। প্রত্যক্ষ প্রতিবিম্ব থাকা প্রয়োজন সংসদীয় আলোচনায়। নানা রাজনৈতিক বৈষম্যের কারণে পিছিয়ে পড়া মানুষদের কথা তুলে আনতে হবে। সংবিধানের সংশোধনের নামে দলীয়করণ করেছে প্রতিটি সরকার। সকল ক্ষমতা একজনের হাতে থাকলে স্বৈরাচার তৈরি হবেই।
সুশাসনের জন্য নাগরিক’র (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে সংবিধানের পুনর্লিখন বা সংশোধনের। সংবিধানের যে এক তৃতীয়াংশ সংশোধনযোগ্য নয়, তা কিন্তু সংবিধানের মৌলিক কাঠামো নয়। মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন না করেই সংবিধান সংশোধনযোগ্য করা সম্ভব। পঞ্চদশ সংশোধনী স্থগিত করে সংবিধানকে পুনরায় সংশোধন সম্ভব।
সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি মাহবুব উদ্দিন খোকন সবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে বলেন, সংবিধান পুনর্লিখনের ভিত্তিটা কী? যে আন্দোলন হয়েছে তা ছিল প্রথমত কোটা বিরোধী আন্দোলন, সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন নয়। পরিবর্তন সবাই চায়, পরিবর্তন হওয়া উচিত। দরিদ্রতার জন্য গণতন্ত্রের সুবিধা ভোগ করতে পারছে বিশাল জনগোষ্ঠী। শ্রেণিবৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে হবে, গণতন্ত্রের ফল আস্বাদন করতে হলে। বেআইনি কাজকর্মকে আইনি করা হয়েছে আদালতের মাধ্যমে। আইন প্রণয়ন হয় সচিবালয়ে। তিনি বলেন, মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আদালতকে ব্যবহার করে আর কোনো অবৈধ রায় দেয়া যাবে না।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, বৈষম্য এখনো চলমান। সংবিধান সম্পূর্ণরূপে বাদ দিয়ে নতুন করে লেখা বেশ কঠিন। নতুন বাংলাদেশে নতুন সংবিধানে মৃত্যুদণ্ডকে বাদ দেয়া প্রয়োজন। মত প্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে মৌলিক অধিকারের ওপরও জোর দেয়া প্রয়োজন। সংবিধানের ব্যাখ্যা আসা প্রয়োজন প্রধান বিচারপতির পক্ষ থেকেই। সংবিধানের সংশোধনের জন্য প্রয়োজন ভিন্ন মত ও সকল ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ও সকল জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন। বর্তমান সংবিধান নিয়ে কোনো গণতান্ত্রিক সরকার চলতে পারে না। বাংলাদেশ যে ভয়াবহ সংকটের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে তা উত্তরণের জন্য সংবিধান পুনর্লিখন বা সংশোধন প্রয়োজন বলে মনে করেন এই অধ্যাপক।
ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্স’র (ফেমা) সভাপতি মুনিরা খান বলেন, আমরা গণআন্দোলনের মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতা পেয়েছি। সংবিধান সংশোধনে সদিচ্ছার প্রয়োজন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দেয়া নির্বাচনের মাধ্যমে যে সংসদ আসবে তা যেন জনগণের মতের প্রতিফলন সংবিধানে নিয়ে আসে। সংবিধানের সংশোধন না করে একনায়কত্বকে প্রতিরোধ করা যাবে না। সংবিধান লিখনের দায়িত্ব সবাইকেই নিতে হবে।
চাকমা সার্কেলের প্রধান ও আইনজীবী রাজা দেবাশীষ রায় বলেন, সংবিধানে সংখ্যা যাই হোক, প্রধান বিষয় হোক মৌলিক অধিকারের। ভবিষ্যৎ সংবিধানে কী হবে? তা আমাদেরকেই ঠিক করতে হবে। নতুন সংবিধানে সমতলের আদিবাসী, পাহাড়ি আদিবাসী, ধর্মীয় বিভিন্ন গোত্রের জনগোষ্ঠী সবারই অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন। বিভিন্ন দেশের সংবিধান থেকে শিক্ষা নিয়ে সকল জাতিগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্রের পুনর্গঠন সম্ভব।
সাবেক বিচারক ইকতেদার আহমেদ বলেন, সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। বিচারকদের সীমাবদ্ধতা থাকায়, শপথ দ্বারা বাধিত হওয়ায় সংবিধান প্রণয়নে সুপ্রিম কোর্টের কোনো ভূমিকা থাকে না, ব্যাখ্যা দেয়া ছাড়া। গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করা প্রয়োজন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সর্বদাই প্রশ্নের সম্মুখীন। সারা বিশ্বের বিচার বিভাগ নাগরিকদের অধিকার আদায়ের প্রতিষ্ঠান, আর বাংলাদেশের বিচার বিভাগ অধিকার হরণের প্রতিষ্ঠান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক ছাত্র হাবিবুর রহমান বলেন, সংবিধান অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন দিতে বাধ্য বর্তমান সরকার, নাহলে এই সরকারও ১/১১ এর সরকার হয়ে যাবে। সংবিধান সংশোধনে দুইটি উপায় অবলম্বনের প্রস্তাব করে তিনি বলেন, ১) জাতীয় সংবিধান প্রণেতা কমিটি ২) জাতীয় অধিবেশনের মাধ্যমে সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। মূল সমস্যাকে চিহ্নিত করে আগাতে হবে। স্বৈরাচারী সরকার থেকে বিচারিকতন্ত্রে যেন আমরা না চলে যাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. বোরহান উদ্দিন খান বলেন, ইতিহাস বিকৃত করে সংবিধানকে হাতিয়ার বানানো হয়েছে। সংবিধানের এক তৃতীয়াংশ যেহেতু সংশোধনের কোনো উপায় নেই, তাই সংবিধান পুনর্লিখন প্রশ্নের বিষয়। আদালত সংবিধান সংশোধন করতে পারে না, ব্যাখ্যা দিতে পারে। আইনজীবীরা কেউ চ্যালেঞ্জ না করায় আইন মন্ত্রণালয় থেকে সংবিধান বারংবার সংশোধিত হয়ে এসেছে। সংসদের কাজ হবে সংবিধান সংশোধনের। পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করলে পরবর্তীতে অন্য সংশোধনীগুলোও আদালত বাতিল করে দিবে। আদালতের হাতে সকল ক্ষমতা দেয়া যাবে না।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস’র নির্বাহী পরিচালক মনজুর হাসান বলেন, ১৯৭২-এর সংবিধান অনেক বেশি প্রগতিশীল ছিল। এমনভাবে সংবিধানকে পরিবর্তন করা হয়েছে যে, এখন আর এটি জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন করে না, একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর ইচ্ছার প্রতিফলন দেখতে পাই। সংবিধান পুনর্লিখন করা প্রয়োজন, তবে একদম শূন্য অবস্থান থেকে নয়। রাজনীতি, সুশাসন, আইনের শাসন আনতে হলে ভবিষ্যতে সংবিধান পুনর্লিখন প্রয়োজন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী দিলরুবা শরমিন বলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমতাসীন দলগুলোর কাছে সংবিধান কুক্ষিগত ছিল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ক্ষমতাগুলো পেয়েছেন তা সাংবিধানিকভাবেই প্রতিষ্ঠিত। কোনো কিছু করতে গেলেই সংবিধানবিরোধী, রাষ্ট্রবিরোধী কাজ হিসেবে বলা হয়ে থাকে। সাংবিধানিক জুজুর ভয় নাগরিকদের কাটিয়ে ওঠা প্রয়োজন।
সিজিএস’র নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান বলেন, বিগত ১৫ বছরে আমাদের কোনো বাক-স্বাধীনতা ছিল না, গুম-খুনের শিকার হতে হয়েছে সবসময়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) “গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ” শীর্ষক একটি ধারাবাহিক সংলাপ আয়োজনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ নয়, সমাজের সর্বস্তরের মানুষের বক্তব্য তুলে আনার প্রচেষ্টা থাকবে আমাদের এই সংলাপগুলোর মাধ্যমে। সেইসঙ্গে প্রতিটি সংলাপের সারসংক্ষেপ প্রকাশের মাধ্যমে, আমরা সরকারের কাছে আমাদের দাবি-দাওয়া পেশ করতে পারবো।
No comments