মনিরুলের আনা ২৫ কোটি টাকা গেল কোথায়? by মরিয়ম চম্পা
এসবি’র অতিরিক্ত ডিআইজিকে (প্রশাসন ও অর্থ) তারা বিষয়টি জানালে তিনজন মিলে সব অর্থ আত্মসাৎ করার সিদ্ধান্ত নেন। গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট আছে অজুহাতে এই টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্যে ৫ই আগস্ট সরকার পতনের পর এসবি প্রধানের অফিস কক্ষ, তার বেইলি রোডের বাসা এবং সিটি এসবি’র ডিআইজি অফিসে তারা তিনজন তালা লাগান। ৬ই আগস্ট এসবি কার্যালয়ের সকল সিসিটিভি ও ডিশ লাইন কেটে দেন। ৬ই আগস্ট থেকে ১২ই আগস্ট পর্যন্ত এই সময়ের ভেতর এসবি প্রধান মনিরুলের দপ্তরে রাখা ২৫ কোটি টাকা তিনজন মিলে আত্মসাৎ করেছেন বলে জানিয়েছে সূত্র।
এসবি’র একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে সূত্র জানায়, মনিরের নিজস্ব একটি সিন্ডিকেট ছিল। যেই সিন্ডিকেটে সাবেক মহানগর গোয়েন্দা প্রধান হারুন অর রশীদ, মনির, সারোয়ার নজরুলসহ একাধিক কর্মকর্তা ছিলেন। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পুলিশের পোস্টিং, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি, টেন্ডার বাণিজ্য চালিয়েছেন। জানা গেছে, মনিরুলের কানাডায় নিজস্ব দু’টি বাড়ি এবং সিঙ্গাপুরে রয়েছে নিজস্ব ব্যবসা। ঢাকা, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন বাজারের ব্যাগে করে টাকা আসতো মনিরুলের বাসায়। এসব টাকার ক্যারিয়ার হিসেবে কাজ করতেন এসবি’র বর্তমান এক ডিআইজি, এসএস ফাইন্যান্স এবং আরেক কর্মকর্তা। মনিরুলের ছিল স্থায়ী দুই রক্ষিতা। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় এক চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। সম্প্রতি তিনি এক নির্মাতাকে ঘটা করে বিয়ে করেন। এই অভিনেত্রীকে মনিরুল বেইলি রোডে একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট উপহার দিয়েছেন। যেখানে মনিরুল নিয়মিত অবকাশ যাপন করতেন। আরেকজন বতর্মান সময়ের খ্যাতিমান বিজ্ঞাপন নির্মাতা এবং টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র পরিচালকের সাবেক স্ত্রী এবং অভিনেত্রী। সরজমিনে দেখা গেছে, রাজকীয়ভাবে কয়েক কোটি টাকা খরচ করে এসবি প্রধান মনিরুলের নিজস্ব অফিস ও মিটিংরুম সাজিয়েছেন। মনিরুলের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর থানার বাহাড়া গ্রামে। মনিরুলের বড় ছেলে ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করছেন এবং ছোট মেয়ে কানাডায়। তার স্ত্রী সংশ্লিষ্ট এক মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব পদে কর্মরত।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট গঠনে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন মনিরুল। এ ইউনিটের প্রধান হিসেবে তিনি পরবর্তীতে দায়িত্ব পালন করেন। ডিএমপি ও কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) এর প্রধান থাকা অবস্থায় জঙ্গি অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে একদিকে যেমন সরকারের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে তার কপাল খুলে যায়। এ সময় বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দমন-পীড়নের নামে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মনিরুল। সিটিটিসিতে থাকা অবস্থায় তার সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন পুলিশ সদর দপ্তরের এক ডিআইজি (এডমিন)। মনিরুলের ঘনিষ্ঠ এক এসবি সূত্র জানায়, ৫ই আগস্ট পর্যন্ত মনিরুল, সাবেক পুলিশের মহাপরির্দক, গোয়েন্দা প্রধান হারুন, সিটিটিসি’র ডিআইজি মনির, ডিএমপি কমিশনার, সিআইডি প্রধানসহ একাধিক কর্মকর্তা পুলিশ সদর দপ্তর ও ডিএমপি’র অপারেশন কর্নার এবং কন্ট্রোলরুমে অবস্থান করেন। সরকার পতনের শেষের দিকে তারা এই দুই স্থানে বসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। ফিল্ডে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের বিভিন্ন ধরনের দিক- নির্দেশনা দিতেন। ১লা আগস্ট থেকে অফিসে আসা বন্ধ করে দেন মনিরুল, সারোয়ার এবং নজরুল। মনিরুলের প্রতারণা থেকে বাদ যায়নি একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে একজন ঠিকাদারকে দিয়ে মনিরুল প্রায় ৪১ লাখ টাকার কাজ করালেও পরবর্তীতে তিনি বিল পরিশোধ করেননি। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী ঠিকাদার হতাশায় ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। অভিযোগের বিষয়ে সম্প্রতি মানবজমিন’র সঙ্গে মনিরুলের হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয়। তিনি বলেন, ২৫ কোটি টাকা কোথা থেকে আসবে। ছাত্র আন্দোলনের সময় আমি আমেরিকায় ছিলাম একটি সেমিনারে। ২০শে জুন দেশে ফিরি। গণভবন থেকে টাকা আনার বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা। ভিত্তিহীন। এটার কোনো সুযোগ নেই। কানাডায় ২টি বাড়ি, সিঙ্গাপুরে নিজস্ব ব্যবসা সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি কখনো কানাডা যাইনি সেখানে বাড়ি থাকার প্রশ্নই আসে না। কানাডা কেন দেশেও আমার নিজ নামে কোনো ফ্ল্যাট নেই। নিয়োগ বাণিজ্য, ব্যাগভর্তি টাকা, টেন্ডার বাণিজ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রতিটি অভিযোগ মিথ্যা। বর্তমানে এসবিতে যারা কর্মরত আছেন বিশেষ করে ডিআইজি সারোয়ার তিনি এসব দেখে থাকেন। এগুলো আমার বিষয় না। তিনি বলেন, অভিনেত্রী-মডেলদের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা বলে চরিত্র হননের চেষ্টা করা হচ্ছে। বর্তমানে কোথায় আছেন জানতে চাইলে মনিরুল প্রথমে বলেন, ৫ই আগস্ট সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নেন তিনি। বর্তমানে এক আত্মীয়ের বাসায় আছেন।
No comments