ছোট গল্প: জীবন নামক গহীন জঙ্গলে ডানপিটে মেয়ে আর লাজুক ভাই by সাগুফতা শারমীন তানিয়া
সাগুফতা শারমীন তানিয়া |
চন্দনা আর সঞ্জু যমজ দুই ভাইবোন।
হ্যান্সেল আর গ্রেটেল। হাতে রুটির টুকরো নিয়ে তারা বনে ঢুকেছিল। যেন
হারিয়ে না যায়। যেন ফিরে আসতে পারে সূত্রবদ্ধ পক্ষীর মতো নিজ-পিঞ্জরে।
সেই গহীন বনের নাম জীবন।
শহরের ছেলেমেয়েরা যেভাবে বড় হয় সেভাবেই
বড় হচ্ছিল তারা, সকালের রিকশায় ইশকুলে যাওয়া, দুপুরে ফিরে এসে ভাত (তখন
বাচ্চারা স্কুলফেরতা ভাতই খেত), বিকেল ফুরিয়ে আসছিল শহরের জীবন থেকে কারণ
খেলবার মাঠ ছিল না — 'নোনতা বলো রে' ঝঙ্কার দেবার আঙিনাও কমে আসছিল, ছিল
গাড়িবারান্দার সামনে চিলতে জায়গা, সন্ধ্যায় দ্বিগুণ বেগে বড় হবার জন্য
হরলিক্স।
ভয় পেলে তারা অন্ধকার পেরোতে পেরোতে বলতো— ''ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি, রামলক্ষণ বুকে আছে ভয়টা আমার কী!''
মায়ের
পেটে অ্যামনিয়টিক ফ্লুইডে ভাসমান থাকতে থাকতে তারা কী আদানপ্রদান করেছিল
কে জানে, ওদের মা বিরক্ত হয়ে বলতো, তার মেয়ের ''বুকভরা কইলজ্যা'' আর
ছেলেটা ফ্যাপসার মতো ন্যাতানো।
কখনো ফ্যাপসা, কখনো ত্যানা এইসব ডেকে
ছেলেকে সখেদে পেটাতো ওদের বাপ। মাতৃকায় ভাসতে থাকার সময়ে কী বজ্রগুণন
ঘটেছিল তা কেউ বুঝিয়ে বলতো না বাপমাকে, তারা দেখতো চন্দনা ধেইধেই করে বড়
হচ্ছে আর রিংএ ঝুলিয়ে রেখেও সঞ্জুকে ঠিক তেমন তেমন লম্বা করা যাচ্ছে না।
যতই টানা হোক, ইলাস্টিক জিনিস যেমন তার পুরনো গড়নে ফিরে আসে, তেমন করে
সঞ্জু আকারে ছোট হয়েই রয়েছে, মনে আর শরীরে। হাতে লাল ক্রিকেট বলটা গুঁজে
দিয়ে ওদের বাপ সঞ্জুকে স্পিন করতে শেখাচ্ছে আর বকছে, এদিকে চন্দনা
ডাকাবুকো ফাস্ট বোলারদের মতো দৌড়ে এসে বল ছুঁড়ে পাশের বাসার জানালা ভেঙে
ফেলছে।
রাতে দাদীর দু'পাশে শুয়ে দু'জন লালকমল আর নীলকমলের গল্প
শুনছে, একটা লোহার ঢেলা, আরেকটা সোনার ডেলা, দুটোই গিলে ফেলছে রাক্ষসী।
রাক্ষসীর নাম জীবন।
চন্দনা আর সঞ্জুর চেহারায় খুব মিল। চন্দনার
শরীরে একটা পুরুষালি শোভা আর অনমনীয়তা, সঞ্জু ছিল খানিকটা মেয়েলি গোছের
সুকুমার। আড়ালে মশারির নীচের সখ্যতায় তারা গলাজড়াজড়ি করে বলতো— ''আমরা
দু'টি ভাই, শিবের গাজন গাই।''
ওদের বাপ ছিল ক্রীড়াপাগল, সারাদিন
ক্রিকেট কমেন্ট্রি শুনতো রেডিওতে (এইসব ছাদে উঠে অ্যান্টেনায়
এলুমিনিয়ামের সরা লাগিয়ে দূরদর্শনের 'রামায়ণ' দেখবার ঠিক দু'বছর আগের
কথা, তখনো টেলিভিশনে রিচি বেনোর 'জিলেট ওয়ার্ল্ড স্পোর্ট স্পেশ্যাল' ছাড়া
বাংলাদেশের লোকের গতি নেই।)
বাচ্চাদের প্রাইমারি বৃত্তি পরীক্ষার আগে ওদের মা ঘরগুলোর ঘুলঘুলি (দুই
ঘরের মাঝখানের দেয়ালে তখন ঘুলঘুলি থাকতো তো) আইকা আঠা দিয়ে ক্যালেন্ডারের
কাগজ সেঁটে বন্ধ করে দিয়েছিল যেন রেডিওর শব্দ না যায়।
'দিস
স্পোর্টিং লাইফ'এর নায়কের (বিটিভির 'মুভি অভ দ্য উইক'এ সম্প্রচারিত) মতোই
খেলাধুলার অবশেষ হিসেবে যেটুকু হৃদয়ে রয়ে যেত সেটা ওদের বাপ বের করে দিত
সহিংসতায়, ছেলেমেয়ের প্রতি, স্ত্রীর প্রতি।
এইসব কোলাহলের ভেতর
সঞ্জুকে বাধ্যতামূলকভাবে পড়তে হতো 'আনন্দমেলা'য় ক্রিকেট নিয়ে যা যা লেখা
হতো। সেসব লেখার শিরোনাম 'ঝড়ের নাম চন্দ্রশেখর' পড়েই ভেতরটা নেতিয়ে
আসতো সঞ্জুর।
ঠিক ধরেছেন, চন্দনা বরং শিখে ফেলেছিল কত কত নাম—
মহম্মদ নিসার, লালা অমরনাথ, ফারুখ এঞ্জিনিয়ার, কিরমানি। চন্দনা সঞ্জুকে
শেখাতো— 'ক্যাচেজ উইন ম্যাচেজ'।
আড়ালে সঞ্জু ভালবাসতো জিন কেলি আর
ফ্রেড অ্যাস্টেয়ারের নাচ নকল করতে, একটা ম্যাগাজিন থেকে সে কেটে লুকিয়ে
রেখেছে নুরায়েভের গ্রন্থিল পেশীময় শরীরের সাদাকালো ছবি।
নাচের
ইশকুলে ভর্তি করিয়ে দেবার পরেও 'খাম্বার মতো' হয়ে থাকতো চন্দনা। তাই মা
সেখান থেকে নাম কাটিয়ে এনেছে। চন্দনা সঞ্জুকে তাক লাগিয়ে দেয় পুকুরে ঢিল
ছুঁড়ে ব্যাঙবাজি খেলায়।
বছর দুয়েক পর যখন এলুমিনিয়ামের সরার
কল্যাণে ভারতবর্ষ ওদের ঘরে ঢুকলো পাকাপাকিভাবে, সঞ্জু দেখলো মুনমুন সেন
'নিরমা'য় কাপড় ধোয় আর মীনাক্ষী শেষাদ্রি 'ইমামী' কি 'তুহিনা' মাখে।
চন্দনা দেখলো দীলিপ ভেঙসারকার স্যুটের অ্যাডে কাকে যেন গোলাপ ফুল দেয় আর
গান হয়— ম্যায় তুমহে লাজওয়াব ক্যাহতি হুঁ।
লাজওয়াব হয়ে উঠবার বয়স আসছে ইমামী ট্যাল্কের ঐসব গোলাপি গোলাপি ফুল উড়িয়ে।
বুলিমামা
পড়তে এলো শহরে, উঠলো ওদের বাড়িতে। মামা ট্র্যান্সলেশনে খুব কাঁচা, তাই
নিয়ে হেসে গড়াগড়ি দেয় চন্দনা, মুখ সরু করে বলে - শেফার্ড না মামা, বলো
শেপার্ড।
রাতে ওরা মামার কোল ঘেঁষে বসে দ্যাখে 'হোয়াটজ দ্য নেইম অফ
দ্য গেইম' জিজ্ঞেস করতে করতে অ্যাবার সদস্যরা কেমন করে লুডো খেলছে, চন্দনা
আর সঞ্জু মনশ্চক্ষে দ্যাখে নায়কদের মতো করে বুলিমামাই যেন বাবা জর্দা
খাচ্ছে আর 'রাজদূত' মোটরবাইকে চড়ছে।
মা-বাপের অত্যাচারে অতিষ্ঠ
শৈশবের মরুভূমিতে একটি ঝকঝকে আরল হ্রদ ছিল বুলিমামা। চন্দনাদের জন্য
শীতবিকেলের ভাজা জলখাবার আনতো— আদাছেঁচা ফুলকপির শিঙারা... পেটের অসুখের
ভয়ে তথা পেটখারাপজনিত ইশকুলকামাইয়ের ভয়ে বাইরের খাবার সহজে ঢুকতো না
ওদের বাড়িতে।
বুলিমামা চেনাতো আমঝুপি বেগুন কেমন সাইজের, হাতখরচের
টাকা জমিয়ে একবার সঞ্জুকে কিনে দিল শিয়ালকোটের ব্যাট, শাদা
উইলোকাঠের...আসলে তো খেলবে চন্দনাই, সঞ্জু এইসব স্পিনে দিশেহারা।
সেকালে
মামাদের নাম হতো মিলন, সোহাগ, পরাগ। পরাগায়নের ডিটেইলে আমরা যাব না।
ইংরেজিতে ফেল করে বুলিমামা আবার অখ্যাত গ্রামে ফিরে গেল। স্বভাবলাজুক
সঞ্জুর বুলি ফুটলো এরপর। আর চন্দনা পালিয়ে গেল একদিন।
চন্দনাকে
অনেকেই খুঁজল কিন্তু পাওয়া গেল না বলে সভয়ে এবং সামাজিক লজ্জায় ওদের
বাপমা পাড়া ছেড়ে চলে গেল অন্যত্র। সঞ্জুর ইশকুল বদলালো। অপরের সন্তানকে
কৃপা করলে তার কত বিষম প্রতিদান পাওয়া যায় তা নিয়ে মাঝে মাঝে কেঁদে উঠতো
চন্দনার মা, ওদের বাপ তার মুখ সবলে চেপে ধরতো।
টুনটুন আর ঝুনঝুন
চন্দনা আর সঞ্জু মধ্যবিত্ত পরিবারের দু'টি ছেলেমেয়ে, যারা আড়ালে একজন আরেকজনকে ডাকতো টুনটুন আর ঝুনঝুন।
ঝুনঝুন
চলে যাবার পরে সঞ্জুর আকাশপাতাল জ্বর হলো একদিন। জ্বরের ঘোরে সে টের পেল
সে গর্ভতরলে ভাসছে, অদূরে তার বোনের হাত, আদমের হাতের কাছে আলগোছে রাখা
ঈশ্বরের হাতের মতো, যেন হাত বাড়ালেই মিলবে নাগাল।
সেরে উঠবার পর সে
একেবারে অন্য মানুষ। আড়ালে আর নাচে না ক্লিক-ক্লিক করে জুতো বাজিয়ে।
মৃদু গলায় পাউডারের বিজ্ঞাপনের গান গায় না। তন্ময় হয়ে কখনো ভাবে, তার
বোনটা গেল কোথায়?
বাড়ি থেকে পালিয়ে সুন্দরবন যাবার বা দার্জিলিং
যাবার অবিশ্বাস্য সব রোডম্যাপ বানাতো তারা, সে ভাবতো ক্যানিং গেছে তার
ডাকাতিয়া বোন, হেঁতাল ঝোপের নিভৃতে বাঘের পাশে বসে তাকে মাউথ অর্গ্যান
বাজিয়ে শোনাচ্ছে, পশুর নদীতে ক্যানৌ ভাসিয়ে চলেছে সমুদ্রে আর তার পাশে
পাশে সাঁতরে চলেছে অজস্র ঘড়িয়াল।
চন্দনা সোনারঙ মুখে মেখে দেখছে
কাঞ্চনজঙ্ঘায় আছড়ে পড়া প্রথম সূর্যোদয়, গলায় রাণীর মতো গনগনে
রক্তমানিক্যের গয়না। প্রত্যন্ত কোনো গ্রামে পুকুরের তালপৈঠায় উবু হয়ে
বসে চন্দনা বুলিমামার কাপড় কাচছে এটা সে ভাবতেই পারতো না। বেঁচে আছে তো
তার ঝুনঝুন? পদস্খলন হলে কি আর জীবনের মূল্য থাকে না মেয়েদের? বোনের সাথে
আরেকবার দেখা হবার অপেক্ষায়- যন্ত্রণায় চোখে কনকনে জল এসে যেত সঞ্জুর।
একদিন
সত্যি চন্দনার সাথে দেখা হলো সঞ্জুর। দেখলো বিদ্যুৎহীন অন্ধকার গ্রামে
ফিরে আসবে বলে মেয়ে ক্রিকেটাররা কিংবা ফুটবলাররা এক বাস রাজ্যের হাবিজাবি
লোকের সাথে বসেছে, লোকগুলোর কনুই লাগছে তাদের বুকে আর পিঠে, তাদের কোলের
কাছে জড়ো করা ব্যাগ। শিরোপাজয়ী খেলোয়াড় মেয়েরা।
অভ্যর্থনাহীন।
অভিবাদনহীন। তাদের ভিতর একটি মেয়ের চেহারা হুবহু সঞ্জুর মতো, মানেই তো
চন্দনার মতো। কপাল অবারিত, বলিষ্ঠ হাসি-হাসি মুখ, রোদে পুড়ে মলিন রঙ। কী
আশ্চর্য, এতদিনেও ঝুনঝুনের বয়স বাড়েনি একটুও, অক্লান্ত সাহসী চেহারা
এখনো, অথচ সঞ্জু বুড়িয়ে গেছে, ভারী হয়েছে, পুরু হয়েছে।
ঝুনঝুনের
বয়স এতদিনেও বাড়েনি তাতে এতটুকু খটকা লাগলো না সঞ্জুর, সে ছবির ভিতর
ঢুকে গিয়ে অসহ্য আগ্রহে তাকালো মেয়েটির দিকে। মেয়েটির পাশের মেয়েটিকেও
দেখতে ঝুনঝুনের মতো। তাহলে কি ঝুনঝুনের যমজ মেয়ে হয়েছিল? কিন্তু সামনের
সীটে বসা মেয়েটাও তো ঝুনঝুনের মতো দেখতে।
সারা বাস বোঝাই চন্দনা
ঝুনঝুনিয়ে চলেছে অপ্রসন্ন গন্তব্যের দিকে। মধ্যবয়স্ক সঞ্জু দশবছরের
সঞ্জুর মতো হাত বাড়িয়ে দেয় — কতদিন পর দেখা ঝুনঝুন আর টুনটুনের।
অভ্যর্থনাহীন, অভিবাদনহীন: কালসিন্দুরের মেয়েদের মাঝে চন্দনাকে খুঁজে পায় সঞ্জু। |
No comments