উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির রক্তক্ষরণ

নতুন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ। সব সেক্টরে চলছে সংস্কার। ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে এসেছে এই সংস্কারের অধ্যায়। এই সংস্কারের অন্যতম রূপকার উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রীতিমতো প্রতিযোগিতা করে পদত্যাগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক ভাইস চ্যান্সেলররা। পূর্বে দাপটের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা এসব শিক্ষক নীরবেই সরে দাঁড়িয়েছেন। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে কেন সরে দাঁড়াচ্ছেন তারা? ক্যাম্পাসগুলো হয়ে উঠেছিল একপাক্ষিক রাজনৈতিক মঞ্চ, চলেছে বন্দনা। সপাটে চলেছে বিরোধী মতের দমন, গণরুম, নির্যাতন, দুর্নীতি। নিয়োগগুলো হয়েছিল রাজনৈতিক মত ও চর্চার যোগ্যতায়। আওয়ামী লীগের লিটমাস টেস্ট পার করতে পারলেই পেয়েছেন এসব দায়িত্ব। এসব কারণেই পট পরিবর্তনে নিঃস্ব হয়ে ওঠেন তারা। অধিকাংশ ভিসিই আন্দোলন বা দাবির আগেই সরে দাঁড়িয়েছেন এসব পদ থেকে। ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৮ ভিসির ৩৯ জনই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।

এতটাই দলকানা ভিসিদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল যে প্রায়শই পড়তেন সমালোচনায়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. মীজানুর রহমান ২০১৯ সালে বেসরকারি একটি টেলিভিশনে বলেছিলেন, যুবলীগের দায়িত্ব পেলে তিনি ভিসির পদ ছেড়ে দেবেন। ভিসিরা শিক্ষার্থীদের অভিভাবক। কিন্তু নিজেদের পদ ধরে রাখতে শিক্ষার্থীদের উপর লাঠিচার্জ কিংবা গুলিবর্ষণের ঘটনার পরও মুখে আঙ্গুল দিয়ে, চেয়ার আঁকড়ে বসেছিলেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। ২০২২ সালের এই ঘটনার পরও ছিলেন স্বপদে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া ফরিদ উদ্দিন আহমেদ শিক্ষক হিসেবে কুড়াতে ব্যর্থ হয়েছেন মর্যাদা। তাইতো সরকার পতনের পরই ছাড়তে হয় পদ। চলতি বছরের মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনস্থ বটতলায় মাহে রমজানকে স্বাগত জানিয়ে কোরআন তেলাওয়াত আসরের আয়োজন করে আরবি সাহিত্য পরিষদ নামে একটি সংগঠন। এই অনুষ্ঠানে প্রশাসনিকভাবে বাধা দেয়া হলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে রমজান মাসেই পালিত হয় ‘হোলি উৎসব’। এতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি প্রশাসন। রমজান মাসে কুরআন তিলাওয়াত না হলেও শিক্ষার্থীরা নেচে গেয়ে হোলি উৎসব পালন করায় ব্যাপক সমালোচনা হয়। তবে ওই সময় চলমান বিতর্কের কোনো সুরাহা না করায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন তৎকালীন ভিসি এএস এম মাকসুদ কামাল।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান নিয়মিত অংশ নিতেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। তার বক্তব্যের অধিকাংশই থাকতো রাজনৈতিক বয়ান। তিনি এমনভাবে বক্তব্য দিতেন যেকোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিও উষ্মা প্রকাশ করবেন। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির আস্থাভাজন হওয়ায় নানা দৃষ্টিকটু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)’র নির্দেশনা অমান্য করেই অন ক্যাম্পাস ভর্তি করিয়েছেন। এ ছাড়াও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রো-ভিসি হিসেবে ড. মিজানুর রহমানকে দুপুরে নিয়োগ দিয়ে রাতে সরিয়ে দেয়া হয়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জয়নুল হক জানান, গত ১১ই আগস্ট জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম, রেজিস্ট্রার, প্রভোস্টসহ পুরো প্রক্টরিয়াল বডি পদত্যাগ করায় পরে স্থবির হয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কার্যক্রম। এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কার্যক্রম সচল ও স্বাভাবিক করতে কাজ করছেন ট্রেজারার অধ্যাপক ড. হুমায়ুন কবীর চৌধুরী।  
ভিসি ও প্রক্টরিয়াল বডির পদত্যাগের পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দখলকৃত ১২টি হল উদ্ধার, নতুন ক্যাম্পাসের কার্যক্রম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্য থেকে নতুন ভিসি নিয়োগসহ নানা সংস্কারের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল, লিফলেট বিতরণ, গণস্বাক্ষর কর্মসূচি ও বহিরাগত ভিসি ঠেকাতে গেট লক কর্মসূচি পালন করেছেন।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি নাঈম আহমদ শুভ জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো ক্লাস পরীক্ষা শুরু হয়নি। আওয়ামী লীগের আমলে ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডই ছিল মুখ্য। আওয়ামী মতাদর্শের না হলে মিলতো না পদ। প্রশাসনিক দায়িত্বে ভিসির পছন্দই ছিল শেষ কথা। বিভিন্ন প্রোগ্রামাদিতে ভিসি প্রোভিসি রাজনীতিবিদদের মতো বক্তব্য দিতেন এবং আওয়ামী লীগের পক্ষে জনমত গঠনের নির্দেশ দিতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাটুকারিতা ছিল ব্যাপক। নিজের স্বার্থ আদায় ও টাকা আত্মসাতের বিষয়টি তাদের কাছে ছিল মুখ্য। এই মুহূর্তে যোগ্য ও বিচক্ষণ ব্যক্তিকে প্রশাসনিক বডিতে রাখা, রিসার্চ ডেভেলপমেন্টে কাজ করা, মনিটরিং সেল গঠন, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম উন্নয়ন, একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুসরণ, পরীক্ষার ফলাফল দ্রুত দেয়া ও শিক্ষকদের পাঠদান পদ্ধতির আধুনিকায়ন, সমৃদ্ধ লাইব্রেরি গঠন, বই পড়ার জন্য আলাদা রিডিং রুম স্থাপন, হলের খাবারের মান উন্নয়ন ইত্যাদি সংস্কার করা প্রয়োজন। এ ছাড়া সর্বক্ষেত্রে সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনার দাবি শিক্ষার্থীদের।
শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি সিফাতুল্লাহ আমিন জানান, আওয়ামী সরকারের পতনের পরবর্তীতে রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়টির বিভিন্ন দায়িত্বে থাকা শিক্ষকদের পদত্যাগ করার প্রেক্ষিতে অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। স্থবির হয়ে পড়া সকল একাডেমিক কার্যক্রম দ্রুত চালুর নিমিত্তে শিক্ষার্থীরা মিছিল ও আন্দোলন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের  রেজিস্ট্রারের সিগনেচারকৃত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় আগামী রোববার থেকে ক্লাস শুরু হবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় অভিভাবকশূন্য থাকলেও ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সংস্কারমূলক কাজ এগিয়ে চলেছে শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে। এর ধারাবাহিকতায় ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা বস্তি উচ্ছেদের উদ্যোগ নিয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। যে বস্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ভূমির এক চতুর্থাংশ জুড়ে বিস্তৃত ছিল। ক্যাম্পাসে বিশ একরের বেশি জমি বস্তি হিসেবে থাকলেও সেই জমি উদ্ধারের বিষয়ে আমাদের তখনকার অভিভাবকরা গুরুত্ব না দিয়ে ক্যাম্পাসের বাইরে সাভার অঞ্চলে জমি খুঁজতে গিয়েছিলেন। যা স্পষ্টতই লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মুতাছিম বিল্লাহ রিয়াদ জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একে একে পদত্যাগ করেছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রো-ভিসি ও ট্রেজারার প্রশাসনের শীর্ষ ১২ কর্তাব্যক্তি। ফলে স্থবির হয়ে পড়েছে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম। দুর্বল হয়ে পড়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থাও। শীর্ষ পদগুলো শূন্য থাকায় এখনো ক্লাস-পরীক্ষা শুরুর সিদ্ধান্ত হয়নি। ব্যাহত হচ্ছে প্রশাসনিক কার্যক্রমও। বিভিন্ন দপ্তরে জমা হয়েছে ফাইলের স্তূপ। চলমান অচলাবস্থা কাটাতে ভিসিসহ শীর্ষ পদগুলোতে দ্রুত সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি আরিফ হোসাইন জানান, আন্দোলনের মুখে ২০শে আগস্ট বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও প্রক্টরের পদত্যাগের পর পদত্যাগের হিড়িক লেগে যায়। হলগুলোর প্রভোস্টসহ একে একে পদত্যাগ করেন অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ শিক্ষক-কর্মকর্তা। এতে কিছুটা স্থবির হয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষাসহ প্রশাসনিক কার্যক্রম। তবে সেদিনই বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলাম ববি প্রেস ক্লাবের মাধ্যমে এক ভিডিও বার্তায় জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ হবে না, যথা নিয়মে চলবে। এতে কিছুটা স্বস্তি পায় শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে ২১শে আগস্ট পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করেন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক। তবে বাস্তবচিত্রে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কিছু ডিপার্টমেন্টে ক্লাস-পরীক্ষা একটু মন্থর গতিতেই চলছে। বেশিরভাগ ডিপার্টমেন্টই স্থগিত হওয়া ক্লাস-পরীক্ষা হচ্ছে, নতুন রুটিন প্রকাশিত হয়েছে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরে একটিমাত্র প্রজেক্টের কাজ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রয়েছে পর্যাপ্ত ক্লাসরুম, ল্যাবরুম, পরিবহন ও আবাসিক সংকট। বিশ্ববিদ্যালয় ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী আবাসিক সুবিধা বঞ্চিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই কোনো জিমনেসিয়াম ও অডিটোরিয়াম। দীর্ঘদিন থেকে এসব সমস্যার সম্মুখীন হয়ে আসলেও দলকানা ভিসিরা এসব নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। তারা সবসময় শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী সরকারের তোষামদেই ব্যস্ত থাকতেন, তাদের বক্তব্য শুনলে মনে হতো রাজনৈতিক দলের বক্তব্য। তাই শিক্ষার্থীদের চাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন যোগ্য ভিসি নিয়োগ ও সংকটগুলো নিরসন।
গণবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি আফসানা মিমি জানান, বিভিন্ন আন্দোলনের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। হাসিনা সরকারের আমলে বেশকিছু নিয়ম তৎকালীন রেজিস্ট্রার তৈরি করেছিল যা ছিল নিয়মবহির্ভূত। ইচ্ছেমতো নিয়োগসহ দুর্নীতি, ছিল চাটুকারিতা। রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও মাঝেমধ্যেই রাজনৈতিক নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হতো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। এখন সেইসব অনিয়ম দূর করতে বেশকিছুদিন ধরে ক্লাস বর্জন করে আন্দোলন করে যাচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সাম্প্রতিক কিছু কিছু দাবি প্রশাসন মেনে নিয়েছে, ইতিমধ্যে রেজিস্ট্রার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন এবং সেইসঙ্গে নতুন করে আবারো প্রষ্টরিয়াল বডি তৈরি করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.