ফেনীতে বন্যায় তছনছ বাড়িঘর-সড়ক by নাজমুল হক শামীম

ফেনীতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ৪ উপজেলা থেকে পানি নামলেও ফেনী সদর ও দাগনভূঞা উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন এখনো। এসব গ্রামের মানুষজন এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। যেসব উপজেলায় পানি নেমেছে সেসব উপজেলার শিশু ও বয়োবৃদ্ধ পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন।

এদিকে বানভাসি মানুষেরা ত্রাণের পাশাপাশি বাড়িঘর পুনঃনির্মাণে সহায়তা চেয়েছেন। ফুলগাজী উপজেলার পঞ্চাশোর্ধ্ব হালিমা খাতুন। তার মাটির ঘরটি ভেঙে মাটিতে লেগেছে টিনের চাল। তার সঙ্গে কথা বলার পুরো সময়টাই তিনি কাঁদছিলেন। এ সময় একটি সংগঠনের পক্ষে স্বেচ্ছাসেবকরা তাকে ত্রাণ দিচ্ছিলেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘হাইল্লা তোয়াই হাইয়ের না চাইল দি কিয়া করমু?’ (পাতিল খুঁজে পাচ্ছি না, চাল দিয়ে কি করবো?) সদর উপজেলার শর্শদি ইউনিয়নের আবুপুর গ্রামের বাসিন্দা যতন শীল বলেন, বন্যায় তার বাড়ির টিনশেডের ঘরটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘরের সকল মালামাল নষ্ট হয়েছে। নতুন করে কীভাবে এসব মালামাল যোগাবো সেই চিন্তায় দু’চেখে ঘুম আসছে না।

ফেনী শহরের দক্ষিণ সহদেপুরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মন্দিরা বিশ্বাস বলেন, জীবনের যত অর্জন এক বন্যায় সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। স্কুলের চাকরির কাগজপত্র, শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ, বিগত সময়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অর্জিত সবকিছু নষ্ট হয়েছে পানিতে। কান্না করলেও তো আর এসব ফিরে পাবো না। পরশুরাম উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের কাউতলী গ্রামের বাসিন্দা শরিফা খাতুন বলেন, বন্যায় ঘরভিটার সব মাটি ধসে গেছে। ভেসে গেছে আসবাবপত্র। শুধু ঘরের টিনগুলো রয়েছে। এ ঘর আবার কীভাবে ঠিক করবে জানেন না তিনি। একই অবস্থা পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলার কমবেশি সকল ইউনিয়নের। পানি নামার পর সকল বাসিন্দার চোখে-মুখে ঘুরে দাঁড়ানোর ব্যাকুলতা। সকলেই চেয়েছেন সরকারি-বেসরকারি সহায়তা।

বেড়েছে ডায়রিয়া রোগী
বন্যা পরবর্তী ফেনীর প্রতিটি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও চিকিৎসা সেবাকেন্দ্রে বেড়েছে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা। প্রতিদিন উপচে পড়া রোগী সামলাচ্ছে চিকিৎসক ও সেবিকারা। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বন্যা দুর্গত এলাকায় নিয়মিত চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন সেনাবাহিনীর বিশেষ মেডিকেল টিম ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মেডিকেল টিম। ডায়রিয়াজনিত কারণে ফেনী ডায়াবেটিক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন সত্তরোর্ধ্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের। তিনি বলেন, গত দু’দিন আগে ডায়রিয়া আক্রান্ত হলে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তিনব্যাগ স্যালাইন তার শরীরে দিতে হয়েছে। এখন তিনি কিছুটা সুস্থ বোধ করছেন। ফেনী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে রোগীর চাপ সামলাতে বেগ পেতে হচ্ছে ডাক্তার ও নার্সদের। জেনারেল হাসপাতালে শুধু শিশু ও বৃদ্ধরা নয় সেবা দেয়া নার্সরাও আক্রান্ত হয়েছেন ডায়রিয়ায়। গতকাল হাসপাতালে ডায়রিয়াসহ মোট রোগী ছিল ৪৬৮ জন। জেনারেল হাসপাতালের বাইরে বিভিন্ন উপজেলা হাসপাতালে ডায়রিয়া নিয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় ১২২ জন ভর্তি হয়েছেন। আক্রান্ত রোগীর ৯০ ভাগই শিশু বলে জানান চিকিৎসকেরা।

সেতুর মাটি দেবে সংযোগ সড়কে বিশাল গর্ত, যান চলাচল বন্ধ
ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার ছোট ফেনী নদীর উপর নির্মিত সাহেবের ঘাট সেতুর সংযোগ সড়কে মাটি দেবে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল গর্ত। এতে সড়কটি দিয়ে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় সোনাগাজী উপজেলার সঙ্গে নোয়াখালীর সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ায় দুর্ভোগে পড়েন স্থানীয় বাসিন্দারা। গতকাল দুপুরে সরজমিন ঘুরে দেখা যায়, সাহেবের ঘাট সেতুর পশ্চিম অংশে সংযোগ সড়কের মাঝখানে তৈরি হয়েছে বিশাল গর্তটি। স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল হক বলেন, গত ২১শে আগস্ট ফেনীর সোনাগাজীতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার পানির চাপে সোনাগাজী-নোয়াখালী সড়কের সাহেবের ঘাট সেতুর পশ্চিম অংশে সেতুর নিচ থেকে দুই পাশের গার্ডার ব্লক ও মাটি সরে গেছে। একপর্যায়ে সেতুর সংযোগ সড়কেও ভাঙন দেখা দিলে স্থানীয় লোকজন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বালুভর্তি বস্তা দিয়ে ভাঙন রোধের চেষ্টা করেন। সোনাগাজী উপজেলার চর চান্দিয়া ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান সামছুদ্দিন খোকন বলেন, স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পেয়ে পার্শ্ববর্তী নোয়াখালী সড়ক ও জনপথ বিভাগের কর্মকর্তারাও তাদের সঙ্গে সেতুটি রক্ষায় কাজে যোগ দেন। গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত বালুভর্তি বস্তা ফেলে কিছুটা রক্ষার চেষ্টা করা হয়। তবে রাত থেকে আবারো ভাঙন শুরু হলে শুক্রবার বিকালে সংযোগ সড়কে ভাঙন দেখা দেয়।

সওজ’র নির্বাহী প্রকৌশলী আরও বলেন, বন্যার পানির চাপে সাহেবের ঘাট সেতুর সংযোগ সড়ক ভেঙে পড়ার তথ্য পেয়ে তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ঢাকা থেকে প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পর্যায়ের একটি বিশেষজ্ঞ দল এসে সেতু এলাকা পরিদর্শন করে করণীয় বিষয়ে মতামত দেবেন। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। এর আগে গত ২৬শে আগস্ট সকালে বন্যার প্রবল পানির চাপে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের ২৩ গেট বিশিষ্ট মুছাপুর রেগুলেটর (স্লুইসগেট) নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এটি পুনর্নির্মাণ এবং সাহেবের ঘাট সেতু সংস্কারের দাবিতে গত শুক্রবার বিকালে সোনাগাজী ও কোম্পানীগঞ্জে কয়েকশ’ মানুষ মানববন্ধন করেন।

No comments

Powered by Blogger.