হাসিনাকে ফেরত দিলে বাংলাদেশ ভারত নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে

ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু করা অতি গুরুত্বপূর্ণ। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের কাছে ফেরত পাঠিয়ে এর সূচনা করা উচিত ভারতের। ভারতে তার অবস্থান অব্যাহত রাখার মধ্যদিয়ে ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের আরও ক্ষতি করতে পারে। বার্তা সংস্থা পিটিআই’কে ঢাকার বাসভবন থেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’র সেকেন্ড ইন কমান্ড বর্ষীয়ান এই নেতা ভারতের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে তার দলের আকাঙ্ক্ষাকে জোর দিয়ে প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, তারা অতীতের বিরোধ ভুলতে এবং সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত। তিনি নিশ্চয়তা দেন যে, বাংলাদেশের মাটিতে এমন কোনো কর্মকাণ্ড বিএনপি কখনোই অনুমোদন দেবে না, যা ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হবে।

মির্জা ফখরুল বলেন, বিএনপি যদি ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় যায় তাহলে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে আদানি গ্রুপের সঙ্গে প্রশ্নবিদ্ধ যে বিদ্যুৎ চুক্তি হয়েছিল তা রিভিউ ও পুনর্মূল্যায়ন করবেন তারা। কারণ, ওই চুক্তি বাংলাদেশের জনগণের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের জনগণের মানসিক অবস্থা বুঝতে ব্যর্থতার মধ্যদিয়ে নয়াদিল্লি কূটনৈতিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, এমনকি গণঅভ্যুত্থানের পর হাসিনা সরকারের পতনের পরও বিএনপি’র সঙ্গে যোগাযোগ করেনি ভারতের এস্টাবলিশমেন্ট। যদিও চীন, যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন ও পাকিস্তান সেটা করেছে।

বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনাকে ঠিক নয় দাবি করে তিনি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে দাবি করেন। বেশির ভাগ এমন হামলা সাম্প্রদায়িকতার চেয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল।
মির্জা ফখরুল বলেন, শেখ হাসিনা এবং তার শাসকগোষ্ঠী যেসব অপরাধ ও দুর্নীতি করেছে তার জন্য বাংলাদেশে আইনের মুখোমুখি হতে হবে হাসিনাকে। এটা করতে এবং বাংলাদেশের জনগণের সেন্টিমেন্টকে সম্মান জানাতে ভারতের উচিত তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো নিশ্চিত করা। মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের একটি নতুন অধ্যায় শুরু করতে চাই। শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো নিশ্চিত করার মধ্যদিয়ে নতুন সম্পর্কের নতুন করে বিকাশ ঘটবে। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগ উভয়ই নিন্দিত। তাদের পাশে দাঁড়ানোর মাধ্যমে বাংলাদেশে ভারত সম্পর্কে ধারণা শুধু খারাপই হবে। তিনি আরও বলেন, ভারত যদি হাসিনাকে বাংলাদেশে পাঠানো নিশ্চিত না করে, তাহলে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও খারাপ হবে। কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনা শাসকগোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়েছে ভারত, এটা দেখার পর এরই মধ্যে বাংলাদেশে ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। যদি বাংলাদেশের যেকোনো মানুষকে আপনি প্রশ্ন করেন, দেখবেন তারা বলবেন- শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে ভারত ঠিক কাজ করেনি।
ওদিকে শুক্রবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালকে ব্রিফিংয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল- বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরত দেয়ার কোনো আনুষ্ঠানিক অনুরোধ এসেছে কিনা। কিন্তু এ প্রশ্নের পরিষ্কার জবাব দেননি তিনি। জয়সওয়াল বলেন, খুব অল্প সময়ের নোটিশে নিরাপত্তাজনিত কারণে ভারতে এসেছেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। এ বিষয়ে আমার কাছে বাড়তি কিছু নেই। আপনি যেটা প্রশ্ন করেছেন তা হাইপোথেটিক্যাল ইস্যু।
বাংলাদেশে চলমান ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণা সম্পর্কে জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, ভারতের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য ক্ষোভ রয়েছে। কারণ, তারা কখনো বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের তোয়াক্কা করেনি। তারা শুধু আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কূটনীতি বাস্তবসম্মত ছিল না। তারা বাংলাদেশের জনগণ ও অন্য অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেনি। শুধু তারা সব ডিম এক ঝুড়িতে রেখেছে। বাংলাদেশের জনগণের ‘পালস’ বুঝতে হবে ভারতকে।
মির্জা ফখরুল আরও বলেন, যদি বিএনপি ভোটে ক্ষমতায় যায় তাহলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করার চেষ্টা করবে এবং অতীতের সব বিরোধ ও ভুল বোঝাবুঝির সমাধান করবে। তিনি বলেন, আমরা ক্ষমতায় গেলে ভারতের সঙ্গে অধিক মাত্রায় যুক্ত হবো। তাদের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক চাই। এ জন্য আমাদেরকে আলোচনা করতে হবে। বিভিন্ন ইস্যু সমাধানের জন্য বাস্তবসম্মত কূটনীতির আশ্রয় নেয়া হবে। এমনকি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এত বড় একটি পরিবর্তন হওয়ার পরও ভারত আমাদের সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা করেনি। ৭৬ বছর বয়সী এই নেতা বলেন পাকিস্তান, চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং বৃটিশ হাইকমিশনার ও রাষ্ট্রদূতরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। কথা বলেছেন। কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে কোনো  যোগাযোগ করা হয়নি। তিনি আরও বলেন- প্রয়োজন হলে আওয়ামী লীগ শাসনামলে সম্পাদিত দ্বিপক্ষীয় প্রশ্নবিদ্ধ চুক্তিগুলো, যা বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেছে, তা যাচাই করা হবে, পর্যালোচনা করা হবে। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থে যেসব সম্পাদিত দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বা এগ্রিমেন্ট হয়েছে সে বিষয়ে আমাদের কোনো ইস্যু নেই। কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ বেশ কিছু দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও এগ্রিমেন্ট আছে, যা বাংলাদেশের স্বার্থে করা হয়নি। এসব নতুন করে দেখতে হবে এবং পর্যালোচনা করতে হবে। যেসব চুক্তি এভাবে যাচাই করে দেখতে হবে তার তালিকা দিতে গিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, এই তালিকার শীর্ষে আদানি বিদ্যুৎ চুক্তি। কারণ, এই চুক্তি নিয়ে বিপুল প্রশ্ন আছে। এই চুক্তি বাংলাদেশের মানুষের ওপর ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি করেছে।
আগস্টের শুরুতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার বিষয়েও তিনি কথা বলেছেন। মির্জা ফখরুল বলেন, এ বিষয়ক রিপোর্টকে বাস্তবতার দিক দিয়ে ভুল এবং বিভ্রান্তিকর। তিনি বলেন, হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার রিপোর্ট প্রকৃতপক্ষে ভুল। কিছু কিছু ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। তবে তা সাম্প্রদায়িকতার চেয়ে বেশি মাত্রায় ছিল রাজনৈতিক প্রকৃতির। এসব হামলা রাজনৈতিক কারণে ঘটে থাকতে পারে। কারণ, যারা হামলার শিকার হয়েছেন তারা ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। আমরা আগেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছি। আমাদের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছি হিন্দু পরিবারগুলোকে সুরক্ষা দিতে। তিনি বলেন, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। যখন ভারত এটাকে ইস্যু বানায়, তখন বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক ফোরামে যাওয়া। ভারতে সংখ্যালঘুদের সঙ্গে যা ঘটে আমরা তা নিয়ে কখনো কোনো অভিযোগ করিনি। ফলে এখানে সংখ্যালঘুদের ইস্যুতে কারও মন্তব্য করা উচিত নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের মাটিতে ভারত বিরোধীরা সুযোগ পাবে, এ নিয়ে উদ্বেগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি’র এই নেতা বলেন, ভারত বিরোধী কোনো শক্তিকে বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে কখনোই দেবে না বিএনপি সরকার। সন্ত্রাস বা এমন কর্মকাণ্ড বাংলাদেশে খুবই ন্যূনতম প্রকৃতির। পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে। আমরা ভারতকে নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, ভারতবিরোধী কোনো শক্তিকে বা নিরাপত্তা হুমকিকে কখনোই বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে দেবে না বিএনপি।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আশা প্রকাশ করেন, এক বছরের মধ্যে দেশে নতুন নির্বাচন হবে। তার আশা- আমরা আশা করি নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, ব্যুরোক্রেসি এবং পুলিশে যে সংস্কার হাতে নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার তা এক বছরের মধ্যে শেষ হবে। তারপর নতুন নির্বাচন হবে। ২০০০ সালের শুরুর দিকের মতো বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি যোগ দেবে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, বর্তমানে জামায়াতের সঙ্গে জোটে নেই তার দল। জামায়াতের সঙ্গে আমাদের যে জোট ছিল তা অনেক আগেই ভেঙে গেছে। তবে বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানসহ আওয়ামী লীগের শাসকদের বিরুদ্ধে যৌথ কর্মসূচি পালন করেছি আমরা।

No comments

Powered by Blogger.