আন্দোলনে শহীদ সন্তান: স্মৃতি বুকে জড়িয়ে কেঁদেই যাচ্ছেন বাবা by ফাহিমা আক্তার সুমি

ওরা আমার বুকটা খালি করে দিলো। রাতে ঘুমাতে পারি না। এই মনে হয় আমার সন্তান ফিরে এসে বাবা বলে ডাকবে। সন্তান আমার সম্পদ ছিল। ইচ্ছা ছিল ছেলেকে বুয়েটে পড়াবো। অভাবের কারণে নিজে পড়ালেখা করতে পারিনি সেই কষ্ট সন্তানদের দিয়ে পূরণ করবো। কি করে ভুলে থাকবো আমার সন্তানের রক্তাক্ত নিথর দেহটাকে। এভাবে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বিলাপ করছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে গুলিতে নিহত সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাকিব হাসানের বাবা আবুল খায়ের। তিনি দুই সন্তানকে নিয়ে মোহাম্মদপুরে ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। সেই ঘরজুড়ে এখন রাকিবের স্মৃতি। রাকিবের বাবা আবুল খায়ের মানবজমিনকে বলেন, গত ১৯শে জুলাই বিকালের দিকে আমার সন্তানকে গুলি করে মেরে ফেলে।

ওর মাথায় গুলি লেগে পেছন দিক থেকে বের হয়ে যায়। আমি সেদিন কাজে বাইরে ছিলাম। বাইরে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই এই ঘটনা ঘটে। মোহাম্মদপুর ক্লাবের কাছে গুলিবিদ্ধ হয়। আমার দুই ছেলে এক মেয়ে। দুই ছেলের মধ্যে রাকিব ছিল ছোট। ওর মা গ্রামের বাড়িতে থাকে। কখনো আমার সন্তানদের গায়ে হাত তুলিনি। আমার সেই আদরের মানিকটার মাথা গুলিতে ঝাঁজরা করে দিলো। রাকিব বলতো আব্বু ফুটবল খেলা শিখবো, একদিন বড় খেলোয়াড় হবো। আমার ইচ্ছা ছিল ছেলেকে বুয়েটে পড়াবো সেইভাবে এখন থেকে গাইড দিতাম। এখন আমার বাসায় আসতে মন চায় না, জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে। ৪৩ বছর ধরে ঢাকায় থাকি এমন অমানবিকভাবে মৃত্যু আর কখনো দেখিনি। ৯ বছর বয়সে রাকিবকে ঢাকায় নিয়ে আসি। কতো শত বাবা-মায়ের বুক খালি হয়েছে তার ঠিক নেই। ছেলে তো আর ফিরে আসবে না সারাজীবন বুকে পাথর চেপে থাকতে হবে। আমার সন্তান হারিয়ে ফেলেছি আর এই শহর ভালো লাগে না।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জাকির হোসেন রোডের আবুল খায়েরের ভাড়া বাসায় গিয়ে দেখা যায়, সন্তানদের নিয়ে জীর্ণশীর্ণভাবে এক রুমে ভাড়া থাকেন তিনি। সেখানে থাকা রাকিবের জামা-কাপড়, ছবি-বই, স্কুলের আইডি কার্ড ধরে কেঁদে যাচ্ছেন। দুই সন্তানকে নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াতেন। রাকিব ছোট হওয়ায় তাকে স্কুলে আনা-নেয়া করতেন। মোহাম্মদপুরের আইটিজেড স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী ছিল রাকিব। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বিদ্যুৎ বিভাগের লাইনম্যানের চাকরি করেন রাকিবের বাবা। লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে তাদের বাড়ি। আবুল খায়ের বলেন, আমার সন্তান অনেক মেধাবী ছিল। বুকের মানিকটা এখন আর আমার কোলে ঘুমায় না। সন্তানের সব জামা-কাপড়গুলো যত্ন করে রেখেছি। বড় ছেলে মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজে পড়ে। দুই ভাই একসঙ্গে জড়িয়ে থাকতো। ওদের লেখাপড়া করার জন্য ঢাকায় নিয়ে আসি। রাকিবকে স্কুলে আনা-নেয়া করতাম। আমি এখন কাকে হাত ধরে স্কুলে নিয়ে যাবো। কে আমাকে বাবা বলে ডাকবে। কে আমার কাছে আবদার করবে। সেদিন মাঠে খেলার কথা বলে বাইরে বেরিয়েছিল রাকিব।
তিনি বলেন, ঘটনার দিন দুপুরে খাবারের পর রাকিবকে বলি আব্বু একটু রেস্ট নাও বাইরে ঝামেলা। তখন সে চুপ করে ছিল। আমি বাইরে যাওয়ার পর শুনি রাকিব বাইরে গেছে। তখন আমি বাসায় নিয়ে আসার জন্য খুঁজতে বের হই। কিছুক্ষণ পরে আমার বড় ছেলে ফোন দিয়ে বলে আব্বু রাকিব তো আর নেই মারা গেছে। তখন আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। রাকিবের মাথায় গুলি করে সরাসরি। পরে পথচারীরা কয়েকজন মোবাইলে ভিডিও করে রাখে সেইটা দেখে আমি ছেলেকে চিনতে পারি। তারা জানায় রাকিবকে সিটি হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। সিটি হাসপাতালের দিকে যখন যাওয়ার জন্য রওনা দেই তখন পথে কিছু অপরিচিত লোক আমাদের আটকায়। সিটি হাসপাতালে গিয়ে খুঁজে পাইনি ছেলেকে তখন রাত ১০টা বাজে। বাইরের পরিস্থিতি ছিল অনেক ভয়াবহ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়লাম। রাত ১২টায় নিউরোসাইন্স হাসপাতালে যাই সেখানে গিয়ে দেখি আমার বাবার লাশ মর্গে রাখা। তাদের অনেক রিকুয়েস্ট করি আমার ছেলেটাকে দিয়ে দেন। কিন্তু তারা বার বার থানায় ফোন দিয়ে কোনো সাড়া না পেয়ে আমাদেরও কিছু বলেনি। অনেক চেষ্টা করার পরেও আমার ছেলের মরদেহ ওই রাতে পেলাম না। রাত আড়াইটার সময় হাসপাতাল থেকে আমাকে বলে আজ আর পাবেন না আগামীকাল আসেন।
আবুল খায়ের বলেন, রাত তিনটা-সাড়ে তিনটার দিকে থানায় যাই কোনো কাজ হয়নি। পরের দিন সকালে আবার মোহাম্মদপুর থানায় যাই। সেখান থেকে বলে এটা শেরেবাংলা নগর থানার কেস। এরপরে যাই শেরেবাংলা নগর থানায়। সেখান থেকে তারা আবার বলে এটা মোহাম্মদপুর থানার কেস। এভাবে চার-পাঁচবার এক থানা থেকে আরেক থানায় ঘুরতে থাকি। তখন মনে হয়েছে আমার বুকে পাথর চেপে সন্তানের লাশের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। ওদিকে ওর মায়ের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে।
তিনি বলেন, নিউরোসাইন্স থেকে পাঠায় সোহরাওয়ার্দীতে সেখান থেকে মরদেহ নিতে হবে। সেখানের মর্গে গেলে বলে এখন তো ডাক্তার নেই। এখন লাশ নিতে হলে ডাক্তার আনতে হবে। তখন এমন পরিস্থিতি ছিল কোনো যানবাহন ছিল না বাধ্য হয়ে একটা এম্বুলেন্স ঠিক করি দেড় হাজার টাকা দিয়ে। সেটি নিয়ে ফার্মগেট এসে একজন চিকিৎসককে নিয়ে যাই। নিজের সন্তানের লাশ নিতে এতো যন্ত্রণা পোহাতে হবে বুঝতে পারিনি। মনে হয়েছে আমি ভিন্ন দেশের মানুষ কোনো যুদ্ধের মধ্যে পড়েছি। আমাদের কোনো নিরাপত্তা ছিল না। এম্বুলেন্স দেখতে পেয়েও রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটকায়। ছেলের রিপোর্টগুলো দেখালেও বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। শেষে দেড় ঘণ্টা পর রাস্তায় ঝামেলা শেষ করে ডাক্তার নিয়ে হাসপাতালে ফিরি। সে সময় কোনো এম্বুলেন্সও যেতে রাজি হতো না যদি কেউ রাজি হয় তারা অতিরিক্ত ভাড়া চেয়ে বসে থাকে। পরে ছেলের মরদেহ গ্রামে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিশ হাজার টাকা দিয়ে একটি এম্বুলেন্স ঠিক করি। গত ২০শে জুলাই গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় রাকিবকে।

No comments

Powered by Blogger.