সবার দৃষ্টি আজ ট্রাইব্যুনালে

অবশেষে অপেক্ষার অবসান হচ্ছে। মামলার কার্যক্রম শেষ হওয়ার প্রায় তিন মাস পর আজ সোমবার জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণা করবেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
এটি হবে মুক্তিযুদ্ধকালের মানবতাবিরোধী অপরাধের পঞ্চম মামলার রায়।
ট্রাইব্যুনালের বহুল আলোচিত এ মামলার রায়ের দিকে আজ উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে দেশের মানুষ। তবে পাশাপাশি রয়েছে উৎকণ্ঠাও। প্রায় দেড় বছরের দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের ফলাফল জানতে সবাই যেমন দৃষ্টি রাখবে ট্রাইব্যুনালের দিকে, তেমনি রায়-পরবর্তী সহিংসতা নিয়েও উৎকণ্ঠা রয়েছে সবার মনে। কারণ, অতীতে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া চারটি রায়ের মধ্যে তিনটিতেই কম-বেশি সহিংসতার অভিজ্ঞতা রয়েছে।
বিশেষ করে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে দেশজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সপ্তাহব্যাপী চলা সেই সহিংসতার প্রথম দিনেই নিহত হন ৩৭ জন। ৬ মার্চ পর্যন্ত সাধারণ মানুষ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীসহ নিহত হন ৭৪ জন। ধ্বংস করা হয় সরকারি ও ব্যক্তিগত সম্পদ; আগুন দেওয়া হয় বিদ্যুৎকেন্দ্র, ট্রেন, পুলিশ ফাঁড়িতে। রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়, হামলা চালানো হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর।
এর আগে ঘোষিত চারটি রায়ের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল-১ দিয়েছেন একটি, বাকি তিনটি রায় দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল-২। এর তিনটিই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন।
চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার প্রথম রায় দেন ট্রাইব্যুনাল-২। ওই রায়ে জামায়াতের সাবেক সদস্য (রুকন) পলাতক আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। ৫ ফেব্রুয়ারি একই ট্রাইব্যুনাল জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন। তৃতীয় রায় আসে ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে; ২৮ ফেব্রুয়ারি দেওয়া ওই রায়ে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। ৯ মে চতুর্থ রায়ে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ফাঁসির আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-২।
দুই ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলাগুলোর মধ্যে নানা কারণে গোলাম আযমের মামলাটি অন্যতম আলোচিত। ১৯৯২ সালে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা প্রতীকী গণ-আদালতে গোলাম আযমকে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে গোলাম আযমের বিচারের বিষয়টি আলোচিত হতে থাকে। তদন্ত শেষে প্রায় দুই বছর পর ২০১২ সালে তাঁর বিরুদ্ধে মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়। ওই বছরের ১১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনাল তাঁকে কারাগারে পাঠান। এক বছরের বেশি সময় ধরে এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ ও যুক্তিতর্ক চলে। চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে মামলার রায় অপেক্ষাধীন (সিএভি) রাখেন ট্রাইব্যুনাল।
এর প্রায় তিন মাস পর গতকাল রোববার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ আদেশে বলেন, সোমবার (আজ) গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। এ জন্য তাঁকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
এ আদেশের পর আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক ট্রাইব্যুনালকে বলেন, শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় গোলাম আযমের অনুপস্থিতিতেই তাঁর মামলায় বেশির ভাগ দিনের কার্যক্রম চলেছে। একই বিবেচনায় তাঁকে রায়ের দিন হাজির না করার আরজি জানান তিনি। এ আরজি নাকচ করে ট্রাইব্যুনাল বলেন, রায় শোনা আসামির অধিকার। এ জন্য তাঁকে হাজির করা হবে।
বিচারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, খুব শিগগির হয়তো মানবতাবিরোধী অপরাধের ষষ্ঠ মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। ট্রাইব্যুনাল-২-এ জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে মামলাটি রায়ের অপেক্ষায় আছে। ৫ জুন এ মামলার কার্যক্রম শেষে রায় অপেক্ষাধীন রাখা হয়। একই ট্রাইব্যুনালে বিএনপির নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের বিরুদ্ধে মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ পর্যায়ে।
এ ছাড়া ট্রাইব্যুনাল-১-এ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাংসদ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলায় আসামিপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ এবং জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে।
বিচার হচ্ছে পাঁচ অভিযোগের: একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালের পাঁচটি অভিযোগের বিচার হচ্ছে। অভিযোগগুলো হলো মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উসকানি, সংশ্লিষ্টতা এবং হত্যা ও নির্যাতনের। এসব অভিযোগে মুক্তিযুদ্ধকালীন ৬১টি ঘটনা উল্লেখ করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। অভিযোগের সঙ্গে অপরাধের দায়দায়িত্ব হিসেবে আনা হয়েছে ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়।
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ছয়টি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে একাত্তরের ৪ ও ৬ এপ্রিল অবরুদ্ধ বাংলাদেশের সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠক, ১৯ জুন ও ১ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক। পরিকল্পনার অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে একাত্তরের তিনটি ঘটনা। এগুলো হলো ৪ এপ্রিল টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠক, যার ধারাবাহিকতায় ৯ এপ্রিল ঢাকায় ১৪০ সদস্যের নাগরিক শান্তি কমিটি গঠন এবং ৪ মে শান্তি কমিটির সভা।
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে গঠিত তৃতীয় অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধে উসকানির ২৮টি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। এসব ঘটনার মধ্যে রয়েছে ৭ এপ্রিল স্বাধীনতাকামী মানুষকে ‘ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী’ উল্লেখ করে গোলাম আযমের যুক্ত বিবৃতি; ১৭ মে ঢাকায় এক সভায় স্বাধীনতা আন্দোলনকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ’ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ উল্লেখ করে বক্তব্য; ১৬ জুলাই রাজশাহী, ১৮ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ৪ আগস্ট খুলনা, ৭ আগস্ট কুষ্টিয়াসহ অনেক এলাকায় বিভিন্ন সভায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য প্রভৃতি।
মানবতাবিরোধী অপরাধে সহযোগিতা বা সম্পৃক্ততার ২৩টি ঘটনা দিয়ে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে চতুর্থ অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এসব ঘটনার মধ্যে রয়েছে ১৮ জুন লাহোর বিমানবন্দরে বক্তব্য, ১৯ জুন রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক এবং ২০ জুন লাহোরে সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য।
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ একটি। এ অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২১ নভেম্বর তাঁর লেখা চিঠির নির্দেশ অনুসারে ঢাকার মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সিরু মিয়া, তাঁর ছেলে আনোয়ার কামালসহ ৩৮ জনকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গুলি করে হত্যা করে রাজাকার ও আলবদররা।
রাষ্ট্রপক্ষ গত ১৭ এপ্রিল যুক্তি উপস্থাপনের চূড়ান্ত দিনে এসব অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণের দাবি করে গোলাম আযমের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে। তবে মামলার শুরু থেকেই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। তাঁরা বলেছেন, গোলাম আযম অখণ্ড পাকিস্তান চেয়েছিলেন এটা সত্য, কিন্তু তিনি কোনো ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না।
যেভাবে মামলা ট্রাইব্যুনালে: ২০১১ সালের ১ নভেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত সংস্থা গোলাম আযমের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলির কাছে দাখিল করে। ১২ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল-১-এ প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ, তাঁকে গ্রেপ্তারের আবেদনও জানানো হয়। কিন্তু অভিযোগ ‘অগোছালো ও অবিন্যস্ত’ হওয়ায় ২৬ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল তা রাষ্ট্রপক্ষকে ফেরত দেন। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষ দ্বিতীয় দফায় অভিযোগ দাখিল করলে ৯ জানুয়ারি তা আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। ১১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন করেন গোলাম আযম, ট্রাইব্যুনাল তা খারিজ করে তাঁকে কারাগারে পাঠান। ওই সময় থেকে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের কারাকক্ষে আটক রয়েছেন। ১৩ মে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল।
সাক্ষ্য গ্রহণ: গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন ১৬ জন, আসামিপক্ষে দিয়েছেন একজন। ২০১২ সালের ১ জুলাই ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের জবানবন্দির মধ্য দিয়ে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষের অপর উল্লেখযোগ্য সাক্ষীরা হলেন মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবউদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম (এসপি মাহবুব); আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল; সুরকার, গীতিকার ও সংগীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। পক্ষান্তরে গোলাম আযমের পক্ষে একমাত্র সাক্ষী ছিলেন তাঁর ছেলে সাবেক সেনা কর্মকর্তা আবদুল্লাহহিল আমান আযমী।
একাত্তরের নভেম্বর মাসের শেষ দিকে গোলাম আযম পাকিস্তানে চলে যান। স্বাধীনতার পর তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। ১৯৭৮ সালের ১১ জুলাই প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে তিনি পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। ১৯৯৪ সালের জুনে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তাঁর নাগরিকত্বও পুনর্বহাল হয়। ১৯৯১-২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমির ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.