ভিন্নমত-চাকরির কোটা বনাম মেধা by আবু আহমেদ

বাংলাদেশ আশায় ভাসে, আবার পরক্ষণে যেন নিরাশায় ডোবে। নিরাশার বিষয়গুলোর উৎস হলো বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের রাজনীতি, সর্বত্র সীমাহীন এবং গা-সওয়া দুর্নীতি, বিচার বিভাগের ওপর আস্থার স্খলন, মেধার মূল্যহীনতা, পরিশ্রমের অস্বীকৃতি, সহজ-সরলতাকে বোকামি ভাবা।
ফলে একেক সময়ে মনে হয় বাংলাদেশে সৎ, মেধাবী লোকদের জন্য সমূহ দুর্দিন। তারা বেঁচে থাকবে অত্যন্ত নিরীহ মানুষের মতো। আর যারা গলাবাজিতে পারঙ্গম, দেওয়া-নেওয়ায় বিশ্বাসী, ধুরন্ধর প্রকৃতির, আদর্শ-মূল্যবোধ যাদের কাছে অপরিচিত, তাদের জন্যই বোধ হয় এই দেশ স্বর্ণভূমি! একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা সরকারি চাকরির জন্য অনেক উৎসাহ দেখাতেন। সেকালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের সদস্য হওয়া একটা ভাগ্যের এবং সম্মানের বিষয় ছিল। প্রায় সব মেধাবী ছাত্রই তখনকার সিএসএস বা সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিসের পরীক্ষা দিতেন। প্রশাসনিক বা ফরেন সার্ভিস পেলে তো নিজেকে অনেক ধন্য মনে করতেন। সেই পাকিস্তান সময়ের সিএসপি এবং ফরেন সার্ভিসের সদস্যরা বাংলাদেশ সময়েও অনেকে দীর্ঘদিন যাঁরা বাংলাদেশের প্রশাসনিক এবং বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ে চাকরি করেছেন, লোকজন তাঁদের মেধাকে সম্মান করত। ভাবত এঁরাই হলেন ওই সব অফিসার যাঁরা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে প্রকৃত অর্থেই মেধার ভিত্তিতে পাস করেছেন। বাংলাদেশ আমলে তাঁদের প্রায় সবাই সচিব বা সমপর্যায়ের অবস্থানে পৌঁছে চাকরি থেকে অবসর নেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই আবার বিভিন্ন বৃত্তি নিয়ে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে পিএইচডিসহ উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ সময়ে পরীক্ষার সঙ্গে আপস করা হয়। পাবলিক সার্ভিস কমিশন বাংলাদেশ সময়েরও অধিকাংশ সময় শক্ত হাতেই ছিল। কিন্তু এই সংস্থার মানে-নৈতিকতায়ও ধস নামা শুরু করল। সেইসঙ্গে যোগ হলো চাকরির ক্ষেত্রে বর্ধিত হারে কোটার আরোপ। ছোট্ট একটি দেশে এত কোটার আরোপ দেখে অনেককেই আফসোস করতে শুনি- এই হলো প্রশাসনকে মেধাশূন্য করার আরেক প্রক্রিয়া। সরকারি চাকরিতে কোটা অনেক দেশেই আছে, তবে বাংলাদেশের মতো মোট চাকরির ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত ভাগাভাগির মাধ্যমে শেষ হয়ে যাবে এমন পদ্ধতির কথা আমাদের জানা নেই। বিশ্বের অন্য কোনো দেশে মোট চাকরির ৫৫ শতাংশ কোটায় খেয়ে ফেলে- এমন উদাহরণ কেউ দিতে পারলে আমরাও সেটি তুলে দেখতাম সে দেশটিও প্রশাসনের মানের দিক দিয়ে আমাদের মতো কি না! কোটার নির্যাতনের বিরুদ্ধে মেধাবীরা কথা বললে যে দেশে সেটির অপব্যাখ্যা করা হয়, সে দেশ যে আরো মূর্খতার দিকে ধাবিত হবে এটিই তো সাধারণ চিন্তা হিসেবে মাথায় আসে। তাহলে আমরা কি ফেলকে পাস আর পাসকে ফেল, এই পদ্ধতিতে আরো অনেক দিন শাণ দিতে থাকব! সমাজে পাসের প্রতিযোগিতার বদলে ফেলের প্রতিযোগিতা চালু করে ১০০ শতাংশ চাকরিকে অকশনে তুললে কেমন হয়! সমাজে পিছিয়ে পড়া কাউকে সুবিধা দেওয়ার জন্যই তো কোটা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেই সুবিধা আর কত দিন? আপনি একটি মেধাবী ছাত্রকে চাকরি না দিয়ে একজন ফেল করা প্রার্থীকে কোটার বরাদ্দ দিয়ে প্রশাসনে আসতে সুযোগ করে দিলেন, সেটির থেকে আর বড় অধিকার কোনটি হতে পারে? যাদের পিছিয়ে পড়া অবস্থা থেকে কোটার মাধ্যমে সামনে আনার প্রস্তুতি চালু করা হলো, তাদের কি সমাজ-সরকার অন্যভাবে সাহায্য করে পুষিয়ে দিতে পারে না? মেধার ক্ষেত্রে কেন বারবার আপদ। কোটার শ্রেণীগুলোকে শিক্ষার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ফ্রি করে দিন, তাদের নগদ অর্থ প্রদান করুন, তাদের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে দিন- তবু পরীক্ষায় ও পাসের ক্ষেত্রে এবং চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে সমতা আনুন। তাতে মেধাবীরাও বাঁচল আর কথিত কোটার প্রার্থীরা অন্যভাবে উপকৃত হলো। কোটার শ্রেণীরা যদি সরকার কর্তৃক প্রদেয় সুযোগগুলো নিয়ে পরীক্ষায় পাস করে সরকারি চাকরি পায়, সে ক্ষেত্রে কারো কিছু বলার থাকবে না। অন্য কথা হলো, যাঁরা ৫৫ শতাংশ কোটা আরোপ করেছেন, তাঁদের কাছে মেধার প্রয়োজনীয়তাটা কি একবারও সামনে এলো না? কোটা যদি রাখতেই হয় তাহলে এই বিশেষ সুযোগটাকে ২০-২৫ শতাংশে নামিয়ে আনুন। একপর্যায়ে এটিকে আরো গ্রহণযোগ্য ও যৌক্তিক করুন। আজকে যে ৫৫ শতাংশ মেধা তালিকার অনেক নিচে থেকেও কোটার কারণে চাকরি পাচ্ছে, তাদের তো প্রজাতন্ত্র সমান স্তরের মেধাবী হিসেবেই পরবর্তী দিনগুলোতে গণ্য করছে! কে জানে কোনো একদিন এমনও হতে পারে যে চাকরিতে প্রমোশনের ক্ষেত্রেও তাদের কমপক্ষে ৫৫ শতাংশ দিতে হবে! শুনেছি এবার প্রিলিমিনারি বিসিএস পরীক্ষার ক্ষেত্রে একেবারেই পরীক্ষা পাস করানোর ব্যাপারে কোটার খৰকে প্রয়োগ করা হয়েছে। এর অর্থ নাকি এই, যে সাধারণ পাসই করত না, তাকে আগে ওই রক্ষাকবচ প্রয়োগ করে পাস করানো হয়েছে, যাতে নির্ধারিত ৫৫ শতাংশ সহজেই পূরণ করা যায়। জানি না ফেলকে পাস করিয়ে সরকারি চাকরি দেওয়ার এই পদ্ধতি বিশ্বের অন্য একটি দেশেও আছে কি না। আমাদের এ দেশে মেধাবীরা তাদের মূল্য পাওয়ার জন্য রাস্তায় নামে, আবার পুলিশও তাদের পেটায়!

লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.