বঙ্গবন্ধুর নাতনির বিয়ে এবং রাজনীতি by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

মানুষ যা চায় তা সব সময় পায় না। পেলে কী হতো তাও জানি না। এটা ভাগ্য না ভগবানের বিধান তাও বলতে পারব না। কৈশোরকাল থেকে আমি বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। যৌবনে তাই, সেই পাকিস্তান আমলেই আমার সব ছেলেমেয়ের নাম বাংলায় রেখেছি। ছেলেকে ঢাকার গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলে ভর্তি করেছিলাম। কারণ স্কুলটিতে বাংলার মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হতো। তখন কী আর জানতাম, ভাগ্যের ফেরে পড়ে আমার অতিক্রান্ত যৌবন এবং শেষ জীবনটা বিদেশেই কাটাতে হবে? ছেলেমেয়েরা সম্পূর্ণ ভিন্ন কৃষ্টিতে মানুষ হবে। তারা বাঙালি হবে না, ইংরেজও হবে না, হবে বাংরেজ। বিশ্বায়নের মহা ঘূর্ণাবর্তে আমার জাতীয়তাবাদ খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে? সত্যি কথা বলতে কী, এ নিয়ে আমার দুঃখ নেই। এ মাসের গোড়ায় লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর নাতনি (শেখ রেহানার বড় মেয়ে) টিউলিপ সিদ্দিকের বিবাহোত্তর সংবর্ধনায় যোগ দিতে গিয়ে মনে মনে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করেছি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বলিষ্ঠ উদগাতা। তিনি কি জানতেন, তার বংশধর একদিন এই জাতীয়তাবাদের সীমারেখা ভেঙে বিশ্ব জাতীয়তার ঘূর্ণাবর্তে মিশে যাবে? শেখ হাসিনার বড় মেয়ে পুতুল ছাড়া দু’বোন হাসিনা ও রেহানার আর কোনো ছেলেমেয়ে (রেহানার ছোট মেয়ে রূপন্তি এখনও অবিবাহিত) বাঙালি বিয়ে করেনি। সজীব ওয়াজেদ জয়ের স্ত্রী আমেরিকান, টিউলিপের স্বামী ব্রিটিশ, ববির স্ত্রী ইউরোপিয়ান। গোপালগঞ্জের কট্টর জাতীয়তাবাদী শেখ পরিবারের এখন বিশ্বজনীন পরিচয়।
আমার বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু এখন বেঁচে থাকলে তার বংশধারার এই বিবর্তনে খুশি হতেন। তিনি বাঙালির হাজার বছরের মিশ্র সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্যময় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না। মাঝে মাঝে দেখতাম, তিনি অবসর সময়ে রবীন্দ্রনাথের ‘ভারত-তীর্থ’ কবিতাটি আবৃত্তি করতেন, বিশেষ করে এই কটি লাইন :
‘রণধারা বাহি জয়গান গাহি উন্মাদ কলরবে
ভেদি মরুপথ গিরি পর্বত যারা এসেছিলো সবে
তারা মোর মাঝে সবাই বিরাজে কেহ নহে নহে দূর
আমার শোনিতে রয়েছে ধ্বনিতে তার বিচিত্র সুর।’
সন্দেহ নেই, বঙ্গবন্ধুও চাইতেন, বাঙালি তার জাতীয় স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা নিয়ে জেগে উঠুক এবং বিশ্ব জাতীয়তার মোহনায় আপন বৈশিষ্ট্য নিয়ে মিলিত হোক। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার ছেলেমেয়েরা তার সেই সাধই পূর্ণ করেছে বলে মনে হয়। যদি তা না হতো তাহলে বিলাতে বাস করে, উচ্চশিক্ষা লাভ করে, চারদিকে এত অর্থবিত্তের পেশা থাকতে টিউলিপ রাজনীতিকে তার পেশা হিসেবে গ্রহণ করত না। বর্তমানে সে লন্ডনের ক্যামডেন কাউন্সিলের নির্বাচিত কেবিনেট মেম্বার ফর কমিউনিটিজ অ্যান্ড কালচার। একই সঙ্গে সে এখন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হ্যামস্টেড কিলবার্ন নির্বাচন কেন্দ্র থেকে লেবার পার্টির এমপি পদে মনোনয়ন প্রার্থী। এই আসনে এতদিন লেবার দলীয় এমপি ছিলেন বিখ্যাত অভিনেত্রী গ্লেন্ডা জ্যাকসন। বঙ্গবন্ধুর জীবন এবং আদর্শই যে তার চরিত্র গঠন করেছে, টিউলিপ সে কথা অকপটে বলেছেন, লন্ডনের সান্ধ্য দৈনিক ইভনিং স্টান্ডার্ডের (১১ জুলাই বৃহস্পতিবার) সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে। তার বক্তব্য, গ্রান্ডফাদারের আদর্শই তার চরিত্র গঠন করেছে। পারিবারিক ঐতিহ্যই তাকে একজন স্ট্রং সোস্যালিস্টে পরিণত করেছে। তবে বর্তমানে সে একজন লোকাল কাউন্সিলর এবং ব্রিটিশ।
সম্ভবত এই উপলব্ধি থেকেই টিউলিপ বাংলাদেশের রাজনীতির বদলে ব্রিটিশ রাজনীতিতে যোগ দিয়েছে। আমি খুশি হতাম টিউলিপ বাংলাদেশের রাজনীতিতে যোগ দিলে। বাংলাদেশের রাজনীতির এখন যা অবস্থা, তাতে তার মতো উচ্চশিক্ষিত, আর্টিকুলেট, সমাজতন্ত্র ও সেকুলারিজমে বিশ্বাসী নেতাকর্মীর দরকার। বিশেষ দরকার। তবে ব্রিটিশ রাজনীতিতেও বাঙালির উপস্থিতি এখন বাড়ছে। প্রভাবও বাড়ছে এবং তা দরকার। ব্রিটিশ হাউস অব লর্ডস এবং হাউস অব কমন্স-এ এখন দু’জন বাঙালি সদস্য আছেন। দু’জনই মহিলা এবং লেবার দলের। এরা হলেন ব্যারোনেস পলাউদ্দীন এবং রোশনা আলী। রোশনা এরই মধ্যে লেবার দলের পার্লামেন্টারি পার্টিতে ছায়া মন্ত্রিসভার অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন এবং আগামী নির্বাচনে লেবার দল জয়ী হয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করলে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবেন। তিনিই হবেন ব্রিটিশ মন্ত্রিসভায় প্রথম বাঙালি মন্ত্রী। কোনো সন্দেহ নেই, রেহানা-কন্যা টিউলিপ এবার ব্রিটিশ এমপি হওয়ার জন্য লেবার পার্টির মনোনয়ন পেলে এবং লেবার পার্টি আগামী সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হলে এড মিলিব্যান্ডের নতুন মন্ত্রিসভায় টিউলিপ সিদ্দিকও হবে একজন মন্ত্রী। এটা বাংলাদেশ ও বাঙালির জন্য কম অর্জন নয়। বঙ্গবন্ধু আজ বেঁচে থাকলে খুবই খুশি হতেন। গত ৭ জুলাই রোববার টিউলিপ ও ক্রিসের বিবাহোত্তর সংবর্ধনায় উপস্থিত ছিলাম। ক্রিস উচ্চশিক্ষিত সুদর্শন ইংরেজ যুবক। টিউলিপের জন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যরাও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। টিউলিপের পাশে দাঁড়িয়ে তার স্বামী ক্রিস যখন জয়বাংলা স্লোগান দিয়েছে, তখন আমার বুড়ো হাড়েও ভেলকি লেগেছে। আমি অনেকের মতো রোমাঞ্চিত হয়েছি।
টিউলিপের বক্তৃতা আমি প্রথম শুনি কয়েক বছর আগে ব্রাসেলসে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে এক সেমিনারে। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং আরও কয়েকটি ব্যাপারে অত্যন্ত যুক্তিতর্কসহ সে তার বক্তব্য তুলে ধরেছিল। বিদেশে থাকলে কী হবে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সম্পর্কে সে যে এতটা অবহিত ও অভিজ্ঞ তা আমার জানা ছিল না। রাজনীতিতে তার নিষ্ঠা এবং অভিজ্ঞতা প্রচুর। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের সঙ্গে সে পরিচিত হয়েছে এবং দু’জন বিখ্যাত এমপি টেসা জুয়েল এবং হ্যারি কোহেনের সহকারী হিসেবে কাজ করেছে। ২০১০ সালে ব্রিটিশ লেবার পার্টির যখন নতুন নেতা নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে তখন অনেকের ধারণা ছিল টিউলিপ ব্লেয়ারপন্থী বড় মিলিব্র্যান্ডের পক্ষাবলম্বন করবে। কারণ, তারই জেতার সম্ভাবনা ছিল বেশি এবং টাইমস থেকে শুরু করে বিগ মিডিয়াগুলো তাকেই সমর্থন দিচ্ছিল। ছোট ভাই এড মিলিব্যান্ড ব্লেয়ারের তথাকথিত নিউ লেবারের বিরোধী এবং নিজেকে একজন সোস্যালিস্ট বলতে দ্বিধা করেন না। টিউলিপ লেবার পার্টির নেতৃত্বের এই দ্বন্দ্বে এড মিলিব্যান্ডের হয়ে কাজ করে এবং লেবার লেফট গ্রুপে তার সমাদর প্রচুর। লেবার দলীয় বর্তমান বাঙালি এমপি রোশনা আলীও এড মিলিব্যান্ডের গ্রুপে।
৭ জুলাই রোববার টিউলিপ-ক্রিসের বিবাহোত্তর সংবর্ধনায় গেছি। ১১ জুলাই বৃহস্পতিবার লন্ডনের সান্ধ্য দৈনিক ইভনিং স্ট্যান্ডার্ডে দেখি পাতা জোড়া বিরাট খবর। সঙ্গে টিউলিপের ছবি। খবরের হেডিং হল `Bangladeshi PM's niece is contender for Labour marginal of Hamstead' অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বোনঝি লেবারের মার্জিনাল আসন হ্যামস্টেডে মনোনয়ন প্রার্থী। যদিও পার্লামেন্টের এই আসনে টিউলিপের দলীয় মনোনয়ন লাভের সম্ভাবনা বেশি, তথাপি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে জোরেশোরে। মনোনয়ন প্রার্থী অপর দু’জনও শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী প্রার্থী। এ ছাড়া আসনটিও লেবার দলের খুব নিরাপদ আসন নয়। ইতিপূর্বে অভিনেত্রী গ্লেন্ডা জ্যাকসন এই আসনে মাত্র ৪২ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন।
লন্ডনের হ্যামস্টেড-কিলবার্ন কেন্দ্রে লেবার পার্টির অপর দু’জন মনোনয়ন প্রার্থী খুবই প্রভাবশালী। সোফি লিনডেন এখন হ্যাকনি কাউন্সিলের ডেপুটি মেয়র এবং আগে শিক্ষা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা ছিলেন। অন্যজন সেলি গিমসনও টিউলিপের মতো ক্যামডেনের একজন কাউন্সিলর, একটি ন্যাশনাল চ্যারিটির প্রধান এবং একজন সাংবাদিক ছিলেন। দলের মনোনয়ন পেতে টিউলিপকে যেমন জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে, তেমনি মনোনয়ন পেলে লেবারের এই মার্জিনাল আসনে টোরি ও লিবারেল উভয় প্রার্থীর সঙ্গেই তাকে জোর লড়াইয়ে নামতে হবে। তবে ইভনিং স্ট্যান্ডার্ডের প্রতিবেদনের মতে, টিউলিপের শক্তির ভিত্তি হচ্ছে স্ট্রং কম্যুনিটি লিংক এবং ব্যক্তিত্ব ও আত্মবিশ্বাস। সে যে একজন সোস্যালিস্ট এবং লেফট সে কথা কোনো কারণেই লুকিয়ে রাখেনি। সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল তার কাছে, লেবার পার্টির ভালো কাজ এবং খারাপ কাজ কোনটি? টিউলিপের জবাব, ভালো কাজ হচ্ছে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের উন্নয়ন আর খারাপ কাজ হচ্ছে ইরাকযুদ্ধ। ব্রিটিশ রাজনীতিতে টিউলিপ সিদ্দিক যদি একটি পাকা আসন তৈরি করতে পারে, তাহলে তা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতেও সুদূরপ্রসারী শুভ প্রভাব বিস্তার করবে বলে আমার ধারণা। টিউলিপের বয়স এখন মাত্র তিরিশ। সারাটা জীবন তার সামনে পড়ে আছে। বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক নিষ্ঠার যে পরিচয় এই বয়সে তার মধ্যে পাচ্ছি এবং সমাজতন্ত্র ও লেফট চিন্তা-চেতনার যে স্পষ্ট বিকাশ তার মধ্যে দেখছি, তা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ-রাজনীতিকেও প্রভাবিত করার সম্ভাবনা রয়েছে। তা যদি হয়, দেশের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দল আওয়ামী লীগে বর্তমানে যে ডান বিচ্যুতি ক্রমশ লক্ষণীয় হয়ে উঠছে, তা বাধাগ্রস্ত হবে এবং আওয়ামী লীগের তরুণ প্রজন্মের নেতাকর্মীরাও হয়তো টিউলিপের ভাবাদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হবে। তাহলে আওয়ামী লীগ বাঁচবে এবং বাংলাদেশ বাঁচবে।

No comments

Powered by Blogger.