আ.লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে বিভক্তি-দলাদলি স্পষ্ট

পাঁচ সিটি করপোরেশনে ভরাডুবির পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে দলাদলি ও গ্রুপিং-লবিং শুরু হয়েছে। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে ‘ব্যর্থ’ আখ্যা দিয়ে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পরিবর্তন আনতে চাইছে।
দলের একটি প্রভাবশালী অংশ এ ব্যাপারে সক্রিয় হয়েছে। কেউ কেউ জাতীয় নির্বাচনের আগে বিশেষ কাউন্সিলের দাবি তুলেছেন।
দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা জানান, নেতৃত্ব নিয়ে মাঠপর্যায়ে দীর্ঘদিনের কোন্দল বা দলাদলি থাকলেও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে এ রকম ছিল না। পাঁচ সিটি করপোরেশনে পরাজয়ের পর হঠাৎ বিভক্তি ও দলাদলি প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০ জুলাই দেশে ফেরার পর থেকেই একটি অংশ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বিপক্ষে সক্রিয় হয়েছে। এ অংশটি দলের সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক পদে পরিবর্তন আনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিশেষ কাউন্সিলেরও দাবি করেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য ও একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রথম আলোকে বলেন, ‘দলে এখন প্রচণ্ড অস্থিরতা চলছে। কখন কী হয় বলা যাচ্ছে না।’
সৈয়দ আশরাফের পদত্যাগ নিয়ে গুজব: দলের ভেতরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আওয়ামী লীগের একটি অংশ চায় সৈয়দ আশরাফ পদত্যাগ করে দল থেকে বিদায় নিক। এই অংশটি কয়েক দিন ধরেই আশরাফের পদত্যাগের কথা প্রচার করছে। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় সংবাদও প্রকাশিত হচ্ছে।
তবে পদত্যাগের খবরকে ‘মিথ্যা ও ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন সৈয়দ আশরাফ। গতকাল রোববার সংসদ ভবনের বাইরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার পদত্যাগের বিষয়ে গণমাধ্যমে যে বক্তব্য এসেছে, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। দলীয় সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগের খবর আমার জানা নেই, আপনাদের কাছে থাকলে বলেন।’ রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য একটি গোষ্ঠী এ ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
দলের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সৈয়দ আশরাফ এক-এগারোর সময় ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই দলের একটি অংশ তাঁকে মেনে নিতে পারেনি। তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পরও এ অংশটি তাঁর বিপক্ষে ছিল। গত বছরও একবার তাঁর পদত্যাগের গুজব ওঠে। সম্প্রতি পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পরাজয়ের পর এ অংশটি তাঁর বিপক্ষে আবার সরব হয়।
তবে সৈয়দ আশরাফের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ হচ্ছে, তিনি দলে সময় দিতে চান না। সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর কয়েকটি জেলায় দলীয় জনসভায় গেলেও তিনি জেলাভিত্তিক কোনো বর্ধিত সভা করেননি, ঢাকার বাইরে সাংগঠনিক সফরেও যাননি। দলীয় কার্যালয়েও তিনি খুব একটা যান না। জেলা বা কেন্দ্রীয় নেতারা সব সময় তাঁকে পান না বলেও অভিযোগ করেন। এমনকি তিনি দলীয় নেতাদের সঙ্গে ফোনেও যোগাযোগ রাখতে চান না। সচিবালয়ে নিজ দপ্তরেও তিনি নিয়মিত যান না।
দলে অস্থিরতা: একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর তিন দিন ধরে গণভবনে থেকেই দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলাদাভাবে কয়েক দফা বৈঠক করেন। এখন পর্যন্ত তিনি গণভবনের বাইরে কোনো কর্মসূচিতে যোগ দেননি। পাঁচ সিটি করপোরেশনে পরাজয় তাঁকে যথেষ্ট হতাশ করেছে। নেতা ও মন্ত্রীদের নানা কর্মকাণ্ডে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। অনেককে প্রকাশ্যেই তিনি ভর্ৎসনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী নেতাদের সঙ্গে আলোচনাকালে দল ও সরকারে পরিবর্তন আনার আভাস দেন। তবে কীভাবে এ পরিবর্তন হতে পারে এ ব্যাপারে কিছু বলেননি। গত বৃহস্পতিবার একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর নেতৃত্বে তিনজন নেতা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একান্তে দেখা করে বিশেষ কাউন্সিলের প্রস্তাব দেন। আগের দিনও তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে একই প্রস্তাব দেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁদের কথা শুনলেও এ ব্যাপারে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কিছুই বলেননি। তবে তিনি সাংগঠনিক সম্পাদকদের কাজে অসন্তোষ প্রকাশ করেন বলে জানা গেছে। পাঁচজন সাংগঠনিক সম্পাদকের নাম ধরেই তিনি তাঁদের কাজকর্ম নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেন।
দলের ভেতরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশেষ কাউন্সিল বা দলের নেতৃত্বে পরিবর্তন আনতে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও মন্ত্রী, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী, সাংগঠনিক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় সদস্যসহ সাত-আটজন নেতা সক্রিয় হয়েছেন। তাঁদের অনেকেই এক-এগারোর সময় দেশের বাইরে পালিয়ে ছিলেন। দলের এ অংশটির ওপর আওয়ামী লীগের সাবেক কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতারও সমর্থন আছে। দলের এ অংশটির দাবি, বর্তমান কমিটির গুরুত্বপূর্ণ নেতারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেননি।
অন্যদিকে বর্তমান কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা কয়েক দিন চুপচাপ থাকলেও এখন ওই অংশটির বিপক্ষে মাঠে নেমেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। তাঁরা জাতীয় নির্বাচনের আগে কাউন্সিলের পক্ষে নন। তাঁরা মনে করেন, কয়েকজন নেতা বিশেষ উদ্দেশ্যে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের দায়ভার অন্যের কাঁধে চাপাতে চাইছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ অংশের একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে দলের নেতৃত্বে পরিবর্তনের জন্য গ্রুপিং-লবিং করছেন, তাঁরাও দলের দায়িত্বশীল পদে রয়েছেন। তাঁরা নিজ দায়িত্ব কতটুকু পালন করেছেন তা নেতা-কর্মীরা জানেন। কেউ কেউ শুধু ক্ষমতা উপভোগ ও ‘মিডিয়া শো’ করেছেন।
তবে এ দলাদলির বাইরে থাকা একটি অংশ মনে করে, জাতীয় নির্বাচনের আগে কাউন্সিল হলে বা নেতৃত্বে পরিবর্তন আনা হলে দলে অনৈক্য বাড়বে। আগামী নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে পারে। তা ছাড়া কাউন্সিল বা দলে পরিবর্তনের বিপক্ষে থাকা নেতারাও ওই অংশের বিপক্ষে এখন মাঠে নেমেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর দুটি পদ খালি আছে। দলের গঠনতন্ত্র অনুসারে সভাপতি যেকোনো সময় এ দুটি পদে কাউকে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। খুব শিগগিরই এ দুটি পদ পূরণ করা হবে। তবে বর্তমান কমিটি থেকে কাউকে বাদ দিতে হলে বা ওই পদে নতুন কাউকে অন্তর্ভুক্ত করতে হলে কাউন্সিল করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বিশেষ কাউন্সিলের কথাটি প্রধানমন্ত্রীর কানে পৌঁছানো হলেও তিনি এ ব্যাপারে স্পষ্ট কিছু বলেননি।

No comments

Powered by Blogger.