বেসিক ব্যাংকে আর্থিক অনিয়ম: ব্যাংকের চেয়ারম্যানের কর্মকাণ্ড নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিলেন এক পরিচালক বেসিক ব্যাংকে এসব কী হচ্ছে! by ফখরুল ইসলাম

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকের অনিয়ম, দুর্নীতি ও জালিয়াতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এবার খোদ ব্যাংকের ভেতর থেকেই। ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) নানা কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরে ব্যাংকেরই একজন পরিচালক সরাসরি অভিযোগ করেছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ে।
এতে ওই পরিচালক তাঁর অবস্থানও ব্যাখ্যা করেছেন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব এম আসলাম আলমের কাছে ১১ জুলাই অভিযোগ-সংবলিত একটি চিঠি দিয়েছেন বেসিক ব্যাংকের পরিচালক, সাবেক অতিরিক্ত সচিব এ কে এম রেজাউর রহমান। ‘বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ’ শিরোনামের চিঠিতে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল হাই ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী ফখরুল ইসলামের স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়মের নানা চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। গত ২১ মে বেসিক ব্যাংকের আরেক পরিচালক এ কে এম কামরুল ইসলামকে নিয়ে সচিবের সঙ্গে দেখা করে চেয়ারম্যানের ব্যাপারে এসব কথা জানিয়ে গিয়েছিলেন বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
এতে বলা হয়, বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান গোটা ব্যাংকে এমন একটি আবহ তৈরি করেছেন যে প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য কাউকে পরোয়া করেন না তিনি। এ কে এম রেজাউর রহমান এই চিঠি পাঠানোর কথা স্বীকার করে প্রথম আলোকে শুধু এটুকু বলেন, ‘সরকারের কাছে আমি জানানোর প্রয়োজন মনে করেছি, তাই জানিয়েছি।’
পর্ষদে অপঠিত কার্যবিবরণী: প্রথাগতভাবে পর্ষদ সভার শুরুতেই আগের সভার কার্যবিবরণী পড়া হয়। কিন্তু বেসিক ব্যাংকে এ ব্যাপারে গুরুত্ব দেন না চেয়ারম্যান। ফলে বোঝা যায় না আগের সভার সিদ্ধান্ত কী এবং তা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে। এসব কথা উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘সভার কার্যসূচি ও প্রচুর কার্যপত্র সভার আগের রাতে দেওয়া হয়। অল্প সময়ে এগুলো পড়ে সভার কার্যক্রমে ভূমিকা রাখা সম্ভব হয় না।’
স্বচ্ছতা বজায় রাখা ও অনিয়ম পরিহারের স্বার্থে আগের সভার কার্যবিবরণী উপস্থাপন ছাড়া কোনো সভা শুরু না করার প্রস্তাব করেছিলেন পরিচালক এ কে এম কামরুল ইসলাম। চেয়ারম্যান ও এমডি মিলে তখন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, পরবর্তী সভা থেকে তা অনুসরণ করা হবে। চিঠিতে বলা হয়, এখনো সেই প্রতিশ্রুতি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। কার্যবিবরণী উপস্থাপনে গড়িমসি করা হয়।
অনিয়মের আলোচনায় নারাজ: বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা করতে দেন না ব্যাংকের চেয়ারম্যান। গত ৩০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত পর্ষদের সভায় ‘বেসিক ব্যাংকের পর্ষদ কর্তৃক ১৩টি অনিয়মজনিত ঋণ প্রদান’ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি চিঠি উপস্থাপিত হয়েছিল। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, ‘সেটি সম্পর্কে কোনো আলোচনার প্রয়োজন নেই বলে চেয়ারম্যান পাতা উল্টিয়ে পরবর্তী বিষয়ে চলে যাচ্ছিলেন। আমি বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে আলোচনার দাবি জানাই।’ আলোচনার পর জানা যায়, ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত পর্ষদের সভায় এ ঋণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক স্থগিত রাখতে বলে ঋণ বিতরণ কার্যক্রম।
এ কে এম রেজাউর রহমান চিঠিতে বলেন, ‘তার পরও পর্ষদ কীভাবে অনিয়মিতভাবে ঋণ দিয়ে যাচ্ছে, সে বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করলে চেয়ারম্যান ভবিষ্যতে যেন এ রকম না ঘটে, সে জন্য এমডিকে নির্দেশ দেন।’
অনিয়ম না থাকলে মুচলেকা কেন: চিঠিতে বলা হয়েছে, গত ২৭ জুন বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে ব্যাংকের একটি পর্ষদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই দিনই প্রথম আলোয় ব্যাংকের অনিয়মিত কার্যকলাপ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পর্ষদ সভায় চেয়ারম্যান ও এমডি দুজনই বলেন, প্রথম আলোর প্রতিবেদনটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বানোয়াট। আবার ওই দিনই ব্যাংকের অনিয়মজনিত কার্যকলাপ রোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করে দেওয়া খসড়া সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) অনুমোদনের জন্য পর্ষদে উপস্থাপন করা হয়।
এ কে এম রেজাউর রহমান চিঠিতে বলেন, ‘সভায় আমি জানতে চাই, এমওইউর দরকার হচ্ছে কেন। আমার দৃষ্টিতে এমওইউ হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংককে দেওয়া একতরফা মুচলেকা দেওয়ার শামিল একটি দলিল। কোনো অনিয়ম হয়ে না থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক এমন অঙ্গীকারনামা সইয়ের প্রস্তাব করার কথা নয়।’
চিঠিতে বলা হয়, এমওইউ সই হলে ব্যাংকের কার্যকলাপ চালাতে অসুবিধা হবে বলে সভায় মত দেন এমডি। আরেক ধাপ এগিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, এমওইউর বিষয়টি বিচার-বিশ্লেষণ করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে কিছুদিন সময় দেওয়ার অনুরোধ করা হবে।
বেসিক ব্যাংকের এমডি কাজী ফখরুল ইসলাম এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেঁধে দেওয়া সময় ১৭ জুলাইয়ের মধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক বা এমওইউ করা হচ্ছে।’ পর্ষদ সভায় এমওইউ করলে ব্যাংক চালাতে অসুবিধা হওয়ার কথা বলেছিলেন কেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঠিক তা নয়, আমরা একটু পেছাতে চেয়েছিলাম। বাংলাদেশ ব্যাংক এতে রাজি হয়নি।’
অভিযোগের সত্যতা ও বিবেকের দংশন: সচিবের কাছে চিঠিতে বলা হয়, পত্রপত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে বেসিক ব্যাংকের অনিয়ম ও জালিয়াতির তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে। এ নিয়ে জাতীয় সংসদে জ্বালাময়ী বক্তৃতা হয়েছে। পত্রিকার প্রতিবেদন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিপত্র পড়ে দেখা যায় অভিযোগগুলোর সত্যতা রয়েছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, যদিও ঘটনাগুলো তাঁর এই ব্যাংকে পরিচালক নিয়োগ পাওয়ার আগের, তবু তিনি বিব্রত ও হতাশাগ্রস্ত। যে অস্বচ্ছ ও ত্বরিতগতিতে পর্ষদের কাজ সমাপ্ত করা হয়, তাতে তাঁর সন্দেহ হয়, নিকট-অতীতেও এমন কিছু গর্হিত কাজ হয়ে থাকতে পারে।
রেজাউর রহমান চিঠিতে লেখেন, ‘জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ৩২ বছরের দাগবিহীন কর্মজীবন পার করে আজ সমাজের কলঙ্কিত ব্যক্তিদের একজন হিসেবে গণ্য হব—ভাবতেও ভয় লাগে। একদিকে ব্যাংকটির পর্ষদ থেকে সরে দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে, অন্যদিকে বিবেক বলছে ব্যাংকটির স্বার্থরক্ষার্থে পাহারাদারের কাজটি চালিয়ে যেতে।’
চিঠিতে বলা হয়, চারজন পরিচালক চাকরিতে কর্মরত। নিজেদের কাজের ভারে ও সময়ের অভাবে সভার কার্যসূচি ও কার্যপত্র মনোযোগ দিয়ে পড়ে আসতে পারেন না। রাজনৈতিক মতাদর্শে নিমগ্ন দুই পরিচালক সব সময় চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠতা পেতে আগ্রহী। বেসিক ব্যাংকের সংঘবিধি ও সংঘস্মারক অনুযায়ী পর্ষদের চেয়ারম্যান হওয়ার কথা পরিচালকদের মধ্য থেকে। এ কে এম রেজাউর রহমানের প্রশ্ন, ‘সরকার কেন আলাদা চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়ে সর্বেসর্বা হওয়ার সুযোগ দেয়?’

No comments

Powered by Blogger.