পদ্মা সেতু নির্মাণ : সরকার প্রকৃতপক্ষে আন্তরিক কি না? by ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর-বিক্রম

একটি সেতু নদীর দুই পারের মধ্যে বন্ধন গড়ে দেয়। এটি কেবল ভৌগোলিক বাস্তবতাই নয়, একটি সেতুর সঙ্গে কোটি মানুষের স্বস্তি ও সমৃদ্ধির বিষয়টিও যুক্ত হয়ে যায়। পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি ঘটাবে, সেটি আশা করা হয়েছিল।
আশা করা হয়েছিল, এরই মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দুটি বিভাগ খুলনা ও বরিশাল এবং ঢাকা বিভাগের ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ীর মানুষের দীর্ঘদিনের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে।
সময় সাশ্রয়ের সঙ্গে অর্থনীতির হিসাব ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। একটি সেতু জাতীয় অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার ও জোরালো অবদান রাখতে সক্ষম। দক্ষিণবঙ্গ তথা দেশবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পদ্মা নদীর ওপর একদিন সেতু নির্মিত হবে। এ সেতু রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের দূরত্ব হ্রাস করবে। ফলে কেবল দক্ষিণবঙ্গের মানুষেরই নয়, সারা দেশেরই অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হতো ইতিবাচক পরিবেশ। মংলা বন্দরে কর্মচাঞ্চল্য ফিরে আসত।
পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন ক্ষমতাসীন মহাজোটের অন্যতম নির্বাচনী কর্মসূচি ছিল। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ ক্ষমতায় আসার জন্য উদারভাবে তাঁদের সমর্থন দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবায়নের আগেই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কারণে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের সব আশা নিরাশায় পরিণত হয়েছে।
কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি বা দুর্নীতির ষড়যন্ত্র নিয়ে সরকার যে তদন্ত করেছে, তা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি; বিশ্বব্যাংক প্যানেলের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তা-ই প্রমাণিত হয়েছে। পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কোনো একজনকে মামলায় অন্তর্ভুক্ত করেনি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, বাদ পড়েছে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত মূল হোতা।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে পদ্মা সেতু নিয়ে ঋণচুক্তি হওয়ার পর ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে এবং ২০১২ সালের এপ্রিলে দুবার বাংলাদেশকে চিঠি দিয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। চুক্তি বাতিল না করে পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বানের মাধ্যমে বাংলাদেশকে যথেষ্ট সময়ও দেওয়া হয়েছিল। এরপর সরকার মন্ত্রিসভায় রদবদল করলেও দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গত ১৭ ডিসেম্বর দুদকের সাবেক সেতুসচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়াসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করে। সাতজনের মধ্যে তিনজন বিদেশি নাগরিক, তাঁরা সবাই ঘুষ দিয়ে কাজ পেতে আগ্রহী, কানাডার প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের সাবেক কর্মকর্তা রমেশ শাহ ও মোহাম্মদ ইসমাইলের বিরুদ্ধে কানাডার আদালতে মামলা চলছে।
মামলা থেকে মূল হোতাকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা উল্লেখ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুদকের মামলা থেকে দোষী ব্যক্তিদের বাদ দেওয়ার কোনো বৈধ ও উপযুক্ত কারণ নেই। তাঁদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। বিশেষ করে রমেশ শাহর ডায়েরিতে তাঁদের নাম লেখা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞ প্যানেলের এই চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ২০১২ সালের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত দুদক ও বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন সময় বৈঠক ও চিঠির মাধ্যমে আলোচনার সংক্ষিপ্ত একটি বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। যেমন-
অক্টোবর ১০-১৬ : জাপানের টোকিওতে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক, অন্যান্য দাতা এবং বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একটি প্রস্তুতিমূলক বৈঠক হয়। এরপর ১৪ অক্টোবর দুদক প্যানেলকে জানায়, সন্দেহ করার মতো কোনো তথ্য দুদকের হাতে নেই।
নভেম্বর ৯ : বিশ্বব্যাংক এ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দুদকে পাঠায়, যা অনুসন্ধান পর্যায় থেকে তদন্ত পর্যায়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক।
ডিসেম্বর ২-৫ : ঢাকায় দুদক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তদন্তের বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা হয়।
ডিসেম্বর ১৭ : দুদক তদন্ত শেষ করে মূল হোতাকে বাদ দিয়ে অন্য সাতজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করে। অন্য কোনো ব্যক্তি এ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কি না তা খতিয়ে দেখা হবে।
জানুয়ারি ৯ : দুদকের কাছে লেখা চিঠিতে প্যানেল জানায়, প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হিসেবে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী এ ক্ষেত্রে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। সাবেক সচিবের অনুরোধে তিনি এসএনসি-লাভালিনের ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে দেখা করে সম্ভবত অবৈধ অর্থ ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা করেন। প্যানেল মনে করে, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর নাম মামলায় আসামি হিসেবে এনে তাঁকে তদন্তের আওতায় আনা উচিত ছিল।
জানুয়ারি ২১ : প্যানেলের প্রশ্নের জবাবে দুদক চিঠিতে জানায়, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীকে আসামি করার মতো দালিলিক প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। তবে তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।
জানুয়ারি ৩১ : অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট কিমকে চিঠি দিয়ে জানান, পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সাহায্য বাংলাদেশ নেবে না। তবে পদ্মা সেতু নিয়ে অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত চলবে।
বিশেষজ্ঞ দলের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বিশ্বব্যাংক ঠিক সময়ে পাওয়া তথ্য দিয়ে চলমান দুর্নীতি ও ঘুষ লেনদেন সার্থকভাবে প্রতিহত করেছে, যা অনেক বেশি আর্থিক ক্ষতি ও লক্ষ্য অর্জনে বিঘ্ন তৈরি করতে পারত। এসব তথ্য একই সময়ে বাংলাদেশের তদন্ত সংস্থাকে অবহিত করার পরও দুদক এ বিষয়ে সঠিক কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
দীর্ঘ ছয় মাস পর্যবেক্ষণ শেষে প্যানেলের দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্ত, এফআইআর ও মামলার প্রক্রিয়া তাদের কাছে সঠিক মনে হয়নি। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক গঠিত তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল পুনরায় বহুল আলোচিত যোগাযোগমন্ত্রী প্রসঙ্গ উত্থাপন করে জানিয়েছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের মামলায় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত ছিল। এদিকে বিশ্বব্যাংক প্যানেলের চূড়ান্ত কপি হাতে পাওয়ার পর অর্থমন্ত্রী বলেছেন, 'আমি এখনো বলছি, পদ্মা সেতু নির্মাণে কোনো দুর্নীতি হয়নি, হওয়ার সুযোগও নেই।' পদ্মা সেতুর দুর্নীতি বিষয়ে বিশ্বব্যাংক প্যানেলের তদন্ত প্রতিবেদন অর্থমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে ১১ জুন। গত বছর বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষণ প্যানেল বাংলাদেশ ঘুরে গিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করে। অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টরও সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বাংলাদেশের গোটা অর্থনীতির জন্য পদ্মা সেতু গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক আর অর্থায়ন করছে না।
বিশ্বব্যাংকের পর পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন করা থেকে চূড়ান্তভাবে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেয় জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। ২৯১ কোটি ডলারের প্রকল্পে জাইকার ৪০ কোটি ডলার অর্থায়নের কথা ছিল। ভারত সফররত জাইকার প্রেসিডেন্ট আকিহিকো তানাকা মঙ্গলবার রাতে চূড়ান্তভাবে দাতা সংস্থাটির সরে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানান।
বাংলাদেশ সরকার বাইরের কারো আর্থিক সহযোগিতা না নিয়ে নিজস্ব অর্থায়নেই এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে। ফলে এ প্রকল্পে আমাদের স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার যে পরিকল্পনা ছিল, তা এরই মধ্যে বাতিল করা হয়েছে।
পদ্মা সেতু নিয়ে নতুন করে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। গত ২৬ জুন টেন্ডার আহ্বানের পর যোগাযোগমন্ত্রী দাবি করেন, দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব। আর অর্থমন্ত্রী সেতু নির্মাণ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনোভাবেই দেশীয় অর্থে পদ্মা সেতুর মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। পদ্মা সেতুর মতো এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেন এমন প্রতিষ্ঠান দেশে নেই, এ ধরনের মত প্রকাশ করেছেন পদ্মা সেতু প্রকল্পের কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির আহ্বায়ক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। অথচ সরকারের মন্ত্রীরা হরহামেশাই পদ্মা সেতু নির্মাণের বিষয় নিয়ে স্ববিরোধী বক্তব্য দিয়েই যাচ্ছেন। তাই প্রশ্ন, পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্যই কি সরকার নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করেছে? নাকি শুধু ভোটের বৈতরণী পার হতে দেশের মানুষকে বোকা বানাতে এ কৌশল অবলম্বন করেছে। এটি পদ্মা সাঁকো নয়, পদ্মা সেতু।
যমুনা সেতু আমি যখন যোগাযোগমন্ত্রী ছিলাম তখন নির্মিত হয়েছে। তাই আমি বলতে পারি, এ ধরনের সেতু নির্মাণ সময়সাপেক্ষ এবং কঠিন কাজ। বিদায়বেলায় টেন্ডার আহ্বান ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন প্রতারণার শামিল।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই জাতি একদিন জেগে উঠবেই এবং বেঁচে থাকবে সত্যকে ধারণ করে। সবার সমান অধিকার বাস্তবে রূপ নেবে। সব অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি, দলীয়করণ এবং আত্মীয়করণ চিরদিনের জন্য বিদায় নেবে। আল্লাহ নিশ্চয়ই মানুষের আহাজারির সঠিক জবাব দেবেন।

লেখক : সংসদ সদস্য ও চেয়ারম্যান,
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি

No comments

Powered by Blogger.