আজিমপুরে কবর চুরির ব্যবসা! by মাজেদুল নয়ন

ধরেন ছয় মাস হইয়া গেল কবর দিছে, কিন্তু দুই মাস পর থেইক্কাই লাশের স্বজনগো কোনো খোঁজ-খবর নাই। আমগোরেও কয় নাই কবর দেখতে, তখন ওই কবর থেইকা হাড়গোড় সরাইয়া নতুন লাশের দাফন করা হয়। এটাই হইলো কবর চুরি।
শুক্রবার বাংলানিউজের সঙ্গে কথোপকথনে ‘কবর চুরি’প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা দেন আজিমপুর গোরস্থানের গোরখোদক (কবর খননকারী) মান্নান। তবে স্বজনের কবরের জন্যে গোরস্থানের লোকজনকে মাসওয়ারি (মাসপ্রতি) অর্থ দিলে তা অক্ষত থাকবে বলে জানান তিনি।

আজিমপুর গোরস্থানে কবর নিয়ে চলছে এ ধরনের ভয়াবহ বাণিজ্য। গোরখোদক মান্নান বলেন, “গত মঙ্গলবারও দুইডা পোলা আসে বাপের কবর দেখতে। গত বছরের নভেম্বরে কবর দেওয়া হইছিল পশ্চিম পার্শ্বে। কিন্তু এখন আইস্যা দেখে কবর নাই। আসলে ফেব্রুয়ারিতে কবর চালা দেওয়া হইছে (পুরনো কবরকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে নতুন কবরের উপযোগী করা)। তাই মিশ্যা গেছে।”

তবে সিটি করপোরেশনের নিয়াম অনুযায়ী গোরস্থানে কবর ১৮ মাস সংরক্ষণ করতে হবে। এরপর সেগুলো চালা হয়। স্বজনদের আলাদাভাবে অর্থ দেওয়ার কোনো নিয়ম নেই।

নিজেকে সৎ দাবি করে মান্নান জানান, এসব কবর চুরি ও বাণিজ্যের সঙ্গে তিনি জড়িত নন। তবে তার মতো অন্য গোরখাদকরাই কবর চুরি ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এদের সঙ্গে রয়েছে গোরস্থানের কর্মকর্তা, ঠিকাদার থেকে শুরু করে স্থানীয় আজিমপুর ও লালবাগের নেতারাও।

ঢাকা সিটি করপোরেশনের দেওয়া খরচের হিসেব অনুযায়ী, আজিমপুর গোরস্থানে লাশ দাফন করার জন্য নির্ধারিত রেজিস্ট্রেশন ফি ২০ টাকা। বড় কবর খুঁড়তে ৬০ টাকা, বড় কবরের জন্যে কাটা বাঁশ প্রতিটি ২৫ টাকা, ঠেক দেওয়ার বাশঁ প্রতিটি ১২ টাকা ও ছয় টাকা করে প্রতিটি ম্যাট। এক্ষেত্রে একটি কবরের জন্যে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা খরচ হয়।

আবার মধ্যম আকারের একটি কবর খুঁড়তে ৫৫ টাকা, কাটা বাঁশ প্রতিটি ১৮ টাকা, নোয়ানো বাশঁ প্রতিটি ১০ টাকা ও ছয় টাকা করে চাটাই কিনতে হয়। যাতে মোট খরচ হয় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা।

আর ছোট কবর খুঁড়তে ৫০ টাকা, কাটা বাশঁ প্রতিটি ১২ টাকা, নোয়ানো বাঁশ প্রতিটি ছয় টাকা ও চাটাই ছয় টাকা দরে সাড়ে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকাতেই দাফন সম্পন্ন হয়।

পান্থপথের বাসিন্দা ও একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রবিউল ইসলাম। বাংলানিউজকে তিনি জানান, গত সেপ্টেম্বর মাসের ২০ তারিখে তার বাবা তরিকুল ইসলাম মারা যান। বাবাকে গোরস্থানের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে হাতের বাঁয়ে লেনের ১০ নাম্বার লাইনের ৪ নাম্বার কবরে দাফন করা হয়েছে। তখন আজিমপুর গোরস্থানে লাশ দাফন করাতে তাদের সব মিলিয়ে তিন হাজার টাকার ওপর খরচ হয়।

২০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় বাবা মারা যাওয়ার পর আজিমপুর গোরস্থানে খোঁজ নিতে যান রবিউল। তিনি বলেন, “কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকটি জায়গা দেখান যেগুলো গোরস্থানের বিভিন্ন প্রান্তের দেয়াল ঘেঁষে।” পরে গোরস্থানেরই ইকবাল নামে এক ব্যাক্তি বলেন, “কিছু বখশিস দিলে আরো সামনে জায়গা খোঁজা হতে পারে। ৩০০ টাকা নগদ দেওয়ার পর, তিনি কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে সামনে লেনের পাশেই আরেকটি জায়গা দেখান।” তখনই লাশ দাফনের জন্যে গোরস্থান কর্তৃপক্ষ ৯৫০ টাকা নিয়ে নেয় রবিউলের কাছ থেকে।

রবিউল বলেন, “রাত ১১টার দিকে কবর দেয়ার সময় খননকারীরা গড়িমসি করছিল। তারা বাবার লাশকে সম্মান দিচ্ছিল না, রাত হয়ে যাচ্ছে বলে তাড়াহুড়ো শুরু করে। পরে বখশিসের কথা বলে ভালোমতো দাফন করা হয়। ২০০ টাকা বখশিসে সন্তুষ্ট না হলে ৫০০ টাকা দিতে হয় পাঁচজন গোরখোদককে।”

রবিউল আরো বলেন, “দাফন করার সময় আমাদের আত্মীয়স্বজন ছাড়াও গোরস্থানের বেশ কয়েকজন কবর দেওয়া দেখছিলেন, এদের মধ্যে একজন হুজুরও ছিলেন। গোরস্থানেরই একজন বললেন, লাশের দাফন হয়ে গেল, দোয়া করাবেন না?” রবিউল হুজুরকে অনুরোধ করলে তিনি জানান হাদিয়া দিতে হবে। দোয়া শেষে হুজুরকে আরো ২০০ টাকা হাদিয়া দিতে হয়।

রবিউল আরো বলেন, দাফন সম্পন্ন করে বের হওয়ার সময়ই আব্দুল কাদের নামে একজন এসে বলেন, “এখানকার লোকদের কিছু টাকা পয়সা দিয়ে যান, তাহলে দুই বছর পর্যন্ত কবরের যত্ন নেবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখবে। আপনের বাবার আত্মা শান্তি পাবে। এরা কবর সহজে চালতে দেবে না। নিশানা ঠিকমতো থাকবে। কবর ঠিক রাখতে আপাতত ৫০০ টাকা চাওয়া হয় রবিউলের কাছে।” শোকার্ত স্বজনরা এ সময় আর কিছু না ভেবে বরং মৃতের আত্মার শান্তির কথা ভেবেই এভাবে প্রতারণার শিকার হন।

রবিউল জানান, “পরবর্তী সময়ে গত নভেম্বর মাসে কবর জিয়ারত করতে গেলে কাদের এবং অন্য আরেকজন এসে জানান, আমাদের এক হাজার টাকা বাকি হয়েছে। তাদের হিসেব অনুযায়ী, অক্টোবর ও নভেম্বর দু’মাসের কবর সংরক্ষণের জন্যে এ টাকা তারা পাবে। অবশেষে বাকবিতণ্ডা করে ৬০০ টাকা দিয়ে আসতে হয়। যদি আবার নিশানা উঠিয়ে ফেলে অথবা চুরি করে ফেলে এই ভয়ে।”

আজিমপুরের স্থানীয় ব্যবসায়ী লতিফুর রহমান (৫০) বাংলানিউজকে বলেন, “এখানে কবর চুরি নতুন কোনো ঘটনা নয়। এগুলো ওপেন সিক্রেট। একটি সিন্ডিকেট মৃতের সঙ্গে আশা শোকার্ত মানুষকে হয়রানি করে অর্থ আদায় করে। কবর দেখভালের কথা বলে স্বজনদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে মাসে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা করে আদায় করে।” সাধারণত গোরখোদক, মালি ও কর্মচারীদের কথা বলে এ অবৈধ অর্থ আদায় করা হলেও এসব অর্থের ভাগ স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের কাছেও যায় বলে জানান লতিফুর রহমান।

গত রোববার সকালে আজিমপুর গোরস্থানে গিয়ে চোখে পড়ে, সরকারি সংরক্ষণ ও স্থায়ীভাবে কেনা না হলেও গোরস্থানের দক্ষিণ পশ্চিম ও দক্ষিণ পূর্ব কোনায় ৩২০ থেকে ৩৪০টি কবর সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গোরস্থানের এক কর্মচারী জানান, এসব কবরে দাফন করা মৃতের স্বজনদের থেকে নিয়মিত টাকা নেয় কবরস্থানের কিছু কর্মচারি ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এসব এখানকার রীতি হয়ে গেছে। এটাকে আর কেউ অপরাধ ভাবে না।

তিনি আরো জানান, শবে বরাত, শবে কদর এবং দুই ঈদে কবরকে কেন্দ্র করে ব্যবসা আরো চাঙ্গা হয়। যারা মৃত স্বজনের কবর জিয়ারত করতে আসেন, বিভিন্ন অজুহাতে অর্থ আদায় করে গোরস্থানের ভেতরে থাকা দালাল ও হুজুররা।

গোরস্থানের কর্মচারী জানান, যদি স্বাভাবিক লাশ না হয়ে, সড়ক দুর্ঘটনা বা সন্ত্রাসী হামলায় মৃতের লাশ আনা হয়, গোরস্থানের লোকজন পুলিশি কাগজপত্র যাচাই করে। এ সময় স্বজনদের হয়রানি করে এক হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়তি অর্থ আদায় করা হয়। অর্থ না দিলে কাগজপত্রের অভাব রয়েছে বলে হয়রানি করে কর্তৃপক্ষ।

ওই কর্মচারী জানান, কবরস্থানের ঠিকাদারি মূলত নিয়ন্ত্রণ করেন আজিমপুর ও লালবাগের সরকারি দলের নেতারাই। ঠিকাদারি পাওয়ার জন্যে বড় অংকের অর্থ দেওয়া হয় নেতাদের। দেড় বা দুই বছর অন্তর পুরোনো কবর চালার সময় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাসওয়ারি অর্থ আদায় করা কবরগুলো ভাঙতে দেয় না।

এসব অভিযোগের ব্যাপারে গোরস্থানের ভারপ্রাপ্ত প্রধান মুহুরি (মোহর) হাফেজ হাফিজুর রহমানের সঙ্গে কথা বলার জন্যে রবি ও সোমবার দুদিন কবরস্থানের অফিসে গেলেও দেখা মেলেনি।

গোরস্থানের মোহরাব নুরুল হুদা বাংলানিউজকে বলেন, “লাশ দাফন করতে এক হাজার টাকা খরচ হবে। বাঁশ, চাটাই বেশি লাগলে খরচ বাড়ে। আর দোয়া পড়ানোর জন্যে হুজুরকে হাদিয়া এবং খবর খননকারীকে বখশিস দিয়ে দেবেন।”

এক হাজার টাকা কীভাবে খরচ হয়, জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এটা ফি।”

কবরের জমি এখন আর বিক্রি হয় না জানিয়ে হুদা বলেন, তবে ১৮ মাস পর্যন্ত কবর সংরক্ষণ করতে পারবেন। দাফনের পর সেগুলো বুঝিয়ে বলা হবে বলে জানান তিনি।

এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে আজিমপুর কবরস্থানের দায়িত্বে নিয়োজিত ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সহকারী সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা (অঞ্চল-৩) মো. রোকনুজ্জামানকে সোমবার সকালে ফোন দেওয়া হয়। কবর চুরি ও বাণিজ্যের ব্যাপারে প্রশ্ন তুললে তিনি ফোন সংযোগ কেটে দেন।

কবর বাণিজ্যের বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সহকারী সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা (অঞ্চল-৫) মো. আফজালুল আযম রেজা বাংলানিউজকে জানান, গোরস্থানের লাশ দাফনের প্রক্রিয়াটি দরপত্রের মাধ্যমে দেওয়া হয়। সবচেয়ে কম মূল্যে, সবার জন্যে উপযোগী মূল্যে বাশঁ, চাটাই এবং আনুষাঙ্গিক সামগ্রী যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দিতে পারে, তাদেরই কাজ দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, “আগের চেয়ে এখন লাশ অনেক বেশি আসছে। জুরাইন ও আজিমপুর গোরস্থানে প্রতিদিন গড়ে ৪০ থেকে ৪৫টি লাশ দাফন করানো হয়।” অভিযোগের ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ভারপ্রাপ্ত সমাজকল্যাণ ও সংস্কৃতি কর্মকতা খন্দকার মিল্লাতুল ইসলামের অফিসে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েও পাওয়া যায়নি।

No comments

Powered by Blogger.