সুপ্রীমকোর্ট কি বেলুচিস্তানকে রক্ষা করতে পারবে

পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে সরকার নামে থাকলেও তার প্রশাসন চালানোর ক্ষমতা নেই। বালুচদের চোখে সেই সরকারের কোন রাজনৈতিক বৈধতাও নেই। এমন একটা পটভূমিতে সুপ্রীমকোর্টে বেলুচিস্তানের ওপর একটা মামলা চলছে এবং কোর্ট ইতোমধ্যে একটা অন্তর্বর্তী আদেশও জারি করেছে।
মামলার তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো এর মধ্য দিয়ে সুপ্রীমকোর্টের সাহস, প্রত্যয় ও সঙ্কল্প যেমন ফুটে উঠেছে তেমনি কোর্টের ওপর বালুচদের বিশেষত বিরুদ্ধবাদী নেতাদের আস্থারও প্রতিফলন ঘটেছে। বলাবাহুল্য মামলা চলাকালে নিখোঁজ বালুচদের স্বজনদের তথা স্ত্রী ও সন্তানদের উপস্থিতিতে আদালত কক্ষ সারাক্ষণ পূর্ণ থাকত।
বেলুচিস্তান হাইকোর্ট বার সমিতির পক্ষ থেকে প্রদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর এই মামলাটি সুপ্রীমকোটে দায়ের করা হয়। সুপ্রীমকোর্ট গত ১২ অক্টোবর অন্তর্বর্তী আদেশে বলে যে, ফেডারেল সরকার বেলুচিস্তানে ফ্রন্টিয়ার বাহিনী নিয়োগ করা ছাড়া প্রদেশটিকে অভ্যন্তরীণ গোলযোগ থেকে রক্ষার ব্যাপারে আর কিছুই করতে পারেনি। জনগণের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের কারণে প্রাদেশিক সরকারও প্রদেশটিকে শাসনের সাংবিধানিক অধিকার হারিয়ে ফেলেছে। অন্তর্বর্তী আদেশে বেলুচিস্তানের মুখ্য সচিব এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিবকে প্রদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর পাক্ষিক রিপোর্ট সুপ্রীমকোর্টকে পাঠাতে বলা হয়েছে।
এই অন্তর্বর্তী আদেশের মধ্য দিয়ে বিরুদ্ধবাদী বালুচ জনগণের কণ্ঠস্বরই যেন প্রতিধ্বনিত হয়েছে। সুপ্রীমকোর্ট এক্ষেত্রে যে বিচার বিভাগীয় কৌশল অবলম্বন করছে, সেটা হলো সাংবিধানিকভাবে ধিক্কার বা লজ্জা দেয়া। এর ফলে বেলুচিস্তান সরকার সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক বৈধতা হারিয়ে ফেলেছে বলে আখ্যায়িত করা চলে। অন্য কথায় বেলুচিস্তান সরকার হয়ত আনুষ্ঠানিকভাবে টিকে থাকবে। তবে জনগণের কাছে বৈধতার বিচারে এর রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। মামলার মধ্য দিয়ে এই প্রথম পাকিস্তানে কোন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ক্ষমতাসীন শক্তির বিরুদ্ধে সত্যোচ্চারণ করতে পারল। সুপ্রীমকোর্ট বেলুচিস্তনের অন্ধকার ও কুৎসিত বাস্তবতা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করে দিয়ে বেলুচিস্তানের প্রকৃত শাসক ফ্রন্টিয়ার কোর এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। এবং বলেছে যে ফ্রেন্টিয়ার কোরের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ আছে। কোর্ট আরও বলেছে যে বেলুচিস্তানের ব্যাপারে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর হস্তক্ষেপ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
সুতরাং বলা যেতে পারে, ২০০৭ সালের ৩ নবেম্বরের বিচারবিভাগীয় বিদ্রোহ ছাড়াও বেলুচিস্তান সংক্রান্ত মামলাটি দেশের বিচার বিভাগীয় ও রাজনৈতিক অঙ্গনের এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তান এমন এক অবস্থায় পৌঁছতে পারে যেখানে সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব উল্লেখযোগ্য মাত্রায় খর্ব হবে।
এই মামলার কারণে কয়েকজন অপহৃত ব্যক্তিকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে এবং লাপাত্তা হয়ে যাবার ঘটনা যথেষ্ট কমে গেছে। এটা যথেষ্ট তাৎপর্যবহ। কারণ আকবর বুগতির হত্যাকা- ছাড়াও ‘নিখোঁজ ব্যক্তিদের’ ইস্যুটিও বালুচদের কাছে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৈধতা ক্ষুণœ হবার এবং বালুচ বিদ্রোহ বৈধতা পাওয়ার একটা প্রধান কারণ।
তবে সুপ্রীমকোর্টের এই সাহস প্রত্যয় ও সঙ্কল্পের দ্বারা এবং বিচারবিভাগীয় পন্থায় কি বেলুচিস্তানকে রক্ষা করা যাবে? প্রশ্নটা উঠবার কারণ হলো সুপ্রীমকোর্ট ২০১১ সালের ৬ অক্টোবর ২০টি নির্দেশনা ও ঘোষণাসংবলিত প্রায় দেড় শ’ পৃষ্ঠার এক রায়ে করাচীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সমাধানের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু প্রথম প্রথম কিছু সাফল্যের মুখ দেখা গেলেও করাচীর হত্যাকা- বন্ধ করা যায়নি। এ বছর সেখানে ১৮শ’ ব্যক্তিরও বেশি নিহত হয়েছে। কাজেই সুপ্রীমকোর্ট যেখানে করাচীকেই রক্ষা করতে পারল না, সেখানে একই বিচারবিভাগীয় পদ্ধতি বেলুচিস্তানে কাজ করবে কি করে এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
করাচী কিংবা বেলুচিস্তানকে কি বিচার বিভাগীয় পন্থায় রক্ষা করা সম্ভব? বিচার বিভাগ শুধু তখনই কার্যকর হতে পারে যখন এর রায় কার্যকর করার সামর্থ্য ও আগ্রহ রাষ্ট্রের থাকে। কিন্তু বেলুচিস্তান প্রদেশে রাষ্ট্রই সেখানে ধসে পড়েছে। এবং ফ্রন্টিয়ার কোরের মতো কার্যত শাসক শক্তি যদি বিচারবিভাগীয় রায় কার্যকর করতে অনিচ্ছুক থাকে তাহলে সেই রায় দেয়ার কোন অর্থ হয় না। এখন দেখা যাক বেলুচিস্তানকে রক্ষা করতে কিংবা অন্য কথায় সেখানকার পরিস্থিতি উন্নয়নে সুপ্রীমকোর্ট কতদূর কি সক্ষম হয়?
চলমান ডেস্ক

No comments

Powered by Blogger.