বাংলাদেশ যাবে সামনে বা পেছনে? by রাহাত খান

ঢাকাইয়া ‘জোকস!’ উল্টা গেঞ্জি গায়ে চড়িয়ে এক লোক বাজারের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তাই দেখে এক রিকশা চালকের প্রশ্ন : স্যার, আপনে আইতাছেন না যাইতাচেন! সামনে যাচ্ছেন না পেছনে যাচ্ছেন পুরনো ঢাকাইয়া রসিকতা।
অনেকেরই জানা। তবে দেশের পরিস্থিতি ও রাজনীতির ধরন-ধারণ দেখে, ব্যঙ্গাত্মক সুরটুকু বাদ দিয়ে, বরং উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা নিয়ে এই প্রশ্নটাই করতে হয়Ñ দেশের রাজনীতি কোনদিকে যাচ্ছে? সামনের দিকে না পেছনের দিকে?
রাজনীতিতে দৃষ্টিভঙ্গি এবং মতের ভিন্নতা থাকতেই পারে, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে। তবে এর একটা সীমাবদ্ধতাও আছে। দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তোলার নাম, আর যাই হোক, গণতান্ত্রিক রাজনীতি নয়। হিংসা এবং হিংস্রতা গণতান্ত্রিক রাজনীতির অস্বীকার এবং বিরোধিতা বৈ আর কিছু নয়। পুলিশ-সেনাবাহিনী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। সত্য বটে নির্বাচনসর্বস্ব রাজনীতিতে, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রতীক এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে ক্ষমতাসীন সরকারের নজরদারি এবং হক-না হক আনুগত্যের প্রতিষ্ঠা একটু বেশিই থাকে। তবে বাংলাদেশ এই মুহূর্তে আর যা-ই হোক, সেনাবাহিনী বা পুলিশ, নিয়ন্ত্রিত দেশ নয়। অথচ দেখতে হচ্ছে, রাজনৈতিক মিছিল এবং ঝটিকা আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনীকে। এই ধরনের কার্যকলাপে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ছাড়া আর কি!
১৯৯১-১৯৯৬ এবং ২০০১-২০০৬ সময় পর্বে বাংলাদেশ অনেকটা সেই পথেই হেঁটেছিল। এই দুই আমলে দুর্নীতি এবং সন্ত্রাস, হত্যা, বোমাবাজি, গ্রেনেডবাজি এতটাই বেড়েছিল যে, ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকার শীর্ষে পৌঁছানোর গতি অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের। একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য এগিয়ে যাওয়ার প্রেসক্রাইভড পথ তো হচ্ছে, যত বেশি সম্ভব বিদ্যুত উৎপাদনে ব্রতী হওয়া, বিদ্যুত উৎপাদন করা, বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যাপক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ করা, জঙ্গী-সন্ত্রাসীরা যাতে কোনক্রমেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, সেই ব্যবস্থা নেয়া সর্বতোভাবে এবং দেশে কল্যাণমুখী রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, উল্লেখিত এই দুই শাসন-পর্বে এসবের বিপরীতটাই দেখেছি। দুই আমলের কোন আমলে এক ওয়াট নতুন বিদ্যুত উৎপাদন করা হয়নি। যদিও ঐ খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। উল্লেখিত দুই আমলে বাংলাদেশ যাতে বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বরং দেখেছি সেই সচেতন তৎপরতা। খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হয়নি বাংলাদেশ। মিয়ানমার-বাংলাদেশ-ভারত তেল-গ্যাস পাইপলাইনে যুক্ত হবার সুযোগ ছিল, প্রস্তাব ছিল। এই পাইপ লাইনের সঙ্গে সংযুক্তি বাংলাদেশের বিদ্যুত ঘাটতি হ্রাস করতে পারত বহুলাংশে, কিন্তু পাছে একটি প্রতবেশী দেশ উপকৃত হয়ে যায়, সেই কারণে ঈর্ষা ও হিংসায় জর্জর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার উল্লেখিত পাইপলাইনে যুক্ত হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। জঙ্গী-সন্ত্রাসীরা উন্নয়নের শত্রু, গণতন্ত্রের শত্রু, জনগণের শত্রু। কিন্তু ২০০১-২০০৬ সালে জামায়াত-বিএনপি জোট সরকার ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া থেকে শুরু করে দেশী-বিদেশী সন্ত্রাসীদের লালন-পোষণ ও পৃষ্ঠপোষকতায় যেন বা মণপ্রাণ ঢেলে ‘ব্রতী‘ হয়েছিল এবং হত্যা, তালেবানী পন্থায় নারীর ক্ষমতায়ন এবং উন্নয়নে প্রবল বাধার সৃষ্টি করেছিল। এ জন্য প্রথমে টার্গেট করা হয়েছিল ব্র্যাক, প্রশিকাসহ বড় এনজিওগুলোকে। এছাড়া অবৈধ অস্ত্র পাচার, সন্ত্রাসী কায়দায় প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিতে তারা হত্যা এবং গুম, বোমাবাজি, গ্রেনেডবাজির মতো ঘৃণ্য পন্থা বেছে নিতেও পিছপা হয়নি। আর একটা টার্ম পেলে তারা যে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পাকিস্তানে পরিণত করে ছাড়ত, এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। পাকিস্তান তাদের ভারতবিরোধী ভূমিকা দৃশ্যত কিছুটা ছেড়ে দিয়ে ভারতের সঙ্গে একটা মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপনের ভান করে যাচ্ছিল; আর তাদের একটি গোয়েন্দা সংস্থার চেষ্টা চলছিল বাংলাদেশকে কিভাবে সন্ত্রাসী ও জঙ্গী রাজত্বের দ্বিতীয় ফ্রন্ট করে তোলা যায়। এই ব্যাপারে বিএনপি (তাদের জন্মলগ্ন থেকেই) এবং জামায়াত রাজনীতির সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা ছিল বরাবরই।
এখনও সেই চেষ্টাই চলছে। চেষ্টা চলছে ১৯৭১ সালে গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী কার্যকলাপের দায়ে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার। চেষ্টা চলছে রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি এবং জনগণের কাছে এই মেসেজ পৌঁছে দেয়া যে, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকার করে না তারা। বরং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব ধ্বংস করতেই তারা সচেষ্ট।
নিবন্ধের শুরুতে প্রশ্নটা ছিল একারণেই যে, বাংলাদেশকে সামনে না ঠেলে পেছনে হঠাতেই কি চেষ্টা-চরিত এবং ষড়ন্ত্র চলছে?
সম্পূর্ণ সফল সরকার বিশ্বের কোন রাষ্ট্র আজ পর্যন্ত দেখেছে কি? সম্ভবত দেখেনি। কোনদিন দেখবে এমন আশা পোষণ করাও বৃথা। তবে বিশ্বের যে কোন রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন সরকারের কাছ থেকে যা আশা করা হয় তা হচ্ছে কিছু কিছু ভুল-ত্রুটি ও ব্যর্থতা সত্ত্বেও রাষ্ট্রকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সাফল্যÑ অন্তত মোটামুটি সাফল্য।
বর্তমান ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের নেতৃত্বে দেশ মোটামুটি উন্নয়নের পথেই তো এগোচ্ছে। যে দেশের খাদ্য ঘাটতি প্রায় বরাবরই ছিল বছরে তিরিশ লাখ টন থেকে পঞ্চাশ লাখ টন, সেই দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ; শুধু নয়, খাদ্যে উদ্বৃত্ত দেশ। এটা কি খুব একটা ছোট অর্জন? দেখেশুনে বিশেষ করে বড় বড় মিডিয়ার হাব-ভাব দেখে তো তেমনটাই মনে হয়। ২০১২ সালের উল্লেখযোগ্য ঘটনায় বাংলাদেশের এই বৈপ্লবিক অর্জনের তো উল্লেখই দেখা যায় না।
বিদ্যুত উৎপাদনের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের কিছু কিছু ভুল-ত্রুটি ও উদ্যোগ নিঃসন্দেহে আলোচনা-সমালোচনার দাবি রাখে। তারপরও এটা তো সত্য যে, বর্তমান মহাজোট সরকার গত চার বছরে আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করতে সমর্থ হয়েছে? ২০১৩ সালে আরও দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করতে সক্ষম হবে বলে তারা মনে করে। এর পরও বিদ্যুতের ঘাটতি থেকে যাবে। কারণ উন্নয়নশীল দেশে দিন দিনই চাহিদা বাড়ে এবং সম্পূর্ণটুকু সম্ভব না হোক, উন্নয়নশীল দেশের ক্ষমতাসীন সরকার অন্তত সহনীয় স্তরে বিদ্যুতজনিত দুর্ভোগ সীমিত রাখবে, সেটাই গণমানুষের প্রত্যাশা। এই প্রত্যাশা পূরণে বর্তমান মহাজোট সরকার ব্যর্থ হয়নি, বরং সফল হয়েছে। এই অর্জনকেও খাটো করে দেখা যায় না।
অথচ যে বিএনপি এবং বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের দুই আমলের কোন আমলে এক ওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হয়নি সেই তারা ইদানীং জনগণের বিদ্যুত-সরবরাহজনিত ঘাপলায় ‘জনগণের দুর্ভোগে’ ভারি কষ্ট পায়। অনেক মহল তো এমনও মনে করে, বিএনপি জোট কোনদিন ক্ষমতায় গেলে আবার বিদ্যুত উৎপাদন না করার পথই বেছে নেবে। যারা বাংলাদেশকে আবার তলাবিহীন ঝুড়ি এবং ব্যর্থ রাষ্ট্রের পথে নেয়ার মিশন বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখছে, স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশকে আফগানিস্তান-পাকিস্তানের মতো জঙ্গী রাষ্ট্রে পরিণত করতে, তাদের কাছে দেশের উন্নয়নবিরোধী পন্থা বেছে নেয়াটাই তো স্বাভাবিক।
বর্তমান মহাজোট সরকারের কিছু কিছু দুর্নীতি কেলেঙ্কারির পাশাপাশি অনস্বীকার্য সাফল্যও অনেক আছে। সমুদ্র জয়, শিক্ষা-নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে যুগোপযোগী বিজ্ঞানমনষ্ক শিক্ষার প্রচলন, কৃষি ও শিল্পের অভূতপূর্ব উন্নয়ন, সারাদেশে প্রযুক্তির বিস্তার, তথা তথ্য-প্রযুক্তি প্রসারে বিপ্লব সাধন, বার্ষিক রফতানি ভল্যুম ও আয় আগের চেয়ে প্রায় আড়াই গুণ বৃদ্ধি, আমদানি ব্যয় কমাতে পারা, বিশ্বে বিরাজমান মহামন্দার সময়ে ৬ লাখ লোকের বিদেশে কর্মসংস্থান করতে পারা, রেমিট্যান্স বৃদ্ধিÑ এ সবই যে সাফল্যের পর্যায়ে পড়ে, এটা তো অস্বীকার করা যাবে না!
আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাসমূহের সমীক্ষামূলক অভিমতও এই মন্তব্যের পক্ষেই সাক্ষ্য দেয়। বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক সংস্থার সমীক্ষায় দেখা যায়, অর্থনৈতিক উন্নয়নসূচীকে বাংলাদেশ ইতিবাচক অবস্থানে রয়েছে। রাজনীতির অস্থিতিশীলতা, নৈরাজ্য, মিডিয়ায় অহর্নিশ সরকারের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা, সামাজিক অস্থিরতা ইত্যাদি বিরাজমান থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ কিভাবে দ্রুত অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারছেÑএটা কিছু কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে বিস্ময়কর বলে মনে হয়েছে; বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত আমলে সৃষ্ট জঙ্গীবাদী ও সন্ত্রাসী তৎপরতা, বোমাবাজি, গ্রেনেডবাজি প্রায় নির্মূল করার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের সন্দেহাতীত সাফল্য পশ্চিমা বিশ্বকে বিস্মিত করেছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ওপর তাদের আস্থা ও বিশ্বাসও বেড়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
কিছু কিছু ব্যর্থতা, অব্যবস্থাপনা, কেলেঙ্কারি এবং দুর্নীতির অভিযোগ সত্ত্বেও বর্তমান মহাজোট সরকারের বহু ক্ষেত্রে কোন কোন ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য অর্জনের কৃতিত্ব রয়েছে। আর রাজনৈতিক তৃতীয় শক্তি উত্থানের বিষয়টি ইদানীং উঠে এসেছে এতদসত্ত্বেও। এটা ভাববার মতো একটা ব্যাপার বটে।
বিশ্বে এমন একটা দৃষ্টান্তও পাওয়া যায় না, যেখানে তৃতীয় শক্তির উত্থানে দেশ উপকৃত হয়েছে। অরাজনৈতিক শক্তি দেশকে শুধু ক্রমে ক্রমে অনুন্নয়ন এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের দিকেই ঠেলে দিতে পারে। পাকিস্তান, সোমালিয়া, সুদান প্রভৃতি আইনের শাসনের প্রায় অযোগ্য হয়ে ওঠা রাষ্ট্রগুলো এর প্রমাণ। বড় বড় কথা, উচ্চাকাক্সক্ষী পরিকল্পনা দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল ইত্যাদি কথা বলে এসব জনসম্পর্কহীন সরকার পেছন দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসীন হয়। তারপর এক সময়ে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, স্বৈরাচারী কার্যকলাপ ইত্যাদির দায়ে গণঅসন্তোষ ও গণঅভ্যুত্থানের মুখে বিদায় নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু ততদিনে দেশটা কিছুমাত্র সামনে এগিয়ে যাওয়ার বদলে ভয়াবহ রকম পিছিয়ে যায়।
তৃতীয় শক্তির উত্থান নিয়ে একটি মহল ইদানীং খুব আশাবাদী হয়ে উঠেছে। আজীবন ব্যর্থ রাজনীতিক অথচ প্রবলভাবে ক্ষমতালিপ্সু কেউ কেউ এরই মধ্যে মন্ত্রী-উপদেষ্টা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। ব্লু-প্রিন্ট নাকি তৈরি। যথাসময় বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তির উত্থান ঘটবে।
আবার সেই প্রশ্ন : বাংলাদেশ কি উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারবে? নাকি এবাউট টার্ন করিয়ে পেছন দিকে যেতে বাধ্য করা হবে বাংলাদেশকে?

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.